প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
হেমন্তের পড়ন্ত বিকাল। আরিফা চাঁদপুর বড়স্টেশনের রক্তধারার পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় দশ মিনিট ধরে বিবাগী মনে পায়চারি করছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে নীল আকাশের ছেড়া মেঘের ফাঁকে ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে। সিঁদুর রাঙা মেঘ জমেছে দিগন্তের গায়। এই মায়াময় আলোর বিকেলে দূরদিগন্তে নীল আকাশ নুয়ে এসে মিশে গেছে মেঘনার বুকে। নদীর ঢেউগুলো অলসভাবে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তীরে স্তূপকরা ছোটবড় পাথর কণাকে। পানিতে সাদা বক আর পানকৌড়িরা স্নান করছে আপন মনে। নদীর অথৈ জলরাশির কলকলধ্বনি আর হাওয়া বয়ে যাওয়ার সোঁসোঁ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। এখন আরিফার মৌনভঙ্গ করে হাজারো কথার ফুলঝুরি ফতাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল অয়ন এখনও আসছে না। আরিফার আর তর সইছে না। দীর্ঘ এক বছর পর আজ অয়নকে দেখতে পাবে ভেবে সে রাতে ঠিকমত ঘুমাতেই পারেনি। সে রাতভর অয়নকে নিয়ে ভেবেছে। অয়ন কিছুটা স্থূলকায়। সে নিশ্চয় আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে গেছে, হয়তো অনেক বদলে গেছে -এ রকম শতশত বিমর্ষ কথা তার ভাবনার অবনিতে উঁকি দিচ্ছিল। অয়নের আসার বিলম্ব দেখে সে রেগে অনেক ক্রোধ নিয়ে নদীর তরঙ্গায়িত জলরাশিতে ছোট ছোট পাথরের টুকরা ছুঁড়ে মারছে। দক্ষিণা সমীরণের শিরশির স্পর্শ তার গায়ে আদুল অনুভূতির সৃষ্টি করছে, আর তার হালকা সোনালি-কৃষ্ণ বর্ণের কেশগুচ্ছ মৃদু দুলছে। সে মনস্থির করেছে আজ অয়নের সাথে আড়ি, তার সাথে কোনো কথাই বলবে না।
অয়ন রায়হান ও নেহালকে প্রস্তুতি নিতে দেরী করার কারণে বকা দিচ্ছে। ওরা দু’জন অয়নের ভাল বন্ধু। অয়ন বন্ধুদের কথা দিয়েছিল একদিন আরিফার সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিবে। এ থেকেই ওদের আজ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। অবশেষে ওরা প্রস্তুতি শেষ করে একটি সিএনজি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আর সাথে করে তিনজনই ওদের দামী স্মার্টফোন নিয়ে নিয়েছে আজকের দিনের দারুণ সব মুহুর্তকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখার জন্য। অয়ন বুঝতে পেরেছে আরিফা নিশ্চয় রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছে। তাই সে সঙ্গে করে ওর পছন্দের এক গুচ্ছ শিউলি ফুল নিয়ে গেছে। সে জানে আরিফা শিউলি ফুল দেখে নিশ্চয় রেগে থাকতে পারবে না। ঠিক চল্লিশ মিনিটের মধ্যে সিএনজি রক্তধারায় গিয়ে থামল। অয়ন দেখতে পেল আরিফা নদীর দিকে বিষন্ন মনে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে-মুখেও রাগের ছাপ স্পষ্ট। সে কিছু না বলেই আরিফার সামনে ফুলগুলো এগিয়ে দিল। আরিফা অনেক ক্রোধ নিয়ে ফুলগুলো গ্রহণ করে বলতে থাকে,
-এখন কয়টা বাজে ?
-স্যরি, আসলে হয়েছি কি.....
অয়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আরিফা বলতে থাকে,
-থাক, অনেক হয়েছে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? ঐ বাদরগুলো কে?
অয়ন আরিফার এ কথা শুনেই মুচকি হাসতে থাকে। অয়নের মুখের এই লেগে থাকা হাসি আরিফা সবসময়ই বেশ উপভোগ করে। বাদলা দিনে তার ভেজা মনকে ওর রোদ্দুর হাসি রোদে ঝলমলে করে দেয়। আরিফার যতই মন খারাপ থাকুক না কেন অয়নের হাসিমাখা মুখ দেখলেই সে সব অভিমান ভুলে যায়। সে বাতায়ন খুলে হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরের বাতাবরণে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি কণা ওর মনে দোলা দিয়ে যায় অহর্নিশ। অয়ন হাসি থামিয়ে আরিফার সাথে রায়হান ও নেহালকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর রায়হান ও নেহাল নদীর মোহনায় বিকালের রঙিন আভায় ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এদিকে অয়ন ও আরিফা তাদের দীর্ঘ দিনের অব্যক্ত কথামালা একের পর এক প্রকাশ করতে থাকে।
অয়ন এক পর্যায়ে আরিফাকে আকাশ দেখিয়ে বলে,
-তুমি একফালি আকাশ, আর আমি এই আকাশে ভুল করে ঢুকে পড়া একটি শঙ্খচিল।
-মানে কী?
-তোমাকে নীলাম্বরীর মতো দেখাচ্ছে। যার মধ্যে কিছু শুভ্র মেঘ আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমি হচ্ছি এই মেঘের ভিতর অযাচিতভাবে ঢুকে পরা একটি চিল।
-তুমি আমাকে এত ভালোবাসো কেন? আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে নাতো?
-না, কখনো না। প্রয়োজনে তোমাকে নিয়ে কোনো এক নির্জন দ্বীপে, কোনো এক গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাবো, যেখানে ঝর্ণার ধারে বসে জঙ্গলের পাতায় পাতায় সূর্যের আলো বিলীন হওয়া দেখবো কিংবা কোনো এক আমলকির বনে ঝরা পাতায় শুয়ে বৃক্ষরাজির গোপন কথায় আড়ি পেতে থাকবো। সবুজ ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের নীল আকাশ দেখবো। আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘ দেখবো। সেখানে আমরা আমাদের স্বপ্নের মতো নতুন এক পৃথিবী গড়ে তুলবো। কেউ আমাদের বলতেও পারবে না, তোমরা কে? আমরাই হবো সেই ভুবনের একমাত্র বাসিন্দা।
অয়নের এ ভালবাসা দেখে আরিফার চোখে রাজ্যের কালো মেঘ জমা হয়ে যায়, তার চোখ থেকে টলমল করে অশ্রুর ফোয়ারা ঝরে পড়তে থাকে বৃষ্টি হয়ে। তারপর সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে অয়নকে বলতে থাকে,
-আমি এখনও বাতায়ন খুলে তোমার পথ চেয়ে থাকি, বাতাসে কান পেতে থাকি, যদি তোমার ডাক শুনি! বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টিপূর্ব মায়াময় গন্ধে তোমাকে খুঁজি। ভেজা বাতাস আর আমার ভেজা মন অস্থির হয়ে যায় তোমার কারণে! আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব কিন্তু মোহনীয় জলসুরের ছন্দে ছন্দে ঝরে যাবার আগে আমার সাথে সাথে যেন তোমার অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছে, সব নিশ্চুপ হয়ে যায়। জানালার পাশের গোলাপ ফুলগুলোও যেন সৌরভ ছড়ায় না, তুমি আসবে বলে। কিন্তু আমি ধৈর্যচ্যুত হয়ে যাই তোমার অনুপস্থিতি দেখে। অনেক বেশি বিবাগী হয়ে যাই তোমার রিক্ততায়।
এ কথা বলতেই আরিফার গলা ধরে আসে। সে আর কিছুই বলতে পারে না। অয়নও প্রায় বাকহীন। কিছুক্ষণ পর রায়হান ও নেহাল এসে তাদের নীরবতা ভাঙায়। তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে প্রায়। অয়ন বলল সন্ধ্যা নেমে আসবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই, এবার আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। তারপর সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে রক্তধারার সামনে চলে আসে। ঠিক যখনই তারা মুক্তিযুদ্ধের স্তৃতিস্তম্ভ রক্তধারা অতিক্রম করবে, তখনই ধারালো চাপাতি হাতে এক যুবক তাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়। যুবকটি আরিফাকে পূর্বে কয়েকবার প্রেম প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এবার সে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে এসেছে। সে আরিফার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। অয়ন ও তার বন্ধুরা একবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে অস্ত্রধারী যুবকটি হুমকি দেয়, ‘যে সামনে আসবে তাকেই শেষ করে দিবো।’ ফলে অয়ন ও তার বন্ধুরা ভড়কে গিয়ে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকে। আর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীটি তখনও আরিফার সাথে ধস্তাধস্তি করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে আরিফার মাথায়, চোখে, মুখে ও গলায় নৃশংসভাবে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। আরিফা ‘বাঁচাও, বাঁচাও, অয়ন, অয়ন’ বলে চিৎকার করতে থাকলেও অয়ন সাড়া দেয়নি।
অয়ন ও তার বন্ধুরা ভয় পেয়ে যায়। আরিফাকে বাঁচাতে তাদের কেউই এগিয়ে আসছে না। সন্ত্রাসীর হাত থেকে আরিফাকে বাঁচাতে চেষ্টা না করে প্রথমে অয়ন তার স্মার্টফোনটি পকেট থেকে বের করে আরিফার সাথে ঘটতে থাকা এই নৃশংস দৃশ্য ফেসবুকে লাইভ করতে থাকে। অয়নের দেখাদেখি রায়হান এবং নেহালও আরিফার জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভে যাওয়ার দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করতে শুরু করে। তারপর তাদের দেখে দেখে পথচারী অন্যান্য লোকেরাও এই করুণ দৃশ্য ভিডিও করতে শুরু করে। অসংখ্য আঘাতের ফলে আরিফা কংক্রিটের রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই মধ্যেই জীবন্ত, প্রাণবন্ত মেয়েটি লাশ হয়ে যায়, তার নিস্তব্ধ, নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত দেখে সন্ত্রাসী দ্রুত পালিয়ে যায়।
কেউই সন্ত্রাসীকে আটকাতে বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকুও করেনি। তাদের প্রত্যেককে মনে হয়েছে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, আর তারা যেন কোনো সিনেমার শুটিং স্পটে ভিডিও করতে এসেছে। কিছুক্ষণ আগের ভুবনজয়ী প্রেমিক অয়ন আরিফার খুন হয়ে যাওয়ার দৃশ্যকে ফেসবুকে প্রচার করে নিজের ভালোবাসার জানান দিয়েছে। আরিফার নীলাম্বরীতে শঙ্খচিল হওয়া, গভীর অরণ্যে সূর্য বিলাস কিংবা নতুন পৃথিবী বানিয়ে নিজস্ব আবাসন তৈরি -এ সবই সামান্য চাপাতির সামনে ফিকে হয়ে যায়।
স্মার্টফোনের কারণে আরিফার জন্য অয়নের হৃদয় কোণে জমে থাকা সমস্ত প্রেম, প্রবল আবেগ ও হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি বিকল হয়ে যায়, আর মৃত্যু ঘটে প্রকৃত মনুষত্ববোধ ও ভালোবাসার। সেই সাথে মানবিকতাবোধ ও ভালবাসার পরিধি নির্ধারিত হয়ে যায় মোবাইলে ধারণকৃত কয়েক মিনিটের ভিডিওতে যেখানে অন্তত হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য জনসম্মুখে নিয়ে আসা গেছে। এদিকে অয়ন ও তার বন্ধুরা হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে ভাইরাল বনে যাওয়ায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে।