প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
আজকাল ভরদুপুরে খুব করে কাঁদামাটিতে গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে জাগে শৈশবের সেই ভাঙাচুরা পাটখড়ি দিয়ে কর্দমাক্ত মাটির বুক আঁচড়ে আঁচড়ে নানান রঙের স্বপ্ন আঁকি। তারপর আমার নানির দৌড়ানি খেয়ে কাঁদামাটির জামা গায়ে সারা বাড়ি চষে বেড়াই। অথচ আজ নানি নেই, কোনো এক শীতের অপরাহ্নে তিনি আমাদের ছেড়ে আপন নীড়ে চলে গেছেন।
আজকাল প্রায়শই দুপুরের আকাশ ছাইরঙা। এই বুঝি অঝর বর্ষণ হবে। যদি বৃষ্টি ভেজা মাটির মন মাতানো গন্ধ নাকে এসে লাগে, আমি বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়ে ছুটবো সেই সোঁদা গন্ধের সন্ধানে। বৃষ্টি নামার অল্প সময়ের মধ্যেই পুকুরের পানি ঈষৎ উষ্ণ হয়। পুকুরের সেই উষ্ণ পানিতে বৃষ্টি পড়ার টাপুরটুপুর শব্দ শুনতে শুনতে ভেলায় চড়ে আমার বৃষ্টিবিলাস করতে ইচ্ছে করে।
আমার খুব ইচ্ছে করে দুরন্তপনা শৈশবের ধুলো ওড়া রাস্তায় বিয়ারিংয়ের তৈরি ছোট্ট ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আচমকা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাই। বিয়ারিং ও কাঠ সংগ্রহ করে ঠেলাগাড়ি বানানোর সামর্থ্য আমার ছিলনা। অন্য বন্ধুদের গাড়ি দীর্ঘক্ষণ ঠেলা দেওয়ার বিনিময়ে অল্পসময়ের জন্য আমার গাড়িতে ওঠার সুযোগ হতো। একদিন মনের মাঝে প্রচণ্ড জেদ চাপল যে, ধাক্কা দেওয়ার বিনিময়ে আর অন্যের গাড়িতে উঠবো না, নিজে একটা গাড়ি বানিয়ে তবেই সেই গাড়িতে চড়বো। কিন্তু আমার গাড়ি বানানোর সেই স্বপ্ন আজও চোখ মেলেনি।
অধুনা আমার মন চায় সাইকেল বা রিক্সার পরিত্যক্ত টায়ার লাঠি দিয়ে পিটাতে পিটাতে ধূসর ধুলো গায়ে মেখে কোনো এক পথের বাঁকে অবিরাম ছুটে চলি। ছেলেবেলায় আমার কাছে টায়ার না থাকায় বাঁশের ফালি দিয়ে টায়ারের মতো গোলাকৃতির চাক বানিয়ে সেটা নিয়েই সারাবেলা ছুটাছুটি করতাম। আব্বার একটা পুরনো সাইকেল ছিল যেটা চালিয়ে উনি প্রতিদিন বাজারে যেতেন। আমি একদিন সেই সাইকেলের একটি টায়ার খুলে ফেলার সময় আব্বা দেখে ফেলে বেদম মারেন। সন্ধ্যায় আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি উনার চোখ মেঘে ঢাকা আকাশের মতো বর্ষণোন্মুখ। পরদিন আব্বা আমাকে সাইকেল থেকে সেই টায়ারটিই খুলে দেন।
ইদানীং আমার সোনালি শৈশবে ফেলে আসা ডাংগুলি খেলার স্মৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে। ছেলেবেলায় বন্ধুরা মিলে গাছের ডাল কেটে দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা একটি লাঠি (এটিকে ডান্ডা বলা হতো) ও তিন বা চার ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা আরেকটি লাঠি (এটিকে গুলি বলা হতো) বানাতাম। তারপর খেলার মাঠে ছোট্ট লম্বাটে গর্ত খোঁড়ে সেই গর্তে গুলি রেখে ডান্ডা দিয়ে বাড়ি মেরে শূন্যে ছুঁড়তাম ও গুলিটি শূন্যে থাকা অবস্থায়ই আবারো বাড়ি মেরে বহুদূরে ফেলতাম। এভাবে আরো নানান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে খেলাটি শেষ করতে হতো। আজ আমার ডাংগুলির সেই ঠকঠক শব্দের অনুরণনে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
ভীষণ মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের ‘সাতচারা’ খেলার কথা। সমবয়সী সকলে পুরনো মাটির হাড়ি/খোলা কুড়িয়ে এনে সেটিকে ভেঙে ছোটছোট সাত খন্ডে বিভক্ত করে একটির উপর আরেকটি সাজিয়ে রাখতাম। তারপর খেলার এক পক্ষ নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে টেনিস বল দিয়ে খুব আস্তে সেগুলো ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাতো, পুনরায় তারা অপরপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেগুলোকে একটির উপর আরেকটিকে সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। আজকাল শৈশবের সাতচারার টুংটাং আওয়াজে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে।
ছেলেবেলায় পুরনো খবরের কাগজ কিংবা পলিথিন সংগ্রহ করে ঘুড়ি বানিয়ে উড়াতাম। তারপর ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে নাটাই হাতে বিলের পর বিল, মাঠের পর মাঠ ছুটে চলতাম অহর্নিশ। কখনো কখনো নাটাইয়ের গোড়া থেকে সুতোয় করে আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ির কাছে চিঠি পাঠাতাম। সময়ের ঘূর্ণিপাকে শৈশবের ঘুড়ি উড়ানোর উন্মাদনা ম্লান হয়ে গেলেও সেই স্মৃতি আজও মনে দোলা দিয়ে যায় নিরন্তর।
আহা! কী সোনালি শৈশবই না কাটিয়েছি আমরা। আজ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সময়ের আবর্তে হারিয়ে গেছে শিশির ভেজা সকালে মক্তবে আরবি পড়তে যাওয়ার দিনগুলি, বিকালের সোনা রোদে লুকোচুরি, আম কুড়ানোর দিন, দক্ষিণা দমকা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার চমৎকার সব মুহুর্ত। আজ বিলীন হয়ে গেছে ইচিং বিচিং, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, পুতুল খেলা, লাটিম খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, ষোলোগুটির মতো দারুণ দারুণ সব খেলা। আজ আবার খুব করে ফিরে পেতে চাই আমার দুরন্তপনা শৈশব, ফিরে পেতে চাই সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি।