রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

স্বপনের স্বপ্ন
অনলাইন ডেস্ক

গাঁয়ের শেষ প্রান্তে স্বপনদের ছোট্ট একটা মুদিখানার দোকান। অল্প হলেও সকল জিনিসপাতি রাখে। সেই সাথে চুলায় কেটলি বসিয়ে চা-ও হয়। সকাল-সন্ধ্যা। স্বপনের বাবা একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটুর নিচ হতে দুই পা সরু ও বাঁকা। মাংসপেশি নেই বললেই চলে। ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। হাঁটলে মনে হয় হাঁটু বাঁকা করে লাফাচ্ছে। ডানে-বামে হেলে পড়ে। সমান তালে চলে দুই হাতেরও লাফালাফি। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই দরদর করে ঘাম ঝরে। মনে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটি কাটার কাজ করে এলো। বসতভিটা ছাড়া মাঠে অল্প কিছু আবাদি জমি আছে। চাষাবাদ করে তাতেই কোনোরকমে সংসারটা চলে যায় স্বপনদের।

স্বপনেরা তিন ভাই-বোন। স্বপন সবার বড়ো। ছোটো দুইটা বোন। স্বপন এবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারের বড় ছেলে হিসেবে বাপের সকল কাজে তাকেই সাহায্য করতে হয়। দোকানের মালামাল কেনা হতে শুরু করে ক্ষেতের ফসলের দেখাশোনা। জমিতে কখন, কোন ফসল বপন বা রোপণ করতে হবে। কখন সেচ দিতে হবে। কখন সার, কীটনাশক দিতে হবে। সবই করে এই ছোট্ট স্বপন। কামলাদের সাথে নিড়ানি দেওয়া। ফসল কাটাই, মাড়াই ও ঝাড়াই সবকিছু দেখাশোনা করে।

তার মাও অসুস্থ থাকে মাসের অধিকাংশ সময়। হাঁপানির ব্যারাম আছে। সাথে শ্বাসকষ্ট। তাই বাড়ির কাজেও মাকে সাহায্য করতে হয় স্বপনকে। ধান সিদ্ধ, ধান শুকানো, আবার রাইস মিল হতে চাল করে আনা। কী করে না স্বপন? এই বয়সেই পুরো সংসারের হাল কাঁধে নিয়েছে।

আশপাশের পাঁচগ্রামে স্বপনের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের সকলে তাকে প্রচুর ভালোবাসে। ইশকুলের স্যারদের নজরেও স্বপন বেশ মেধাবী। হবেই না কেন? এই অল্প বয়সেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ক্লাসে প্রথম। এতো কাজের চাপ তবুও নিয়মিত ইশকুলে যায় সে। স্বপন এতটাই মেধাবী যে, যেকোনো পড়া দুই-একবার পড়লেই আয়ত্তে নিয়ে নিতে পারে। হুবহু লিখে দিতে পারে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা।

ইদানিং প্রায় ইশকুলে যাওয়া হয় না স্বপনের। তার মায়ের অসুখটা বেড়ে গেছে। কোনো কাজ-কাম ঠিকঠাক করতে পারে না। একটু কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠে। ছোটো ছোটো বোন দুইটাও তেমন মাকে কাজে সাহায্য করতে পারে না। বড়োটা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোটটা, এখনো ইশকুল কী বুঝে না। বয়স মাত্র চার বছর। এদিকে বাপকেও কাজে সাহায্য না করলে চলে না। দোকানের মালামাল বাজার হতে কিনে এনে দেওয়া লাগে। কাপ-পিরিচ, কেটলি, গ্ল­াস, জগ ধুয়ে পানি এনে দিতে হয়। সবকিছু জোগাড় করে দিলেই তার বাপ বসে বসে দোকানটা চালাতে পারে।

ক্ষেতের ফসল দেখতে মাঝে মধ্যে যায় স্বপনের বাপ। মাঠে যাওয়া ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা তাকে ভয় পায়। হেঁটে গেলে দূর হতে মনে হবে কে যেন তেড়ে আসছে। হাতে একখানা লাঠিও রাখে। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার ভয়ে। তা দেখে, ছেলে-মেয়েরা ভয়ে পালিয়ে যায়। সেই ভয়ে ওরা ওদের বাপকে খাবারটুকুও দিতে যেতে রাজি হয় না। এই নিয়ে হাট-বাজারে কতই না কথা হয়। তাদের দোকানেও এমন কথা হয়। হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকে লোকজন। স্বপনের বাপও রসিক মানুষ। তাৎক্ষণিক ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে পারে। কারো কথায় কখনও রাগ হয় না তার। এলাকায় তাকে ‘মাটির মানুষ’ হিসেবেই দেখে।

স্বপনের মা মারা গেছে। আজ সাতদিন হলো। স্বপনের স্বপ্নগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গেল। পুরো পরিবারটা যেন বানের জলে তলিয়ে গেল। এই সংসার সামলাবে কে? ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল স্বপনের বাপ। দোকানটা যত কষ্টেই হোক চলে যাবে কিন্তু বাড়ির দিক! কিছুই মাথায় আসছে না স্বপনের বাপের। আবার বিয়ে করবে সেটাও ভাবতে পারছে না। দ্বিতীয় সংসার পাতার ইচ্ছে নেই। তাছাড়া সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছেলে-মেয়েদের কি না কী চোখে দেখবে সৎমা। তাই শেষমেষ বেছে নিলো স্বপনের বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে বাড়ির রান্নাবান্নার কাজটুকু হয়ে যাবে। বাপ-ছেলে খাটবে। সংসার চলে যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। স্বপনের জন্য বউ খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলো।

আজ দশ দিন হলো ইশকুলের মুখ দেখেনি স্বপন। তার ইশকুলের গণিত স্যার এসেছেন। স্বপনের খোঁজ-খবর নিতে। তার মা মারা যাবার খবর আগেই শুনেছিলেন ইশকুলের স্যারেরা। কেউ কেউ জানাজাতেও এসেছিলেন। স্যার এসে, বাড়িতে পেলেন না স্বপনকে। গেলেন দোকানে। সেখানেও পেলেন না। স্যার স্বপনের কথা জানতে চাইলে তার বাপ বলল, তার মা মারা যাবার দিন হতে দোকানে ঠিকমতো আসে না। কোথায় যে থাকে বলতে পারছি না স্যার।

স্বপনের বাপের সাথে আলাপ সেরে হাঁটতে লাগলেন বজলুর রহমান স্যার। রাস্তার পাশেই একটা ছোট্ট খেলার মাঠ। সেখানে স্বপন একাই বসেছিল। মলিন মুখে, আকাশের দিকে তাকিয়ে। রাস্তা দিয়ে যেতেই স্বপনকে দেখতে পেলেন স্যার।

কীরে স্বপন। তুই এখানে একা একা কী করছিস? স্যার জানতে চাইলেন।

এমনিতেই বসেছিলাম স্যার। স্যারকে দেখে, সালাম দিয়ে আগেই দাঁড়িয়েছিল স্বপন।

তোদের বাড়ি ও দোকানে গিয়েছিলাম। তোকে খুঁজতে। ইশকুলে যাস না কেন? মা মারা গেছে বলে কি পড়ালেখা ছেড়ে দিবি?

স্যারকে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না স্বপন। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে মাথা নিচু করে বলল, স্যার আমি তো পড়ালেখা ছাড়তে চাই না। কিন্তু কী করব বলেন স্যার? মা মারা যাবার পর তো পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। দোকান ও বাড়ি দেখতে হচ্ছে। তাছাড়া...

তাই বলে কি তোর স্বপ্নগুলো অধরাই থেকে যাবে? তুই যেদিন বলেছিলি, স্যার আমি একজন আদর্শবান শিক্ষক হতে চাই। সেদিন হতেই তোকে আমি নিজের সন্তানের মতো দেখি।

স্বপন সবকিছু খুলে বলল স্যারকে। স্বপনের কথা শুনে স্যার বললেন, তোর পড়ালেখার সকল দায়িত্ব আমি নিলাম। তুই যেদিন পারবি ইশকুলে যাবি। না পারলে না যাবি। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তোকে পড়াতে আসব। আর তোর বিয়ের ব্যাপারটা আমি দেখে নিচ্ছি। তোর বাপকে সবকিছু বুঝিয়ে নেবো। আর বাল্যবিয়ে দিয়ে কি তোর বাপ জেলে যেতে চাইবে? নিশ্চয় চাইবে না। চল, আমার সাথে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়