প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
জন্মের পর থেকে সে কেবল শুনে আসছে একটা লোকের ভাষণ। কিন্তু লোকটাকে কখনো দেখেনি। তাঁর ভাষণ শুনলেই প্রচ্ছদের গায়ের রোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। মাইকে যখন তাঁর ভাষণ বাজে, তখন সে শব্দ যত দূর থেকেই আসুক না কেন, প্রচ্ছদের মনে তাতে শিহরণ জাগে। প্রচ্ছদ তার স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়েই বুঝতে পারে, লোকটার ভাষণে গভীর জাদুকরি শক্তি আছে। তাঁর গলার স্বরে কী যেন এক সম্মোহনের ব্যাপার আছে। সম্মোহন জিনিসটা কী তা প্রচ্ছদ বুঝতে পেরেছে জাদুকর রাজীব বসাকের জাদু থেকে। একবার জাদুকর রাজীব বসাক এসেছিল তাদের শহরে। ছোট বাচ্চাদের জন্যে একটা জাদু দেখিয়েছিল। তাতে প্রচ্ছদকে উনি মঞ্চে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে সম্মোহিত করে ফেললো। এরপর প্রচ্ছদ জাদুকরের কথামতোই সব কাজ করলো। জাদুকর রাজীব বসাক যখন তার সম্মোহনের প্রভাব ভাঙালো তখন প্রচ্ছদ স্বাভাবিক হয়ে এলো। তবে জাদুকর রাজীব বসাকের চেয়ে এই লোকের ভাষণের প্রভাব অনেক অনেক বেশি প্রগাঢ়। রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার পড়ে প্রচ্ছদ জেনেছে, যাঁর ভাষণে তার গায়ের রোমে রোমাঞ্চ তৈরি হয়, তাঁকে হিমালয়ের উপমায় ডাকে সবাই। তাঁর ছবিকে পেছনে বড় করে রেখে একজন ভক্ত ছবির ক্যাপশান লিখেছে, 'হিমালয়ের পাদদেশে।' স্কুলের স্যার একদিন ক্লাসে এই মহাভাষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো নাকি তাঁকে প্রথম হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছিলেন। স্কুলের স্যারের কাছে শোনার পর থেকে প্রচ্ছদের খুব আগ্রহ হলো কিউবা দেশ সম্পর্কে কিছু জানার। সে ভূ-গোলক নিয়ে বসে পড়লো তন্ময় হয়ে।
প্রচ্ছদের পাড়ায় একটা আবৃত্তি সংগঠন আছে। তারা বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে আবৃত্তির মহড়া দেয় এবং পরিবেশন করে। প্রখরও সেই সংগঠনের একজন শিল্পী। এবারের পনর আগস্ট উপলক্ষে প্রচ্ছদের সংগঠনকে ঢাকায় আহ্বান করেছে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। তাদের আবৃত্তি টেলিভিশনে প্রচার হবে। আর তার রেকর্ডিং হবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে। যাঁর ভাষণ প্রচ্ছদকে সম্মোহিত করে রাখে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর হলো তাঁর বাড়ি। এ বাড়িকে এখন জাদুঘর বানানো হয়েছে। পনর আগস্ট হলো সেই মহাজাদুকরের মহাপ্রয়াণের দিন। রেকর্ডিং উপলক্ষে তাদের দলের জোরেশোরে মহড়া চলছে। মহড়ার যিনি প্রধান নির্দেশক তিনি মহড়া শুরুর আগে একটা ব্রিফিং দিলেন। মহাভাষণের জাদুকরকে এই পনর আগস্টেই নির্মমভাবে হত্যা করেছিল কয়েকজন মেজর, যারা চায়নি বাংলাদেশের জন্ম হোক। শুধু তাঁকে নয়, তাঁর পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিল তারা। শুধু বেঁচে গিয়েছিল তাঁর দুই কন্যা যাঁরা সেদিন ভাগ্যক্রমে জার্মানিতে ছিলেন। যে ঘরে তাঁর লাশ পড়েছিল সিঁড়িতে, সেই বত্রিশ নম্বর বাড়িটিকেই তাঁর মেয়ে জাদুঘরের জন্যে দান করে দিয়েছেন। প্রচ্ছদদের আবৃত্তির শ্যুটিং এই জাদুঘরের আঙিনাতেই হবে। যারা আবৃত্তি শিল্পী তাদের মনে উৎসাহের কমতি নেই। মহাভাষণের মহান জাদুকরের জাদুঘরে যাবে তারা। বড়দের কাছে তাঁর কত কথা শুনেছে! তাঁর ছোট ছেলেটা প্রচ্ছদের চেয়ে বছর চারেকের ছোট হবে। প্রচ্ছদ এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। আর তাঁর ছোট ছেলে পড়তো ক্লাস টু-য়ে। ঐ সময় ঘাতকেরা তাকেও গুলি করে মেরে ফেলেছিল। তাঁর নাম ছিল রাসেল। বত্রিশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাসেল নাকি পতাকা ওড়াতো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের।
গাড়ি করে প্রচ্ছদ ও তাদের দল রওনা করেছে ধানমন্ডি বত্রিশের তীর্থের উদ্দেশ্যে। যিনি বাংলাদেশের জনক তাঁর বাড়ি তো বাঙালির তীর্থই বটে। প্রচ্ছদ গাড়িতে বসে বসে ভাবে। তাঁর নানা নাকি নাম রেখেছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু বাবা-মায়ে আদর করে ডাকতো খোকা বলে। এলাকার লোকেরা তাঁকে ডাকত মিয়া ভাই বলে। তাঁর যারা ভক্ত তারা ডাকে শেখ সা'ব বলে। আর বাঙালির কাছে শেখ মুজিবই বঙ্গবন্ধু। বিশ্বের নানা দেশের একটা সংঘ আছে। তাকে জাতিসংঘ বলে। এই জাতিসংঘ বঙ্গবন্ধুকে উপাধি দিয়েছে বিশ্ববন্ধু বলে। গাড়িতে যেতে যেতে প্রচ্ছদ বঙ্গবন্ধুর ওপরে লেখা একটা জীবনী পড়ে ফেলল। পথের মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে নাশতা খেলো সবাই। পরোটা, ডিম, ভাজি আর চা। তারপর ওয়াশরুমে হাল্কা হয়ে সবাই উঠে পড়ল গাড়িতে। একসাথে দলে না গেলে প্রচ্ছদ বুঝতেই পারতো না গাড়িতে ভ্রমণে কেউ কেউ বমি করে দেয়। আসলে গাড়ির গতি ও বাঁক এবং কারো কারো পেট্রোল-ডিজেলের গন্ধ সহ্য হয় না। সকাল দশটায় প্রচ্ছদেরা পৌঁছে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের জাদুঘরে। তারপর পাঁচ টাকা করে টিকিট কেটে তারা ঢুকে যায় ভেতরে। ভেতরে ঢুকেই সবাই কেমন জানি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ অবাক দাঁড়িয়ে দেখে। আহা! এই সেই বাড়ি!
বাড়ির সামনে একটা উঠোন, উঠোনে বাগান। তিনতলা বাড়ির পুরোটাই জাদুঘর। পাশের বড় বিল্ডিংটাতেও জাদুঘর বানানো হয়েছে। নিচতলায় সব ছবি। বঙ্গবন্ধু কখন কোথায় গিয়েছিলেন, কী ভাষণ দিয়েছিলেন সব। একটা টেলিভিশনে বাজানো হচ্ছে ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর পাঠকক্ষও আছে নিচে। সমৃদ্ধ সব বই। বঙ্গবন্ধু এখানে পাঠ নিতেন আর চিন্তায় শান দিতেন। দোতলায় উঠে প্রচ্ছদ দেখতে পায় বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর, বড় মেয়ে শেখ হাসিনার ঘর। অবশ্য তাঁর ঘরটা বন্ধ ছিল। সেই বেদনাভারানত সিঁড়িটাও দেখতে পায়। সিড়িটার যে স্থানে বঙ্গবন্ধু পড়েছিলেন রক্তমাখা হয়ে, তাকে গ্লাস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে আর তাতে ছিটানো আছে গোলাপের পাপড়ি। একটা বাংলাদেশের পতাকার প্রতিকৃতি ঝোলানো হয়েছে দেয়ালে। সিঁড়িটা দেখে কান্না পেলো প্রচ্ছদের। আহা! কী কষ্টই না বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন! মনে মনে সেইসব মানুষরূপী জানোয়ারদের মুখে সে থুথু মারলো কয়েক দলা। তিনতলায় গিয়ে দেখতে পেলো শেখ কামালের কক্ষ। অনেক বড় কক্ষ। তাতে তানপুরা সাজানো। শেখ কামাল তানপুরা বাজাতে পারতেন। তিনি ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনতলার ওপর থেকে দেখা যায় রাসেলের পায়রার খোপগুলো। নিচে নেমে দেখা গেল বেগম মুজিবের রান্নাঘর। অত্যন্ত সাদামাটা মানুষ ছিলেন তিনি। মমতাময়ী। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর পাইপ, মুজিবকোট, লুঙ্গি, চশমা সবই সাজানো আছে ইতিহাসের কথক হয়ে।
দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল দুই ঘন্টা। প্রচ্ছদের মনে হলো এ যেন বাংলাদেশের হৃদয়। একসময় ডাক পড়ল শ্যুটিংয়ের। বঙ্গবন্ধুর বাড়িকে পশ্চাৎপটে রেখে শুরু হলো শ্যুটিং। একটানে ওকে হয়ে গেল প্রচ্ছদদের রেকর্ডিং। রেকর্ডিং শেষে ছবি তোলার হিড়িক। জাদুঘরে ছবি তোলা যায় না। তাই বাইরেই ছবি তুলে স্মৃতি ধরে রাখলো সবাই। ফিরতি পথে প্রচ্ছদ তার দেখা জাদুঘরের পুরো বিষয়টিকে মনের ক্যামেরায় রি-উয়িন্ড করে আবারো ঝালিয়ে নিলো। তার মুখে কেবল সে আওড়াতে লাগলো,
'যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা
গৌরি-মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।'