প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
শিশুর নিরাপত্তাহীনতা যে বর্তমান বাংলাদেশের শিশুর সঠিক বিকাশে একটি বড় বাধা, তা কারোরই অজানা নয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিবরণে জানা যায়, ২০১১ সালের ২০ মে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় একটি মোবাইল কেনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বামী মোস্তফা ও স্ত্রী রোজিনার মধ্যে ঝগড়া হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোজিনার স্বামী মোস্তফা তার পাঁচ মাস বয়সী শিশুপুত্র আশিককে আছড়িয়ে হত্যা করে। বর্তমানে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে এবং দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সবই আমাদের মানসিক বৈকল্য আর অসুস্থতার প্রকাশ। হতাশার এ চিত্র বিশ্বসহ দেশের সমাজ দেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আজকাল পত্র-পত্রিকা খুললেই অনেক বর্বরোচিত ঘটনা চোখে পড়ে। নিষ্পাপ শিশুগুলো ঘুমের মাঝে অথবা নিজেদের অজান্তেই বিষক্রিয়ায় প্রাণ দিচ্ছে। নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়, শঙ্কিত সকলে। নিজের সন্তানকে যারা হত্যা করে, তারা আর যাই হোক বাবা-মা হতে পারে না। অসভ্যতার চরম সীমা যারা অতিক্রম করে তারা সমাজের শত্রু, তাদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। সভ্যতার উন্নয়নে মানুষ যখন বিশ্বকে আলোকিত করছে, সেক্ষেত্রে অসভ্য কিছু মানুষের কারণে মানবতা কলুষিত হতে পারে না।
শিশুরাই জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশ সংবিধানে শিশুসহ সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত রয়েছে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির জন্যে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে। সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্যে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় ‘শিশু আইন, ১৯৭৪’, যা যুগোপযোগী করার মাধ্যমে ‘শিশু আইন, ২০১১’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯’-এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
যে কোনো অবস্থায় আমাদের শিশুদের জন্যে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্র, শরণার্থী শিবির, উত্তাল সমুদ্র এমনকি সব স্থানেই যেনো শিশুরা আজ চরম সংকটে। বিশ্বব্যাপী শিশুর প্রতি সহিংসতার পাশাপাশি যোগ হয়েছে করোনা মহামারি পরিস্থিতি। কোভিড-১৯ সংক্রমণে অসহায় ধনী-দরিদ্র, শিশু-বৃদ্ধ সবাই। এ কঠিন পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষ যত্নবান হতে হবে। শিশুর উন্নয়ন ও সুরক্ষায় সবাইকে সর্বোচ্চ সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। শিশুর জন্যে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, আজকের শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের আগামীর পৃথিবী। শিশুরাই ওড়াবে আগামী দিনের ঘুড়ি। সুরক্ষিত রাখবে দেশের পতাকা। শিশুদের জন্যে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল সফল হবে আমাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড। এজন্যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যার যার অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যে।
বঙ্গবন্ধু শিশুদের জন্যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। শিশু বিকাশকেন্দ্র, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, শিশুর প্রারম্ভিক মেধা বিকাশ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের যথাযথ বিকাশের জন্যে নেয়া এই বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো আজ সেই স্বপ্নকে পূরণে কাজ করে। গত ১০ বছরে শিশুর উন্নয়ন ও সুরক্ষায় শিশু নীতি ২০১১, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন-২০১৮-এর মতো যুগান্তকারী আইন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরই মধ্যে শিশু নির্যাতন রোধে অত্যন্ত সোচ্চার এবং অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশু নির্যাতন ঠেকাতে সরকারের আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা এবং ব্যক্তির সদিচ্ছা। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে মানুষের মানবিক গুণাবলি লোপ পাচ্ছে। মানবিক গুণাবলিসহ ধর্মীয় চর্চাও প্রয়োজন। মানবিকতা চর্চার বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সদিচ্ছা, সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতায় আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই গড়ে তুলবে সম্ভবনাময় নতুন এক পৃথিবী। তার আগে আমাদের শিশুরা থাকুক দুধে-ভাতে সুরক্ষিত এক সমাজ ও পৃথিবীতে। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
মোহতাসিনা তানি : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, এনসিটিএফ চাঁদপুর।