প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২২, ০০:০০
গল্পটা আমার নিজের নয়। নানীর মুখে শোনা। আমার নানী হলেন গল্পের ডিপো। বানিয়ে বানিয়ে তিনি কতো হাজার যে গল্প বলতে পারেন! নানীর চোখের অপারেশন হবে বলে সেবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন গ্রাম থেকে। আমাদের শহরে যে চক্ষু হাসপাতাল আছে সেটাতে চোখের ছানির অপারেশন খুব ভালো হয়। কিন্তু নানীর ছিলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস যদি বেড়ে যায় তবে অপারেশন করা যায় না। নানীর ডায়াবেটিস নাকি একটু বাড়তি। তাই কয়েকটা দিন পরেই নানীর চোখের ছানির অপারেশন হবে। সেজন্যে নানী আরো কয়েকটা দিন আমাদের বাসায় থাকতে হচ্ছে। এ নিয়ে আমাদের দু ভায়ের আনন্দ আরো বেড়ে গেছে।
একদিন বৃষ্টি পড়ছিলো বাইরে। ঝমাঝম বৃষ্টি। একেবারে বান ডাকা বৃষ্টি যাকে বলে সে রকম। আমাদের খেলতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বৃষ্টির কারণে। কিন্তু সময় কাটছিলো না কিছুতেই। আমাদের মন খারাপ দেখে নানী ডেকে বসালেন তাঁর পাশে। তারপর বললেন, আসো ভায়েরা, তোমাদের আজ রূপোর টাকার গল্প শোনাই। আমরা তো রূপোর টাকার কথা শুনে বেজায় অবাক। বলে কী নানী! রূপোর আবার টাকা হয় নাকি? আমরা তো কাগজের নোট আর ব্রোঞ্জের মুদ্রার কথা জানি। নানী বললেন, হয় রে নাতি হয়। রূপোরও টাকা হয়। তবে এ টাকা চালু ছিলো রাজ-রাজড়াদের আমলে। তখন কোনো কোনো রাজ্যে সোনার টাকাওবছিলো। নানী আমাদের কৌতূহল দমন করে গল্প বলতে শুরু করলেন।
নানীর যিনি নানী ছিলেন তিনি ছিলেন নাকি জমিদারের বৌ। তাদের বাড়িতে লোকজন আর ধন-সম্পদের বাড়াবাড়ি ছিলো। নানীর নানী ছিলেন সাধারণ ঘরের মানুষ। তবে দেখতে খুব সুন্দরী। একারণেই জমিদারের বাড়িতে তার বিয়ে হয়েছিলো। নানীর কথার মাঝখানে আমি বলে উঠলাম, নানী শুনেছি জমিদাররা নাকি অনেক অত্যাচারী হয়? নানী বললেন, এ কথা কার কাছ থেকে শুনলা ভাই? আমি বললাম, আমাদের বইতে এ রকম এক অত্যাচারী জমিদারের কথা লেখা আছে। নানী বললেন, সব জমিদার অত্যাচারী ছিলো না ভাই। কেউ কেউ এতো ভালো ছিলো যে প্রজারা জমিদারের মৃত্যুতে কেঁদেছেও। কোনো কোনো জমিদার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যে নিজেদের জায়গা-জমি দান করে নিজের টাকায় স্কুল-কলেজ করে দিয়েছে। কেউ কেউ গরিবের বন্ধু হিসেবে বড় বড় পুকুর-দিঘিও খনন করেছে যাতে প্রজারা জল পায়। জমিদারের ইতিহাস যারা লেখেন তাদের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে ইতিহাসের সত্যতা। কেউ কেউ নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাস লেখে। এজন্যে তাদের চোখে জমিদাররা সবসময় খারাপ হয়ে ফুটেছে। আসলে সব জমিদার অত্যাচারী ছিলো না। কেউ কেউ প্রজাবৎসলও ছিলো। আমরা যে জমিদারদের কথা বলছি তারা অত্যন্ত প্রজাবান্ধব জমিদার ছিলো। সেই জমিদারের মা নববধূ আয়না বানুকে অনেক পদের সোনার গহনা দিয়ে বরণ করে নিলেন। নানীর নানী আয়না বানু নাকি জমিদারের বাড়িতে পা দিয়েই অবাক। কত্তোবড় ঘর! হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়া! বাড়ির এক একটা থাম কত্তোবড়! আয়না বানুর দুই চোখ এমন পরিষ্কার টলটলে যেনো আয়না। আয়না বানুর বয়স যখন বার তখন তার বিয়ে হয়। বিয়েতে এলাহী কা-। কত হাজার হাজার লোকের যে দাওয়াত ছিলো তা হাতে গোণা যায় না। যে গাঁয়ে আয়না বানুর বিয়ে হয়েছিলো সে গাঁয়ের নাম ছিলো হীরাখালি। হীরাখালির বিলেঝিলে এক রকম মাছ পাওয়া যায়। মাছের রঙ হীরার মতো ঝকমকে। তাই গাঁয়ের নাম হীরাখালি। হীরাখালির জমিদারের নাম মোতি খাঁ। মোতি খাঁ এর ছেলের নাম হলো মানিক মিয়া। এই মানিক মিয়ার সাথে বিয়ে হয় আয়না বানুর। আয়না বানুর বাপের বাড়ি ধানগোলা। বাপের নাম বরুমিয়া। তিনি একজন অবস্থাপন্ন কৃষক। বড়ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে ভড়কে গিয়েছিলো বরু মিয়া। কিন্তু জমিদারপুত্র মানিক মিয়া বরু মিয়াকে বাঁচাতে নিজেই বিয়ের সব খরচ বহন করে।
বড় লোকের বিয়ে মানেই এলাহী কারবার। বাবুর্চি আনা হলো দিল্লি থেকে। শাহীখানা বাঙালি বাবুর্চিরা পাকাতে পারে না। বিয়েতে কত রকমের যে জর্দা রান্না হলো তার কোনো হিসেব নেই। জর্দা খেতে খেতেই অনেকে পোলাও-বিরিয়ানি খেতে পারে না। পেটের জায়গা সব দখল হয়ে যায়। বিয়ের পরের দিন আয়না বানুর বৌভাত। মানিক মিয়ার যতো আত্মীয় ছিলো সবাই এলো বৌভাত খেতে। আয়না বানু বৌভাতে অনেক দামি দামি গয়না উপহার পেলো। এতো গয়নার ভর সে সহ্য করতে রীতিমত কষ্টহলো। মুরুব্বিরা একে একে আয়না বানুর মুখ দেখে দোয়া দিয়ে তারপর উপহারটা হাতে তুলে দেয়। আয়না বানু উপহারে যা গয়না পেলো অত গয়না সে এ জীবনে দেখেনি।
আয়না বানুর এক দাদী শাশুড়ি আছে দূর সম্পর্কের। তার নাম হলো রূপবানু। তিনি এসে নতুন বৌয়ের মুখ দেখে রূপোর দুটো টাকা দিলেন। এই রূপোর টাকা দুটি রূপবানুকে তার দাদী শাশুড়ি দিয়েছিলেন। রূপোর টাকা দুটি নিয়ে কিংবদন্তি চালু আছে। আয়না বানুর দাদী শাশুড়ির দাদী শাশুড়ি নাকি রূপোর টাকার মটকা পেয়েছিলেন যক্ষের কাছ থেকে। যক্ষ হলো তারা যারা গুপ্তধন পাহারা দেয়। যক্ষ নাকি তাকে স্বপ্ন দেখাতেন প্রতিদিন, আয় তোকে রূপোর টাকার মটকা দেবো। আয় তোকে রূপোর টাকার মটকা দেবো। আয়না বানুর দাদী শাশুড়ির দাদী শাশুড়ি ছিলেন শক্ত মনের মহিলা। তিনি দীর্ঘদিন এই লোভ সামলে ছিলেন। সত্যিকার অর্থেই রূপোর টাকার প্রতি তাঁর কোনো লোভ ছিলো না। কিন্তু একদিন তাঁর সামনে বাস্তবেই এক মটকা রূপোর টাকা এসে উপস্থিত। তিনি সে সময় দরজা বন্ধ করে ঘরে শুয়েছিলেন দুপুরের আহার করে। তাকে একা পেয়ে যক্ষ সে সুযোগকে কাজে লাগালো। রূপোর টাকার মটকাটি নাকি রূপবানুর দাদী শাশুড়ির সামনে নাচতে শুরু করলো। রাগে রূপবানুর দাদী শাশুড়ি হাত দিয়ে মটকাটি সরাতে যেতেই তার হাতে রূপোর টাকাগুলো লেগে গেলো। ব্যস্, যক্ষ তাতেই বলে উঠলো, ঠিক আছে, তুই টাকা নিতে সম্মত হয়েছিস্। এ রকম আরও সাত মটকা রূপোর টাকা তোর কাছে আজ রাতে আসবে। তুই তা কাউকে বলবি না। এই টাকা তুই না চাইলে কেউ নিয়ে খরচ করতে পারবে না। এই টাকায় তোর পরিবারে সৌভাগ্য আসবে। বিনিময়ে তোর একটা ছেলেকে আমার চাই। রূপবানুর দাদীশাশুড়ি সেই যে রাগ করে রূপোর টাকার মটকায় হাত দিলো, তার পরিণামে তারই ছোট ছেলেটা সামনের পুকুরে পড়ে তলিয়ে গেলো। এরপর সাত সাতটি মটকা ভরা রূপোর টাকা পেয়ে রূপবানুর দাদী শাশুড়ি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। সেই থেকে তাদের বংশে রূপোর টাকায় সৌভাগ্য আসে। কিন্তু রূপবানুর দাদী শাশুড়ি চিরতরে পাগল হয়ে যায়।
বৌভাতের ডামাডোলে এদিক ওদিক করতে করতে একসময় রূপোর টাকা দুটি যে কে মেরে দিলো তা বুঝতেই পারলো না আয়না বানু। এখানে সেখানে আড়েঠারে অনেক জায়গায় দেখলো সে। কিন্তু কোথাও পেলোনা। রূপোর টাকা দুটি হারিয়ে আয়না বানুর একটু মন খারাপ হলো। গুরুজনের দোয়া বলে কথা। আয়না বানুর মা সব সময় বলতো, সোনাচাঁদি হারানো নাকি অশুভ লক্ষ্মণ। তাই আয়না বানুর মনে কু ডেকে যাচ্ছিল। তবু সে কাউকে তা বললো না। রূপোর টাকা দুটি সে এক ঝলক দেখেছিলো চোখে। খুব সুন্দর একটা পদ্মফুল তাতেআঁকানো। আর আছে বাদশাহর মোহর। মনে হয় যেন চাঁদের আলো গলে রূপোর টাকায় পড়েছে। এই টাকা দুটি ভিড়ের মধ্যে যে কে হাপিশ করে দিলো তা খুঁজেই পেলো না আয়না বানু। রাতে সে তার স্বামী মানিক মিয়াকে এ কথা খুলে বললো। মানিক মিয়া শুনতে পেয়ে তল্লাশী চালালো ঘরের দাস-দাসীদের মধ্যে। কিন্তু কারো কাছে ঐ টাকা দুটি পাওয়া গেল না। মন খারাপ করে ঘুমুতে গেল আয়না বানু।
আয়না বানুর স্বামীর বাড়িতে আছে মধুমালা নামের এক দাসী। এই দাসীর অভ্যাস খুব খারাপ। সে খুব দ্রুত হাত সাফাইয়ের কাজে অভ্যস্থ। সে জমিদার গিন্নীর অনেক গহনাই হাপিশ করে দিয়েছে এযাবৎ। এখনো ধরা পড়েনি। ধরা পড়াতো দূরে থাক,কেউ তাকে সন্দেহ তক করেনি। মধুমালার হাত সাফাইয়ের কাজ এমনই অবিশ্বাস্য। বৌভাতের গোলমালে যখন সবাই ব্যস্ত,তখন মধুমালা অতি সন্তর্পণে রূপোর টাকা দুটো নিজের হাতে নিয়ে নিল। টাকা দুটো নিয়ে সে আর ঐ তল্লাটে রইল না। সে চলে এলো মানিক মিয়ার মায়ের খাস কামরায় যেখানে সে এতোদিন ধরে কাজ করে আসছিল। মধুমালা জমিদার গিন্নীর রুচি বুঝতে পারতো। তাই অতি দ্রুতই সে জমিদার গিন্নীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল। রূপোর টাকা দুটো নিয়ে মধুমালা তার ট্রাংকে রেখে দিলো অলক্ষ্যে।
রাতে জমিদার মহল ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। কেবল শোনা যায় হাওয়ার শন শনানি। এমন একটা পরিবেশে একটা পিন পড়লেও মনে হচ্ছে তার শব্দ বিবর্ধিত হয়ে শোনা যাবে। এমন সময় ধীরে ধীরে একটা শব্দ আয়না বানুর কানে এসে পৌঁছায়। আয়না বানু বিছানায় উঠে বসে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে কীসের শব্দ। শব্দটা ক্রমশ: ঢাকের বাজনাতে রূপান্তরিত হয়ে উঠল। তারপর আওয়াজের তীব্রতায় ঘরে থাকাই দায়। দৌড়াতে দৌড়াতে দাসী মধুমালা এসে আয়না মতির পায়ের উপর পড়লো। রানিমা আমাকে ক্ষমা করুন- বলতে বলতে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। এতক্ষণে সবাই বুঝল ব্যাপারটা কী। মধুমালা যে রূপোর টাকা চুরি করেছিল তা হজম করতে পারেনি। টাকা নিজেই ঢাক পিটিয়ে জানান দিল চোর কে। টাকা দুটো চুরি করে মধুমালা কাঁসার থালায় রেখে সিন্দুকে বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু সিন্দুকের ভেতরে রূপোর টাকা দুটো ঢাকের কাঠির মতো বাজাতে শুরু করে কাঁসার থালাকে। ফলে মধুমালা আর টাকা দুটো রাখতে পারেনি নিজের কাছে। যক্ষের রূপোর টাকায় আয়না বানু হয়ে উঠলো সৌভাগ্যবতী।