প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আমাদের গাঁয়ের নাম সিংহপুর। গাঁয়ের পাশ দিয়ে একটা পাহাড়ি নদী কুলুকুলু কলরবে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। নদীটির বুকে শান্ত জলের প্রবাহে জেগে ওঠে অপার শান্তি। নদীর সাথে গাঁয়ের মানুষের সম্পর্ক অতি নিবিড়। আমাদের গাঁয়ের মানুষেরা নদীতে মাছ ধরে, নৌকা বায় আর নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ফসল ফলায়। নদীতে ইঞ্জিনের নৌকা চলে সারাদিন। যখন ইঞ্জিনের নৌকা ছিলো না তখন কিন্তু নদীর পাড় ভাঙেনি। যেদিন হতে যন্ত্রের নৌকা শব্দ করে নদীর বুকে চলাচল শুরু করলো সেদিন হতেই নদীর পাড় ভাঙতে শুরু করে। যন্ত্রের নৌকায় যাতায়াত সহজ হলেও গ্রামবাসীর কপাল পোড়া শুরু হলো পাড় ভেঙে। কিন্তু এই সহজ সত্যটা কারো মাথায় আসলো না। কেউ যন্ত্রের নৌযান বন্ধ করে গ্রাম রক্ষায় এগিয়ে এলো না। সবাই চায় যন্ত্রের নৌকায় চড়ে প্রতিদিন ভোরে শহরে চাকরিতে যেতে কিন্তু গ্রামের টিকে থাকার আশা যে বিলীন হচ্ছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই। অথচ কিছুদিন আগেই নদীর গর্ভে মিশে গেছে অনিল দাদুদের বিরাট সুপারি বাগান। গ্রামে তেমন কোনো বন নেই। আছে ছিটেফোঁটা জঙ্গল। গ্রামের নাম কেনো সিংহপুর হলো তা নিয়ে আমার প্রশ্নের শেষ নেই। কারণ যে গাঁয়ে গহীন অরণ্য নেই সে গাঁয়ে সিংহের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। বাংলাদেশে তো এমনিতেই সিংহ কোথাও পাওয়া যায় না। তাহলে এখানে সিংহ এলো কোত্থেকে? যদিও এই গাঁয়ে দু-একজন লোক আছে যাদের পদবী সিংহ। কিন্তু তাদের জন্যে সিংহপুর হওয়ার কথা নয়। এ গাঁয়ে অধিকাংশ মানুষের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমার মাথাব্যথা দেখে দাদু একদিন গলাখাকারি দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। দাদু বললেন, কী দাদুভাই, মায়ের কাছে শুনলাম, তুমি নাকি আমাদের গাঁয়ের নামের ইতিহাস জানতে চাইছো? আমি বললাম, হ্যাঁ দাদু। এখানে কোন সিংহ নেই, তবু কেনো এ গাঁয়ের নাম সিংহপুর? আমার কথা শুনে দাদু দিলেন হেসে। বললেন, শোন তবে। বৃটিশ আমলে এ গাঁয়ের লোকদের ওপর গোরারা অনেক অত্যাচার করতো। তারা জোর করে এখানকার কৃষকদের ধানচাষ বাদ দিয়ে নীলচাষ করাতো। একদিন এ গাঁয়ের কিছু তরুণ কৃষক গোরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। তারা লাঙল-জোয়াল নিয়ে বৃটিশ নীলকরদের ঠেকিয়ে দিলো। সেই থেকে বৃটিশরা আর এ গাঁয়ে নীলচাষে কাউকে বাধ্য করতে পারেনি। ঐ তরুণদের সিংহের মতো গর্জনে বৃটিশরা গুটিয়ে গেছে বলেই সেদিন হতে এ গাঁয়ের নাম হয়েছে সিংহপুর। এখানে সত্যিকারের বুনোসিংহ না থাকলেও নরসিংহ ছিলো যাদের সাহস ছিলো অতুলনীয়। আর এ জন্যেই এ গাঁয়ের নাম হলো সিংহপুর। তার আগে এ গ্রামকে সবাই চালতাতলী নামেই ডাকতো। কারণ এখানে চালতা গাছের সংখ্যা তখন বেশি ছিলো। এখন অবশ্য কমে গেছে।
দাদুর কাছে গ্রামের নামের অর্থ জানার পর আমার আরো কিছু শুনতে মন চাইল। বুঝতে পারলাম, দাদু আসলে অনেক ইতিহাস জানেন। মাঝে মাঝে দাদু আমাকে ইংরেজি পড়ান। তিনি একসময় মাস্টার ছিলেন হাইস্কুলে। এখন বয়স হয়েছে। লাঠি ছাড়া খুব বেশিদূর চলতে পারেন না। অবশ্য আমি যখন দাদুর সাথে হাঁটি তখন অনেকেই আমাকে দাদুর লাঠি বলে। কেউ কেউ আবার শ্লোক কাটে, পুতের নাতি হাতের লাঠি, মেয়ের নাতি মাথার ছাতি। শ্লোকটা শুনে আমার কেন জানি খুব ভালো লেগে যায়। বয়সের সাথে সাথে দাদুকে অনেক রোগব্যাধিতে পেয়ে বসেছে। দাদুর রোগের মধ্যে শ্বাসকষ্টটাই বেশি। এজন্যে একটানা অনেকক্ষণ তিনি কথা বলতে পারেন না।তবে যখন শরীর ভালো থাকে তখন অনেক গল্প করেন। আমি এরকম একদিন দাদুকে বললাম দাদু, এ গ্রামে ওই যে একটা মাথা নোয়ানো চূড়াঅলা মন্দির আছে সেটার কী ইতিহাস? দাদু বললেন, কোন মন্দিরটার কথা বলছো? বললাম, ওই যে পূর্বদিকে মাঠের পাশে যে উঁচু সাততলা মন্দিরটা, যেটা ঘাড় বাঁকানো, সেটার কথা বলছি। দাদু বললেন, ওহ্! তাই বলো। সে এক বিরাট ইতিহাস দাদুভাই। আজ হতে দুশো বছর আগে এ গাঁয়ে এক জমিদার ছিল। জমিদারের নাম ছিল রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী। ছয় ফুট লম্বা আর টকটকে ফর্সা। রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর বাবাও ছিলেন জমিদার। এলাকায় তিনি বেশ কয়েকটা স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীও খারাপ লোক নন। তিনিও প্রজাহিতৈষী ছিলেন। তবে তার মা ছিলেন খুব নীতিপরায়ণ। কোন অসৎ উপায়ে উপার্জিত টাকায় তিনি অন্নগ্রহণ করতেন না। তাঁর ভয়ে তাই বাপ আর ছেলে জমিদার কোন খারাপ কাজ করতো না। রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন খুব মা-বাবার ভক্ত। প্রতিদিন মা-বাবার খবরাখবর নিয়ে তারপর তিনি আহার গ্রহণ করতেন। প্রতিদিন মায়ের চরণধোয়া জলপান করে তিনি তার জমিদারি শুরু করতেন। তার বিচার-আচারে কেউ কখনো অসন্তুষ্ট হতো না।
কিন্তু সুদিন কখনো একটানা যায় না। নিয়তি সুদিনের সময়কে খুবই সাময়িক করে রাখে। ফলে সুদিনের ফাঁকে কষ্টের দিনও এসে ভিড় করে জীবনে। একদিন জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর বাবা মারা গেলেন। শোকে মুহ্যমান হয়ে রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পিতার মরদেহের সৎকার করলেন। সবাই তার আয়োজনে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। কিন্তু তার মা ছিলেন অতি সতী-সাধ্বী মহিলা। তিনি এই বিয়োগব্যথা সইতে পারলেন না। ফাগুন মাসের পূর্ণিমায় একদিন তিনিও দেহান্তরী হলেন। পর পর বাবা-মা এর মৃত্যুতে রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী মুষড়ে পড়লেন। তার এই বাবা-মার প্রতি ভক্তি ও কষ্ট দেখে তার গুরুঠাকুর তাকে বাবা-মা এর নামে একটা মন্দির বানানোর পরামর্শ দিলেন। জমিদার রাজেন্দ্র রায় এর এই পরামর্শ খুব মনে ধরল। তিনি মহাসমারোহে বাবা-মায়ের স্মরণে মন্দির বানাতে শুরু করলেন। প্রায় বছরখানেক ধরে মন্দিরটির নির্মাণকাজ চললো। দেশ-বিদেশের মার্বেলপাথর দিয়ে মন্দিরটির শোভাবর্ধন সম্পন্ন হলো। প্রায় সাততলা উঁচু মন্দিরটি অনেক দূরহতে চোখে পড়ে। মন্দিরের চূড়ায় লাগানো হলো স্বর্ণের মুকুট। প্রায় দশকেজি স্বর্ণ দিয়ে মুকুটটি বানানো হয়েছে। মুকুটের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে হীরের পাথর। একবার কেউ দেখলে সবারই মন কাড়ে মন্দিরটির সৌন্দর্য। মন্দিরটি বানাতে গিয়ে রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী নিজের সর্বান্তঃকরণ ঢেলে দিলেন। নির্মাণশিল্পীকে তিনি যথেষ্ঠ পারিশ্রমিক আর উপঢৌকন দিয়ে তিনি কথা আদায় করে নিলেন, এরকম মন্দির ঐ নির্মাণশিল্পী আর কারও জন্য বানাবেন না।
গুরুঠাকুরকে ডেকে জমিদারমশাই একদিন বললেন, ঠাকুর, বাবা-মায়ের এই স্মৃতিমন্দিরটি এবার উদ্বোধন করতে হয়। আপনি দিন দেখুন। জমিদারের কথা মোতাবেক গুরুঠাকুর ভালো একটি দিন নির্বাচন করলেন। নির্ধারিত দিনের জন্যে তিনি আশেপাশের সকল গ্রামের জমিদারদের নেমতন্ন করতে লোক পাঠালেন। সাথে একশ সোনার মোহরও পাঠালেন যাতে জমিদাররা তার নেমনতন্ন ফিরিয়ে না দেন। গ্রামের সকল প্রজার তিনদিন ধরে জমিদারবাড়িতে নেমনতন্নের পাত পড়লো। সে এক হই হই রই রই ব্যাপার। কত খাবারের যে ছড়াছড়ি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কত পদের মিষ্টি আর কত পদের ডাল যে রান্না হলো! মানুষ খায় আর জমিদারের নামে জয়ধ্বনি দেয়। আশেপাশের গ্রামের জমিদারদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা। তাদের জন্যে মাছ-মাংসের কোন শেষ নেই। তিনদিনের উৎসব শেষে মন্দিরের উদ্বোধন। শহর থেকে বাজনাদাররা বিশাল বহর নিয়ে উপস্থিত। আতশবাজির বহরও খুব ধূমধামের সাথে এলো। সারাগ্রাম মেতে উঠলো আনন্দযজ্ঞে। কীর্তনীয়া দল এলো দূরের গ্রাম থেকে। এই দলটিই হলো এ তল্লাটের সেরা কীর্তনীয়া দল। দলের যিনি প্রধান তিনি রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর বাবার আমলেও কীর্তন করে গেছেন। কীর্তন করতে করতে তিনি এমন নিবিষ্ট হয়ে যান যেন মনে হয় এ বুঝি সমাধিস্থ হয়ে গেলো। যে বার তিনি রাজেন্দ্র রায়ের বাবার সময়ে এসেছিলেন, সেবার তিনি অনেক টাকার মালা পেয়েছিলেন গলায়।
উৎসবের তৃতীয় দিন দুপুরে মন্দিরের উদ্বোধন হবে। দুটি শ্বেতপাথরের ফলকের ওপর রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর বাবা আর মায়ের নাম খোদাই করা হোল। তারপর সোনালি কাপড়ের কুচিকরা টুকরো দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো ফলক দুটি যাতে টানলেই নামগুলো উন্মোচিত হয়। বিশাল একটা শামিয়ানা টানানো হলো সভাস্থলে। হাজার হাজার দূরাগত অতিথি নিয়ে শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। আশপাশের জমিদাররা সবাই একে একে বক্তব্য দিলেন। সবার বক্তব্যে জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর পিতা ও মাতার প্রতি ভক্তিকে প্রশংসা করা হলো। সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো, এ যুগে এমন পুত্র পাওয়া ভার। রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর বাবা-মা সত্যিই ভাগ্যবান এবং ভাগ্যবতী। কারণ তাদের ছেলে তাদের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করেছে তা জগতে বিরল। সকলের বক্তব্যের পর এলো জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর বক্তব্যের পালা। তিনি আগে পরম শ্রদ্ধায় প্রণাম করলেন মন্দিরের সামনে আভূমিনত হয়ে। তারপর ফলকের কাপড় টেনে বাবা-মায়ের নাম উন্মোচন করলেন। সবাই হাততালি দিয়ে উদ্বোধন কার্যকে স্বাগত জানাল এবং অনুমোদন করলো। শাঁখ ও বাদ্য বেজে উঠলো নিনাদে। এবার বক্তব্যের পালা। জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী তার বক্তব্যে ¯্রষ্টা ও তার মাতাপিতার গুণগান গাইলেন এবং গ্রামবাসী ও আশেপাশের সকল জমিদারের প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতা জানালেন। সবাই উল্লসিত হয়ে হাতেতালি দিয়ে উঠলো। এতটুকু বলবার পর দেখলাম দাদু হাঁপিয়ে উঠেছেন। তারপর একটু বিরাম নিয়ে একঢোকে একগ্লাস পানি খেলেন। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন আবারো, বুঝলে দাদুভাই। মা-বাবার ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। তুমি যতই বাবা-মায়ের সেবা করো, তবুও কোনদিন কেউ বাবা-মায়ের ঋণ শোধ করতে পারে না। এমনকি তুমি যদি তোমার এককাঁধে বাবা আর অন্য কাঁধে মাকে নিয়ে হাজার বছরও তাদের সেবা করো তবুও তাদের ঋণ শোধ করা যায় না। কিন্তু জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী আবেগের চোটে তার কথার লাগাম ধরে রাখতে পারেনি। তিনি তার বক্তব্যের শেষাংশে বললেন, আমার প্রিয় প্রজাসকল, আজ আমি তৃপ্ত, আজ আমি সন্তুষ্ট। আমার চেয়ে খুশি আজ পৃথিবীতে কেউই নেই। আজ এই সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করে আমি আমার মাতাপিতার প্রতি আমার সকল ঋণ শোধ করলাম। জমিদার একথা বলে থামতে না থামতেই ভিড়ের মধ্যে শোরগোল শুরু হলো। একটা বিকট আওয়াজে সবার মনের শান্তি ভেঙে গেল। চোখ তুলে সবাই দেখতে পেলো সদ্য নির্মিত মন্দিরের চূড়ারশীর্ষ বেঁকে গেছে। যেন এইমাত্র কেউ জোর করে তা মুচড়ে দিয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে সবাই করজোড়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো মন্দিরের দিকে। আর জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রুর ¯্রােত বইতে শুরু করলো। সেই থেকে আজ দুশো বছর পার হলো, মন্দিরের চূড়াটি অর্ধেক বাঁকানো।