প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
বশির হোসেন একজন স্কুল মাস্টার। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেন। তাঁর পড়ানোর স্টাইল খুব সুন্দর। যে কোনো বিষয়কে তিনি বুঝিয়ে খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। তিনি ক্লাস নিলে সেদিন আর কাউকে বাসায় গিয়ে পড়তে হয় না। এজন্যে ছাত্র-ছাত্রীদের মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা অসীম। কিন্তু গ্রামে তিনি তাঁর এই পাঠদক্ষতার জন্যে নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে সর্বমহলে পরিচিত। এক নামে কিংবা এক খেতাবেই সবাই ডাকে চেনে। তাঁর সামনেই মানুষ তাঁকে ডাকে দাওয়াতপ্রেমি বশির নামে। তিনি দাওয়াত খাওয়াতে নয়, দাওয়াত খেতে পছন্দ করতেন। তবে খালি হাতে তিনি দাওয়াত খেতে যেতেন না। কোন না কেন উপহার নিয়ে যেতেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি কোন না কোন দাওয়াত খেতে যেতেন। আশপাশের তো বটেই, দূর-দূরান্তের মানুষও তাঁকে দাওয়াত দিয়ে যেতো। তিনি চেনা মহল ছাপিয়ে অচেনা মানুষের দাওয়াতও কবুল করতেন। কে কখন দাওয়াত দিয়ে যায়, এজন্যে তিনি আগাম উপহার কিনে স্টক রাখতেন বাসায়। কমপক্ষে সাতদিনের দাওয়াত খাওয়ার উপহার তিনি কিনে রাখতেন অগ্রিম।
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি পড়ার ধরনে বোঝা যায়, বৃষ্টি যেনো নাছোড়বান্দা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ফারাক্কার বাঁধের মতো আকাশও যেনো তার বাঁধ খুলে দিয়েছে। কুকুর-বেড়াল লড়াই লাগলেও এ রকম হাউকাউ হয় না, যেমনটা সকাল থেকে একটানা বৃষ্টিতে হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে বৃষ্টি মানেই অত্যাচার। প্রথম প্রথম কিছুক্ষণ ভালো লাগে টিনের চালের সেতারের শব্দ শুনে। তারপর শুরু হয় বিরক্তি। বশির স্যারের সেদিন বিরক্তি ছিল বৃষ্টির জন্যে নয়, বরং দাওয়াত খেতে না যেতে পারার কারণে। এমন না যে তিনি বৃষ্টির কারণে তিনি দাওয়াতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বরং সেদিন তাঁর কোন দাওয়াতই ছিল না। তিনি যে দাওয়াতে গিয়ে খুব একটা কব্জি ডুবিয়ে খান তা নয়। বরং দাওয়াতে তিনি কমই খান। কোরমা-পোলাও কম খেয়ে তিনি ডেজার্টই বেশি খান।
বৃষ্টির ঘ্যানঘ্যানে শব্দে তিনি বসেছিলেন বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার পেতে। হাতে এককাপ রং-চা আর বাটিতে খানিকটা চালভাজা। যে বর্ষাকালে হাল্কা নোনা চালভাজা রং-চা দিয়ে খায়নি সে বুঝবে না সেটা কী অমৃত! সে বুঝবে না কী অসাধারণ জিনিস সে উপভোগ করতে পারলো না। কিন্তু পছন্দের চালভাজাও যেন তাঁর কাছে বিস্বাদ লাগছে। তিনি খাবেন কি রেখে দেবেন তা নিয়ে দোনোমনা ভাবতে ভাবতে এমন সময় এক অচেনা ভদ্রলোক হাতের কাঠের ডাঁটের কালো ছাতাটি গুটিয়ে দাওয়ায় রেখে বারান্দায় ঢুকল। একটু ধাতস্থ হয়েই সালাম দিয়ে পরিচয় দিলো। পরিচয়ে বোঝা গেলো, সে পাশের গ্রামের পরের গ্রামে থাকে। ঐ গ্রামের এক ব্রাহ্মণের ছেলের বিয়ে পাঁচদিন পর। তাঁর নেমতন্ন। বিয়ের লগ্ন রাত্রে বারোটায়। বশির মাস্টারের বরযাত্রী হিসেবে দাওয়াত। তার মানে রাত বারোটার পরে তাঁর খাবার জুটবে। বশির সাহেব তারিখ গুণে দেখলেন, ঐ দিন বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ পরদিন শুক্রবার। মানে স্কুল সাপ্তাহিক ছুটি। অতএব নো চিন্তা ডু ফুর্তি। ব্রাহ্মণদের বিয়েতে নিরামিষটা দারুণ রান্না হয়। অনেকদিন আগে বশির মাস্টার একটা বিয়ের দাওয়াত খেয়েছিলো শহরে। সেই স্বাদ এখনো যেন জিভে লেগে রয়েছে। সদ্যপ্রাপ্ত দাওয়াতটা সেই নিরামিষের স্বাদকেই মনে করিয়ে দিলো।
বশির সাহেবের বিরক্তিলাগা মনটা নূতন দাওয়াত পেয়ে ভালো হয়ে গেলো। তিনি বাড়ির অন্দরে ঢুকে স্টকে থাকা উপহারগুলোর মধ্যে ভালো দেখে একটা বেছে নিলেন। এটাই নিয়ে যাবেন। ভালোলাগায় তাঁর গলা দিয়ে বৃষ্টির গান বেরিয়ে এলো, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না কো মন...’। কিন্তু আনন্দের মধ্যেও খটকা লাগলো। যে নেমন্তন্ন দিতে এসেছিলো তাকে তিনি চেনেন না। কখনো কোথাও দেখেছেন বলে মনেও পড়ছে না। পরন্তু তার চোখের-মুখের অভিব্যক্তিও স্বাভাবিক ছিল না। এতো ঘোরতর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এলো অথচ একটুও ভিজলো না। হতে পারে ছাতা ছিলো। কিন্তু তাই বলে বৃষ্টির রুদ্রধারা একটুও গায়ে ভিজিয়ে দিবে না? যাক, অত ভেবে কাজ নেই। বিয়ের দাওয়াত খেতে পাওয়া নিয়েই কথা।
দেখতে দেখতেই নেমন্তন্নের দিন এসে গেলো। সন্ধ্যার আগে আগেই বশির সাহেব রওনা দিলেন বিবাহ বাসরে তথা বরের পিত্রালয়ে। সাদা পায়াজামা-পাঞ্জাবি আর সাথে ঘিয়ে রঙের একটা চাদর। ড্রেসআপ দেখে মনে হচ্ছে, সাক্ষাৎ বেয়াই বুঝি বিবাহের রীতিনীতি সম্পন্ন করতে এসেছেন। বিয়ের বরযাত্রীদের কাউকেই তিনি চেনেন না। তবে বরের সাজটা বেশ হয়েছে। মেয়ের বাবার দেয়া ধূতি-পাঞ্জাবীতে বরকে মানিয়েছে বেশ। সাতপাক ঘোরা হলো, সিঁদুরদান হলো। এবার বরযাত্রীর আপ্যায়নের পালা। খাওয়ার টেবিলে বসে বশির সাহেবের তো চক্ষু চড়কগাছ! প্রতিজনের জন্যে যে খাবারের থালা দেয়া হয়েছে তা অনেক বড় বড়। এ থালা মনে হয় ভীমের খাওয়ার থালা। যে খাবার দেয়া হয়েছে তা রীতিমতো পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে গেছে পাতে। এ খাবার সাধারণ মানুষের নয়। আশপাশের মানুষগুলো গিলছে গোগ্রাসে। বশির সাহেবও শুরু করলেন খেতে। কিন্তু তিনি খেয়েও এককণাও কমাতে পারলেন না তাঁর পাতের। বরং খাবার বুঝি আরো লোড করা হয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বশির সাহেবের বুকে ভয় লাগা শুরু হলো। বুঝলেন, তিনি অচেনার মেলায় এসে পড়েছেন। কীভাবে মুক্তি পাবেন এই মেলা থেকে তা বুঝতে পারছেন না। টেবিলে বসা অন্যরা তাঁকে জোর করছেন খেতে। বশির মাস্টার পাতে খাবার চটকাতে থাকেন। একসময় পাশের টেবিলে দেখতে পেলেন, তাঁর চাচা বসে আছেন। বশির সাহেব অবাক হলেন। তাঁর এই চাচা তো মারা গেছেন মাস ছয়েক আগে! ব্যাপারটা কী তা বুঝতে আর বাকি রইলো না বশির মাস্টারের। তিনি ভূতের মেলায় এসে পড়েছেন। তাঁর মাথা ঘুরতে শুরু করে। বশির মাস্টার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান টেবিলে রাখা খাবারের ওপর। পরদিন সকালে পাশের গ্রামের পরের গ্রামে পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ির নাট মন্দিরের মেঝেতে তাঁর মূর্ছা যাওয়া দেহখানি পাওয়া যায়।