বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:২৫

সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা ইসলাম কি হারাম করেছে?

মঞ্জুর বিন সুলতান
সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা ইসলাম কি হারাম করেছে?

এই বিষয়টা জানতে হলে প্রচলিত ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজদের মিথ্যা ফতোয়ার ওপর থেকে অন্ধ বিশ্বাসকে সরিয়ে ইসলামের মূল কেতাব কোরান এবং রাসুলের প্রকৃত হাদিস, পাশাপাশি নিজেদের আল্লাহর দেয়া বিচার-বুদ্ধি, যুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। রাসুলের নামে অগণিত মিথ্যা জাল হাদিস বাজারে চালু রয়েছে। সেগুলো সত্য কি মিথ্যা কীভাবে বুঝবেন? সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের একমাত্র মাধ্যম আল্লাহর কোরান, যার একটি আয়াতও আজ পর্যন্ত কেউ জাল করতে পারে নাই! পারবেও না।

হালাল ও হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি হলো, আল্লাহ যা হারাম করেন নি তা হালাল। আল্লাহ কোরআনে গুটিকয় কাজ, খাদ্য ও বিষয় হারাম করেছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন, যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, হারাম করেছেন আল্লাহর নাফরমানি, অন্যায়-অত্যাচার চালানো, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোনো সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না (সুরা আরাফ ৭:৩৩)।

এখানে তিনটি বিষয়কে হারাম করা হচ্ছে, এক. অশ্লীলতা, দুই. আল্লাহর নাফরমানি অর্থ আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানের লংঘন করা, তিন. আল্লাহর সঙ্গে শেরক করা। এই তিনটি কাজ না করে যে কোনো কাজ, সেটা শিল্পচর্চা হোক, কী দৈনন্দিন জীবনের যে কোনো কাজ, তা ইসলাম পরিপন্থী বা নাজায়েজ কাজ হতে পারে না।

সমাজবিজ্ঞানীদের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, সংস্কৃতি বলতে সেই সকল পন্থাকে বোঝায় যার মধ্য দিয়ে মানব জাতি তাদের প্রকৃতিগত বর্বরতাকে কাটিয়ে উঠে মানবিকতার বিকাশ ঘটিয়ে পূর্ণরূপে মানুষে পরিণত হয়। কোনো এলাকার মানুষের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যকলা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তা-ই সংস্কৃতি। গান, নাটক, সিনেমা, অভিনয়, চিত্রকলা, সাহিত্য--এগুলো হলো সংস্কৃতিকে তুলে ধরার একটি মাধ্যম।

সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র যদি হারামই হতো, তাহলে পবিত্র কোরআনে একটি আয়াতেও কি আল্লাহ সেটা উল্লেখ করতে পারতেন না? না। তিনি কোথাও এ জাতীয় কোনো কথাই বলেন নি। কিন্তু দ্বীনের অতিবিশ্লেষণ করে সুরা লোকমানের ৩১:৬ নম্বর আয়াতকে সঙ্গীতের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়। যেখানে আল্লাহ সঙ্গীত শব্দটিই বলেন নি, বলেছেন অসার কথাবার্তা। আল্লাহ বলেন,‘একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ অসার, অনর্থক, অবান্তর, অশ্লীল ইত্যাদি কথাগুলোকে বোঝানোর জন্যে আল্লাহ তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন-- লাগওয়া (সুরা মুমিনুন ২৩:৩), লাহওয়াল হাদিস (সুরা লোকমান ৩১:৬), ফাহেশা (সুরা নুর ২৪:১৯)। সঙ্গীত আর অসার বা অবান্তর কথা কি এক বিষয়? সঙ্গীতের বাণী তো শিক্ষামূলকও হতে পারে, সুন্দর সমাজ ও মানবতাবোধের বাণীও সঙ্গীতে ধ্বনিত হতে পারে। অসার কথা, অহেতুক কথা সব সময়ই নিষেধ। নয়তো আজান কেন সুর করে দেওয়া হয়? কোরআন কেন সুর করে পড়া হয়?

ইসলাম একটি সভ্যতার নাম। মানব ইতিহাসে এমন কোনো সভ্যতার বিকাশ হয়নি যেখানে শিল্পচর্চা ছিলো না। কারণ এগুলো মানুষের প্রাকৃতিক চাহিদা। তাই আল্লাহর দ্বীনও এগুলোকে পরিহার করতে বলে না, বরং একে তার প্রাপ্য স্থানটি প্রদান করে।

আসমানি কেতাববাহী প্রধান চার রসুলের অন্যতম দাউদ (আ.)-এর মোজেজাই ছিলো তাঁর সুরেলা কণ্ঠ। তিনি হার্প নামক বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, যার ছবি ঐ সময়ের মুদ্রাতেও অঙ্কিত ছিলো। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রসুল ছিলেন মানব ইতিহাসের ব্যস্ততম পুরুষ, যিনি মাত্র ৯ বছরে ১০৭ টি ছোট-বড় যুদ্ধাভিযানের আয়োজন করেছেন, যিনি মানবজীবনের সর্ব অঙ্গনের আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্যে এক মহান বিপ্লব সম্পাদন করেছেন। এমন এক মহা বিপ্লবীর গান নিয়ে পড়ে থাকার অবসর ছিলো না। তবু অবসরে নিজ গৃহে অথবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর তাঁকে গান শোনানো হয়েছে। তিনি নিষেধ করেননি, শুনেছেন। জাহেলিয়াতের যুগে আরবে গান আর অশ্লীলতা ছিলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই অনেক সাহাবী গানকেই ফাহেশা কাজ বা মন্দ কাজ বলে ভাবতে লাগলেন। কিন্তু রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁদের এই ভুল ধারণা ভাঙ্গিয়ে দিলেন।

গান বাজনা যে হারাম নয় সেটা প্রমাণের জন্যে রাসুলের সহীহ হাদিস গুলো নিচে দেয়া হলো

১/ রসুলাল্লাহর উপস্থিতিতেও মদীনায় সাহাবীদের বিয়ে শাদি বা অন্য যে কোনো উৎসবে দফ বাজিয়ে গান গাওয়া হতো। আল্লাহর রসুলপ বলেছেন, ‘তোমরা এই বিবাহের ঘোষণা দাও। এটা মসজিদে সম্পন্ন করো এবং বিবাহ উপলক্ষে দফ বাজাও। ( ইবনে মাজাহ : ১৮৯৫, তিরমিযী-১০৮৯ )

২/ একটি হাদিসে এমন কি এও বলা হয়েছে যে, ‘হালাল ও হারামের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী হলো- বিয়ের সময় দফ বাজানো এবং তা জনসম্মুখে প্রচার করা। (ইবনে মাজাহ : ১৮৯৬, তিরমিযী-১০৮৮, নাসাঈ-৩৩৬৯)

৩/ রসুলাল্লাহর নারী সাহাবী রুবাই বিনতে মুআব্বিয ইবনু আফরা (রা.) বলেন, ‘আমার বাসর রাতের পরের দিন নবী (সা.) এলেন এবং আমার বিছানার ওপর বসলেন, যেমন বর্তমানে তুমি আমার কাছে বসে আছো। সে সময়ে মেয়েরা দফ বাজাচ্ছিলো এবং বদর যুদ্ধে শাহাদাতপ্রাপ্ত আমার বাপ-চাচাদের শোকগাথা গাচ্ছিলো। তাদের একজন গাইছিলো--আমাদের মধ্যে এক নবী আছেন, যিনি ভবিষ্যৎ জানেন। তখন রসুলাল্লাহ বললেন, এ কথাটি বাদ দাও, আগে যা গাইছিলে তাই গাও (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৫১৪৭)। লক্ষ্য করুন, এখানে রসুলাল্লাহ (সা.) মেয়েদেরকে গান গাইতে বারণ করলেন না, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে একটি মিথ্যা ধারণা তিনি সংশোধন করে দিলেন।

৪/ রাসুল যখন হিজরত করে মদিনায় এসে পৌঁছান, তখন তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্যে আনসার নারী পুরুষ শিশু কিশোর নির্বিশেষে দফ বাজিয়ে ‘তালা-আল বাদরু আলাইনা’ গানটি গাইতে থাকেন। এই গানটি ১৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো সঙ্গীত, যা আজও মিলাদের সময় গাওয়া হয়। মদিনায় এসে মসজিদে নববী নির্মাণের সময় আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের সঙ্গে মিলিত কণ্ঠে কর্মসঙ্গীত গেয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও গান গেয়েছিলেন।--(বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ।)

মঞ্জুর বিন সুলতান : সঙ্গীত শিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালক; মুখপাত্র, মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়