রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩৫

আমার স্কুলের শতবর্ষ

সাথী
আমার স্কুলের শতবর্ষ

বঙ্গভিটায় নানা জনের নানা গল্প-কাহিনি পড়তে গিয়ে আমিও আমার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি চাঁদপুর। পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া এ তিনটি নদীর মোহনায় অবস্থিত ছোট একটি শহর। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী। নদীর একদিকে শহর নতুনবাজার অন্যদিকে গঞ্জ পুরাণবাজার। চাঁদপুর শহরের পুরাণ আদালতপাড়ায় ছিলো আমাদের বাসা তালুকদার বাড়ি। বাড়ির সামনে বড় খেলার মাঠ। মাঠের মাঝখানে বিশাল গুড়িওয়ালা একটি অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের কোটরে বসে সাথীদের সাথে খেলা করে কেটেছে আমার শিশুবেলা। এই বাড়িটি আমার কাকা বিক্রি করে দেন। আমাদের আর একটি বাসা মেথা রোডে। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। বাসা-বাড়ির সামান্য দূরে আছে নদীর বাঁধানো ঘাট। ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুরা মিলে সেই ঘাটে ¯œান করতে যেতাম। আর আছে আমাদের স্কুল। মাতৃপীঠ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। আগে স্কুলটি ছিলো জেএম সেনগুপ্ত রোড, পুরো নাম যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত রোড, জোড়পুকুর পাড়ে। যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেন মহান বিপ্লবী, যাকে ব্রিটিশ পুলিশ বহুবার গ্রেপ্তার করেছে। রাচির ব্রিটিশ কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়। স্কুলটি ছিলো কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি। স্কুলের ভেতরে খুব বেশি জায়গা ছিলো না। তার মধ্যেই আমরা হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্ধা খেলতাম। বাৎসরিক খেলাধুলা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সরস্বতী পূজা, প্রসাদ বিতরণ, পাতপেরে লুচি তরকারি, পায়েস খাওয়া সবই হতো। এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার বরাবর ভালো থাকায় সরকার স্কুলটি অধিগ্রহণ করে নেয়। তখন স্কুলের স্থান পরিবর্তন হয়ে এলো হাজী মোঃ মহসিন রোড আর স্টেডিয়াম রোডের সংযোগস্থলের পাশে। বড় দোতলা বাড়ি, বড় বড় ক্লাস রুম, চওড়া বারান্দা, সামনে বড় খেলার মাঠ। স্কুলের নাম হলো মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী দিদিদের জন্যে বিদায় সম্ভাষণ অনুষ্ঠান হতো, দিদিরাও সমস্ত ছাত্রীদের মিষ্টিমুখ করাতো। তার জন্যে চাঁদপুরের নামকরা মিষ্টির দোকান সুইট হোম থেকে বড় পিতলের গামলায় করে গরম অমৃতী আসতো। আর একটি বিশেষ দিন উল্লেখ করার মতো। সেদিন স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম পৃথিবীর মানুষ প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে। সেই খুশির খবর উদ্যাপন হলো স্কুল ছুটি দিয়ে। ঢং ঢং ঢং ঢং করে ছুটির ঘণ্টা বেজে গেলো। ছাত্রীদের চিৎকার হৈ-চৈ করে ছুটির আনন্দ প্রকাশ। এই তো ছিলো স্কুলজীবন। অনাবিল আনন্দে ভরা। বন্ধুদের সাথে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথেও কত শত মধুর স্মৃতিবিজড়িত স্কুলজীবন। আমার মা আমাদের স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষিকা ছিলেন। আমাদের এসএসসি পাসের পরপরই...।

পৃথিবীর মানচিত্রে আরো একবার এলো বিবর্তন। জন্মলগ্নে স্কুলটি ছিলো অবিভক্ত ভারতে, পরে হলো বিভক্ত পূর্ব পাকিস্তানে, তারপর নতুন দেশ বাংলাদেশে। সেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে উত্তরণ...। আবার এক সাগর রক্তক্ষয়ী বিপ্লব। মাঝরাতে কাচাঘুম ভেঙ্গে চোখের সামনে বসতবাড়ি জ্বলতে দেখা, বুকভাঙা কান্না, হাহাকারময়, আতঙ্কিত ছিন্নমূল হয়ে শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারে লক্ষ লক্ষ আবালবৃদ্ধবনিতা ভারতের ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেয়ার নিদারুণ ইতিহাস লেখা হলো। সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানে। আক্ষরিক অর্থেই নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পরে বাংলাদেশ জন্ম নিলো। আমরা কিছুদিন আগরতলায় থেকে তারপর কলকাতায় এলাম অভিভাবকদের ইচ্ছানুযায়ী। আমার দুই দাদা অনেক আগে থেকেই বিদেশে থাকতেন। মামা-মাসিদের বাড়িও কলকাতায়। অবশেষে জন্মস্থান, নিজের শহর, স্কুল, প্রাণের বন্ধু সব ছেড়ে চলে এলাম কলকাতা।

নতুন করে জীবন শুরু হলো। কলেজে ভর্তি হলাম। কালের গতির সাথেই জীবনের গতি চলছিলো। প্রথমদিকে বন্ধুর সাথে চিঠিতে যোগাযোগ ছিলো। তারপর ও ডাক্তার হলো, বিয়ে করে বিদেশে চলে গেলো। আমিও কলেজ শেষ করে চাকুরি, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। জীবনযুদ্ধে পেছনের দিনগুলো মনে করার ফুরসৎ ছিলো না। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। যমে-ডাক্তারে জীবন-মরণের লড়াই করে, প্রায় দু মাস পরে একটু ভালো হলাম। তখন খবরটা পেলাম ঢাকা-কলকাতা যাত্রী বাস চালু হবে। দু মাস হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পরে যখন শ্রান্ত-অবসন্ন অবস্থা তখন এক ঝলক আনন্দ মন ভরে দিলো। মনে হলো এইতো আমি ভালো হয়ে গেছি। কিছুদিন পরে ছুটি পাবো এখান থেকে, তারপর বাসে চেপে ঢাকা, সেখান থেকে চাঁদপুর যাবো। আরো দু সপ্তাহ পরে ছুটি পেলাম প্রায় পঙ্গু হয়ে। সাথেই এলো দু জন নার্স। দিনে-রাতে পরিচর্যা করতো, এভাবে আরো তিন মাস গেলো।

ধীরে ধীরে আবার শুরু হলো কর্মজীবন। দিন-মাস-বছর গড়িয়ে একসময় অবসর নেয়ার অবকাশ এসে গেলো। কমজোরী শরীরে বার্ধক্যের ব্যাধিগুলোও নিয়ম করে এসে হাজির। কোনো রকমে দিন যাচ্ছিলো ভালো-মন্দে, তারপর... আবার বিপর্যয়, শুরু হলো বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনা ত্রাস। পৃথিবীব্যাপী মানুষের মৃত্যু-মিছিল। নানা দুঃখ, কষ্ট, বেদনার মধ্যে আমি হঠাৎ খোঁজ পেয়ে গেলাম আমার কিশোর বেলার প্রাণের বন্ধুর, প্রায় চার যুগ পরে, গত বছর। আমার মনের কথা ওকে জানাতে শিখে গেলাম স্মার্টফোন ব্যবহার করা, যেটা গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে পারিনি। স্মৃতির পাতাগুলো বিস্মৃতির পর্দা সরিয়ে সব সামনে এসে গেলো, যেনো সব ছুঁয়ে অনুভব করতে পারলাম। বন্ধুই পাঠিয়েছিলো আমাদের স্কুলের ছবি। এতোগুলো বছর পরে স্কুলের ছবি দেখার অনুভূতি লিখে প্রকাশ করা যাবে না। আমি দেখে এসেছিলাম যখন, তখন স্কুল বাড়ির রং ছিলো না, নাম লেখাও ছিলো না। শুধু বাইরে গেটের উপরে স্কুলের নাম লেখা বোর্ড ছিলো। ছবিতে দেখলাম স্কুল বাড়ির গায়ে নাম মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। স্থাপিত ১৯২১ইং। অর্থাৎ এ বছর ২০২১ সালে স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি বছর। কীভাবে যে আমার মনের আনন্দ প্রকাশ করব বুঝে উঠতে পারছি না। ইচ্ছে করে ছুটে চলে যাই চাঁদপুর। শতবর্ষ উৎসবে যোগ দিই। কিন্তু উপায় নেই, শরীর প্রায় অচল। মনের তো বয়স নেই, ব্যাধিও নেই। তাই মন প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়, স্কুলের মাঠের গাছের পাতায় গিয়ে বসে, অথবা ক্লাস রুমের জানালায়। দেখতে পাই শতবার্ষিকীর নানা অনুষ্ঠান, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলো, আরো কত উদ্যাপন। স্কুলের সব বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে আমাদের শ্রদ্ধেয় সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। মনে পড়ে চাঁদপুরের রাস্তা, স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়া রেললাইন, তার পাশে লেক, দোকানপাট, অন্যান্য স্কুলগুলো। লেডি প্রতিমা মিত্র বালিকা বিদ্যালয়, লেডি দেহলভী বালিকা বিদ্যালয়, ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়, হাসান আলী জুবিলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। নতুনবাজার, পালবাজার, রেলস্টেশন, বড়স্টেশন, স্টিমারঘাট আরো কত কি। জানি আর কোনোদিন যেতে পারবো না, দেখতে পারবো না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আমার জন্মভূমি এবং আমার স্কুলের নাম যেনো চিরদিন উজ্জ্বল থাকে, গৌরবান্বিত থাকে। লেখক : সাথী, পশ্চিমবঙ্গ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়