প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:২৯
হুগো শ্যাভেজ : ল্যাটিন আমেরিকার মূর্তিমান অভিভাবক

হুগো শ্যাভেজ ল্যাটিন আমেরিকানদের একজন আদর্শ, মহান ব্যক্তিত্ব এ সংগ্রামের প্রতীক। তার নিজ জন্মভূমি ভেনিজুয়েলাকে জনগণের করে তোলার ক্ষেত্রে একজন সফল ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। হুগো শ্যাভেজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালের ২৮ জুলাই। তিনি ১৯৯৯ সালে ভেনিজুয়েলার ৫২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত ভেনিজুয়েলার নেতৃত্ব দেন। ৫ মার্চ ২০১৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হুগো শ্যাভেজ পিতা-মাতার ৭ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তঁার পিতার নাম হুগো দে লস রেয়েস শ্যাভেজ। তঁার মাতার নাম এলেনা ফ্রিয়াস ডি শ্যাভেজ। তঁার পিতা হুগো দে লস রেয়েস ছিলেন ভেনেজুয়েলার একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং স্কুল শিক্ষক। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়ার ইতি টানলেও পরে অবশ্য শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনি রাজনীতি করা কালে সোশ্যাল ক্রিশ্চিয়ান পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি তিন মেয়াদে বারিনাসের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পিতা গভর্নর থাকাকালে পুত্র হুগো শ্যাভেজ ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতি। হুগো শ্যাভেজের মা একজন গৃহিণী ছিলেন বলে জানা যায়।
হুগো শ্যাভেজের বড় ভাই অ্যাডান শ্যাভেজ। যিনি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বারিনাসের গভর্নর ছিলেন। তিনি ভেনিজুয়েলার শিক্ষামন্ত্রী এবং কিউবার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনিও চঝটঠ পার্টি করতেন। তিনি একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন।
অ্যাডান শ্যাভেজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে বলেন, ‘আমাদের একটি শত্রু আছে, আমেরিকান সাম্রাজ্য আমাদের মৌলিক শত্রু, অন্য বিবেচনার বনে কেউ হারিয়ে যেতে পারে না’।
হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তাকে ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’ বলে অভিহিত হয়ে আছে। হুগো শ্যাভেজের সংগ্রামের প্রেরণা ও প্রণোদনা সিমন বলিভার। হুগো শ্যাভেজের উদ্দীপনার প্রতীক বিপ্লবী সিমন বলিভার। স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন সিমন। বিপ্লবী সিমনের অনবদ্য লড়াইয়ে এবং সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ভেনিজুয়েলা, পানামা, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পেরুসহ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর জনগণের ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক। বিপ্লব-সমর মাঠে সিমন বলিভার ছিলেন আস্হা ও বিশ্বাসের জায়গা।
বিপ্লবী সিমন বলিভারকে ঘিরে শ্যাভেজ বলেন, ‘ওয়াশিংটন শহরে জর্জ ওয়াশিংটনকে কেউ আর মনে করে না, ফ্রান্সে নেপোলিয়নকে নিয়েও কেউ কথা বলে না। কিন্তু ভেনিজুয়েলায় আজ বলিভার এর নাম ও ছবি তরুণ সমাজ টি-শার্টের বুকে এঁকে ঘুরে বেড়ায়। সিমন বলিভার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল এক মহান ব্যক্তিত্ব।’
হুগো শ্যাভেজ বিপ্লবী সিমন বলিভারের সংগ্রামকে অনুপ্রেরক, জৈবনিক শক্তি ও চেতনার মূর্ত প্রতীক হিসেবে ধরে ভেনিজুয়েলার। জনগণকে শোষণমুক্ত করতে লড়াই সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ভেনিজুয়েলার রাজনীতি-অর্থনীতি ছিল বুর্জোয়াদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে। ১৯৫৮-১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ সমাজব্যবস্থা, বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকার কারণে শ্রেণি সংগ্রাম উল্লেখযোগ্যভাবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৬০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়কাল ঐকমত্যের শক্ত ভিত।
১৯৪৬ সালে ভেনিজুয়েলার ঐক্য কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ভেনিজুয়েলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলতে ঐক্য কংগ্রেসের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ঐক্য কংগ্রেস ভেনিজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টি বা ঢ়ধৎঃরফড় পড়সসঁহরংঃধ ফব ঠবহবুঁবষধ (ঢ়াপ) গঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ভেনিজুয়েলার জনগণ গণসংগ্রামের দিকে ধাবিত হতে থাকে। গড়ে ওঠে ভেনিজুয়েলার শ্রমিক ফেডারেশন। যার সদস্য সংখ্যা ছিল তিন লক্ষের বেশি। এ সংগঠনটি ধীরে ধীরে শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে ওঠে, বাম শক্তির জাগরণসহ বিভিন্ন গণসংগ্রাম অবধারিতভাবে গড়ে ওঠে।
ভেনিজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার আগে অপঃরড়হ উবসড়পৎধঃরপ (অউ) পার্টি গড়ে ওঠে। এ পার্টি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মোড়কে সংঘটিত। এডি দলের নেতৃত্বে সিভিল-মিলিটারি জান্তা ক্ষমতায় আসে। সময়কাল ১৯৪৫। কিন্তু এডি দলের দুটো মতাদর্শ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। একপক্ষ বুর্জোয়া চিন্তায় ধাবিত, অন্যপক্ষে বামপন্থী চিন্তায় উত্তরণ। একপর্যায়ে বামপন্থাদেরকে দল থেকে বের করে দেয়া হয়। ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীদেরকে কোনঠাসা করে রাখে, পরবর্তীতে তাদেরকেও দল থেকে বের করে দেয়া হয়।
১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লব ভেনিজুয়েলায় প্রভাব পড়ে। গেরিলা কিউবানদের পদ্ধতি ভেনিজুয়েকার তরুণদের আকর্ষণ করে। ভেনিজুয়েলার কমিউনিস্টরা গেরিলা পদ্ধতির সংগ্রামে ঝু্ঁকে পড়ে। বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। বুর্জোয়ে দলগুলো নিজেদের শ্রেণি স্বার্থ অটুট রাখতে বিভিন্ন অপকৌশল হাতে নেয়। বুর্জোয়া দলগুলো সমঝোতা করে নিজেদের মধ্যে শাসন ও কর্তৃত্ব ভাগাভাগি করে নেয়। ততক্ষণে শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন অতিমাত্রায় বেড়ে ওঠে। আর এদিকে বুর্জোয়া অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে নিয়োজিত বিপ্লবীরা। দিকে দিকে ভেনিজুয়েলা গণবিপ্লবের পথ ধরে। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ‘এল কারাকাজো’ নামে খ্যাত লক্ষ লক্ষ বিপ্লবীরা মুষ্টিবদ্ধ হাতে নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
এদিকে ভেনিজুয়েলা সরকার প্রধান প্রেসিডেন্ট পেরেজ আন্দোলন দমন করতে মরিয়া। আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেন। সেনা সদস্যদের গুলিতে হত্যা হয় অসংখ্য আন্দোলনকারী। এদের ভিতরে কিছু সেনাসদস্য গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়। এসব সেনা সদস্য জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন।
তখনও কিন্তু বিপ্লবীরা মসনদে বসতে পারেনি, বিপ্লবীরা শোষকদের পদাঘাত করতে পারেনি, তবে সংগ্রাম চলছে নিরন্তর। সেনা কর্মকর্তারা গ্রামে গ্রামে গেরিলাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা গিয়ে দেখে প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। খাবারের অভাব চরমে। জেনারেল উইলফ্রেডো রেমন এমনই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়ে দেখেন প্রচুর খাবার অপচয়, মদ ও নামিদামী খাবার। সবই যেন অপচয়ের ভাগাড়।
এমন পরিস্থিতিতে শ্যাভেজ বলেন, ‘বলিভারিয়ান আন্দোলনের জন্ম হয় যখন আমরা একদল সৈনিক এই সিদ্ধান্তে পেঁৗছালাম যে কমিউনিজম নয়, ইম্পেরিয়ালিজম বা সাম্রাজ্যবাদই হচ্ছে আমার দুশমন।’
১৯৯২ সালে শ্যাভেজের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান হয় ব্যর্থ। এটি সংঘটিত হয় গইজ-২০০০ এর কর্মসূচির প্রধান কাজ হিসেবে। গইজ প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৮২ সালের ১৭ ডিসেম্বর। গইজ-গড়াবসবহঃড় ইড়ষরাধৎরধহড় জবাড়ষহপরড়হধৎরড়-২০০০. হুগো ডি শ্যাভেজ ছিলেন এ সংগঠনের নেতৃত্বে। গইজ-২০০০ এর প্রতিষ্ঠাতা হুগো ডি শ্যাভেজই। এ কর্মসূচির নেতৃত্বে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর ২ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তার মুক্তিতে লাখো লাখো জনতা রাস্তায় নেমে আসে। অবশেষে তিনি মুক্তি পান। পরবর্তীতে সেনা অভ্যুত্থান কৌশল থেকে তিনি সরে যান। বিপ্লবী কাজের অংশ হিসেবে তিনি ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রথম দিক দিয়ে শ্যাভেজ মনে করেছিলেন মেহনতি ও দরিদ্র মানুষ বিপ্লবের প্রধান ভিত্তি বা নিয়ামক। এ সময়ের মধ্যে মেহনতি শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়ে সংঘটিত করার মতো দল গড়ে ওঠেনি। তিনি সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভর করেন আপদকালীন সংকট দূর করতে। তবে তাই তিনি শ্রমিক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি ‘প্ল্যান বলিভার ২০০০’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য সমস্যা দূর করতে সেনাবাহিনীর দ্বারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯৯৮ সালে শ্যাভেজ ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক কাজকে আরও অগ্রসর করে তোলেন। ২০০১ সালে শ্যাভেজ বলিভারিয়ান চক্র গড়ে তোলেন। ১০/১২ জন সদস্য নিয়ে লাখ লাখ বলিভারিয়ান চক্র গড়ে তোলেন তিনি। এ বলিভারিয়ান চক্রগুলো হয়ে উঠলো জনগণের নিশানা ও আশ্রয়স্থল। আঞ্চলিক কিংবা সেক্টর ভিত্তিতে এ চক্রগুলো গড়ে ওঠে। এগুলো সমাজের অন্ত্যরস্থ প্রতিক্রিয়াশীল ধারণার বিরুদ্ধে সপাটে অবস্থান করে। শিল্প প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সংগ্রামে নিয়োজিত থাকতে প্রচেষ্টারত। এভাবে এ চক্রগুলোকে বিপ্লবের গণভিত্তি গড়ে তোলে।
২০০২ সালে শ্যাভেজকে বন্দী করা হয়। ভেনিজুয়েলার বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, মার্কিন মাফিয়া সাম্রাজ্যবাদের মদতে এক প্রতিবিপ্লবী ক্যু সংঘটিত হয়। যে বিপ্লব জনগণের মাঝে ঘটেছিল, সে জনগণ হুগো শ্যাভেজের পথে রাস্তায় নামে। ভেনিজুয়েলার প্রত্যেকটি শিবিরের সার্কেলগুলো আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠে। বলিভারিয়ান এ চক্রগুলোর নির্দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ নবতর সংগ্রামের পথ রচনা করেন। প্রতি বিপ্লবীদের তোষণ-পোষণকৃত প্রচার মিডিয়াগুলো নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ এর সমর্থনে। নতুন সরকারের বিরুদ্ধে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়, ‘বন্ধু শ্যাভেজ-আমরা আছি তোমার সাথে। জনগণের মধ্যেতো বটেই সেনাবাহিনী ও শ্যাভেজের নিরাপত্তা বাহিনীতে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বলিভারিয়ান চক্রগুলো মিছিল নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জনতা সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনী ও জনতার সংহতি গড়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খায়েশ নিমিশেই চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। গণআন্দোলনের মুখে পিছু হটে প্রতিবিপ্লবীরা।
সাম্রাজ্যবাদীরা কখনই সাধারণ মেহনতিদের জেগে ওঠাকে পছন্দ করেনা, আশীর্বাদ মনে করে না। সাধারণ জনগণকে ফুঁসে ওঠাকে তারা সর্বদাই বিপদসংকুল মনে করে। ২০০২ সালে প্রতিবিপ্লব ব্যর্থ হবার পর নতুন করে ষড়যন্ত্রের সূতিকা স্থাপন করে। প্রতিবেশী কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে শ্যাভেজের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের নতুন কূট কৌশল শুরু করে। এর মাধ্যমে ভেনিজুয়েলায় সামরিক তৎপরতা ও প্রতিঘাত চালানো হচ্ছিলো। সেটাও তিনি প্রত্যাঘাত করেন। ২০০৮ সালে শ্যাভেজ কারাকাসে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বলেন, ‘ভেনিজুয়েলার বিপ্লব একা টিকতে পারে না। আজ গোটা আমেরিকার সমস্ত বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রতিহত করতে হবে। কলম্বিয়াসহ সব দেশের মানুষকে এ লড়াইয়ে সামিল হতে হবে।’ ( তথ্যসূত্র : ভেনিজুয়েলা : এক চলমান বিপ্লব, মনজুরুল আহসান খান)
ভেনিজুয়েলার সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী বিপ্লবী লুসিয়ানা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি মনজুরুল আহসান খান এর সাথে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে লুসিয়ানাকে দেয়া পথপ্রদর্শক হিসেবে। কথা প্রসঙ্গে লুসিয়ানা মনজুরুল আহসান খানকে জানান, ‘---সেদিনের সব নাটকীয় ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, জীবন বাজি রেখে লড়েছি। সেটা ছিল আমার ভেনিজিয়েলাবাসীর জীবন সংগ্রাম। আমাদেরই জীবন কাহিনি ভেনিজুয়েলার গণমাধ্যম বা মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বহুজাতিক কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে। মিডিয়া শ্যাভেজবিরোধী প্রচারণা চালায়। গণপ্রতিরোধের সমস্ত খবর ব্ল্যাকআউট করা হয়। প্রতিরোধ সম্পর্কে রেডিও-টিভি-সংবাদ পত্রিকায় সামান্যতম খবরও জায়গা পায়নি। জনতা এক পর্যায়ে রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়ার পর খবর প্রকাশিত হতে থাকে। সে সময় বিদেশী একটি টিভি কোম্পানি কারাকাসে একটি ফিচার ফিল্ম করতে এসেছিল। তারা সেদিনের গণপ্রতিরোধ ক্যামেরায় ধারণ করে।’
ওই টিভি কোম্পানী গনপ্রতিরোধ নিয়ে একটি ফিল্ম করেছে। এটির নাম দেয়া হয়েছে জবাড়ষঁঃরড়হ ঃযধঃ পধহ হড়ঃ নব ঞবষবারংবফ. ভেনিজুয়েলার বিপ্লব সংঘটিত হবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কম ছিল না।
হুগে শ্যাভেজ বিপ্লবের আগ মুহূর্তে বলেন, ‘ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান জনগণ প্রতিদিন আরও বেশি করে উপলব্ধি করবে যে, বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন পথ নেই’। কিন্তু ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি বেশি শক্তিশালী ছিল না। তবে যুব কমিউনিস্টদের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ায় পার্টি অগ্রসর হতে লাগলো।
২০০৬ সালে শ্যাভেজ আহ্বান জানান বিপ্লবীদের এক জায়গায় আসার জন্য, একটি পার্টিতে আসার জন্য। এ আহ্বান বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভেনিজয়েলাবাসীর কাছে। ওই সময় ২৪টি দল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভেনিজুয়েলাকে সমর্থন করেছিল। তন্মধ্যে ১১টি দল চঝটঠ-তে যোগ দিতে সিদ্ধান্ত নেয় প্রথম দিকে। কমিউনিস্ট পার্টি এ নীতিকে সমর্থন করে। চঝটঠ (চধৎঃরফড় ঝড়পরধষরংঃ টহরফড় ফব ঠবহবুঁবষধ) এবং চঈঠ ( ঈড়সসঁহরংঃ চধৎঃু ড়ভ ঠবহবুঁবষধ) এর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ভেনিজুয়েলার কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ হুগো শ্যাভেজের পিএসইউভি-তে যোগ দেয়ার আগ্রহ পোষণ করে। কিন্তু পিএসইউভি-এর একটি অংশের নেতা-কর্মীরা বিরোধীতা করে। কিন্তু হুগো শ্যাভেজ কমিউনিস্ট কর্মীদের দলে নিতে মত দেন।
চঝটঠ-পার্টির একটা অংশ কমিউনিস্ট বিরোধী। হুগো শ্যাভেজ এই দলের প্রধান নেতা হলেও বিপ্লবের আগে পার্টি করতেন না। সে কারণে বহু মত-পথের মানুষ এ দলে থাকায় লাগাম টানতে তার বেশ বেগে পেতে হয়েছিলো।
২০০৩ সালে হুগো শ্যাভেজের সরকার জমির সিলিং নির্ধারণ, কৃষকদের অধিকার ও ভূমি বণ্টন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন হয়ে থাকে। কিন্তু এসবের বাস্তবায়ন হচ্ছিলো না। দীর্ঘ ৯ বছর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে শ্যাভেজের যোগাযোগের কোন আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু শ্যাভেজের বিরুদ্ধে ক্যু হবার সম্ভাবনার বিষয়টি কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিলো। চঝটঠ এখন আর হুগো শ্যাভেজের নীতিতে পরিভ্রমণ করছে না। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত যেন সকল রীতিনীতি। এসব শ্যাভেজ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সে প্রেক্ষিতে শ্যাভেজ কমিউনিস্ট পার্টির সভায় হাজির হলেন আচমকা।
চঈঠ-এর যে সব নেতা চঝটঠ-তে যোগ দিয়েছিলেন, সে সব নেতা বেশ কোনঠাসাই ছিলেন। পরে দলছুট ওই সব নেতা পিসিভিকে পুনর্গঠন করতে এগিয়ে আসলেন নতুন করে। ক্রমশ কমিউনিস্ট পার্টির লাইন, বিপ্লবের পথকে সুগম করতে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা প্রশংসিত হয়ে ওঠে বুদ্ধিজীবীসহ নানান শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে। এসব বুদ্ধিদীপ্ত লোকজন চঈঠ-এর পাশে এসে দঁাড়িয়েছে।
এ সময়কালে ইরাকে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র। শ্যাভেজ ওই হামলার কঠোর সমালোচনা করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় জর্জ বুশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এখানে ২৪ ঘণ্টা আগে এক শয়তান এসেছিলো ভাষণ দিতে এবং এই লোকটির শরীর থেকে সালফারের গন্ধ বের হচ্ছে। আমি সেই গন্ধ এখনও পাচ্ছি। আমার হাতের এ বইটিও অপবিত্র হয়ে গেছে।’
শ্যাভেজ ল্যাটিন আমেরিকার জন্য হয়ে ওঠেন এক মহান ব্যক্তিত্ব। দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন পুরো বিশ্বে। পুঁজিবাদী সমাজের অক্ষমতা তুলে ধরেছেন তার সক্ষমতা বাস্তবায়ন করে। শ্যাভেজ সরকার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে মোটামুটি সমর্থ হন। বেকারদের কর্মসংস্থান করেছেন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে পিএইচডি পর্যন্ত অবৈতনিক করেছেন। তেল থেকে অর্জিত যে আয় তা ব্যয় করেছেন গরিব মানুষের জন্য। সমাজের ধনী মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হয়ে থাকলেন আর গরিব মানুষের কাছে হয়ে উঠলেন মূর্তিমান বন্ধু। গোটা ল্যাটিন আমেরিকার হয়ে উঠলেন আদর্শের চূড়ামণি, প্রেরণার মধ্যমণি। তাই চতুর্থবারের মতো ভেনিজুয়েলাবাসী তাকে নির্বাচিত করেন বিপুল ভোটে।
শ্যাভেজ সরকার নির্মোহভাবে চেষ্টা করেছেন মানুষের জীবন মান উন্নত করতে। তিনি স্বাস্থ্যসেবাকে ক্রমাগতভাবে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি পশু-পাখির জন্যও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন সারা বিশ্বে। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে বড় বড় এস্টেটগুলো কৃষি জমিতে রুপান্তর করতে সফল হয়েছেন। ভূমিহীন কৃষকদেরকে ভূমির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রাপ্ত বয়স্কদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করেন। পরিবেশ রক্ষা ও বিজ্ঞানে বিনিয়োগ করেছেন যথাসম্ভব। নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে সিভিল মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেন।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিস্তৃত তথ্য উঠে আসে ভেনিজুয়েলার। ভেনিজুয়েলাকে স্প্যানিশরা শাসন করেছিল প্রায় দু’শো বছর। ১৫২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্পেন উপনিবেশের অধীনে ছিল ভেনিজুয়েলা। স্পেনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কলম্বিয়ার উপনিবেশে আটকা পড়েন। ১৮৩০ সালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভেনিজুয়েলা স্বাধীনতা লাভ করে।
উপনিবেশ শাসন থেকে ভেনিজুয়েলাবাসীর মুক্তি মিললেও মূলত পরাধীনতার শৃঙ্খলেই আটকে থাকতে হলো। দেশিয় সরকারের শোষণ নির্যাতন ভিন্ন মাত্রায় তীব্র হয়ে উঠছিলো। স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে অবশেষে সামরিক শাসনের অধীনে যায় দেশটি। একটা স্তরে এসে দ্বিদলীয় ধারা প্রবর্তন হয়ে থাকে। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং মধ্যমপন্থার বামদল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক-এ দু’টো দলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রথা শুরু হয়।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভেনিজুয়েলার ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছিলেন শ্যাভেজ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। দুর্নীতিবাজ রাজনীতি আর অর্থ লুটপাটকারীদের কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে তেলের সুবিধা পেঁৗছেনি। স্বৈরশাসক এবং সরকারি আমলারা লুটেপুটে নিয়েছেন অর্থ-সম্পদ। অবাধ এ বৈষম্যের মহাসমারোহের বিরুদ্ধে দঁাড়িয়েছে শ্যাভেজ। শ্যাভেজ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে জনতার স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন।
শ্যাভেজের শাসনামালে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাপক রাজস্ব পেতে থাকে ভেনিজুয়েলা। বলিভিয়ান বিপ্লব এ রাজস্ব আয় দিয়েই শুরু করেন। সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো হয় এ প্রকল্পে। সামরিক বাহিনীর প্রতি আস্হা ফেরাতে তিনি এ মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
শ্যাভেজ সাম্যবাদী হওয়ায় আন্তর্জাতিকতাবাদীকে প্রাধান্য দেন। তাই তিনি পররাষ্ট্রনীতিকে জাগিয়ে তুলেছেন উল্লেখিত ধারায়। প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিছুটা সম্পর্কের রসায়ন থাকলেও পরবর্তীতে সম্পর্কের তিক্ততা বেড়ে যায়। শ্যাভেজ এ সময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান নেন। তিনি নব্য উদারবাদীদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলেন। তিনি কিউবা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়াসহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। নতুন আঞ্চলিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। তিনি আমদানী নির্ভর দেশগুলোতে কম মূল্যে তেল সরবরাহ করেন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দরুণ সাম্রাজ্যবাদীদের রোষাণলে পড়েন তিনি।
উইকিপিডিয়ার বিশ্লেষণে, ভেনিজুয়েলা এবং ল্যাটিন আমেরিকার আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত রাজনীতিবিদদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তঁার ১৪ বছরের শাসনামালকে ‘গেলাপী জোয়ার’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন পর্যবেক্ষক মহল।
আন্তর্জাতিকভাবে তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে পরিচালিত কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে অনুসরণ করেন। সে হিসেবে তিনি ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানদের সহযোগিতার সমর্থন করেন। দক্ষিণ আমেরিকার জাতিগুলির প্যান-আঞ্চলিক ইউনিয়ন, ক্যারিবিয়ান রাজ্যগুলির মধ্যে সুসম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন।
শ্যাভেজ তঁার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে নন্দিত হবার পাশাপাশি কারও কাছে নিন্দিত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, শ্যাভেজ পারিবারিক সূত্রে একজন ক্যাথলিক ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একসময় পুরোহিত হতে কিন্তু হয়ে গেলেন বিপরীতমুখী। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন পরকালে অস্তিত্ব নেই। তিনি চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হন।
৪ মার্চ ২০১৩ সালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শ্যাভেজ। শ্যাভেজ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, তঁার মৃত্যু নিয়ে একটি বিষয় উল্লেখ করেন জোসে অরনেলা। তিনি বলেন, ‘ আমি ( শ্যাভেজ) মরতে চাইনা, দয়া করে আমাকে মরতে দেবেন না’।
এদিকে তঁার মৃত্যুর তারিখ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছিল। তথ্যের বিভিন্নতা ছিল। কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ২০১৩ সালের ৫ মার্চ রাষ্ট্রীয় চ্যানেলে ঘোষণা করেন যে শ্যাভেজ একটি সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চঁাদপুর জেলা কমিটি; প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি।