মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৫

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

ছাব্বিশতম পর্ব

করোনা : অন্তরীণ দিনের গল্প

সবুজ পৃথিবী তার পথ পরিক্রমায় কালে কালে মহামারি মোকাবেলা করে এসেছে। কখনও গুটি বসন্তের মহামারি, কখনও কলেরা মহামারি আর কখনও প্লেগের মহামারি। সর্বশেষ যে মহামারি পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করে তুলেছিলো তার নাম করোনা মহামারি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যেমন তাজমহল দেখার পর তার মেয়েকে বলেছিলেন, পৃথিবীতে দু’ধরনের মানুষ আছে। একদল যারা তাজমহল দেখেছে আর অন্য দল যারা তাজমহল দেখেনি। সে রকম আজকের পৃথিবীতে এ কথা বলা যায়, একদল করোনা মহামারি বিজয়ী আর অন্যদল করোনা দেখেনি। আমরা যারা করোনাকে জয় করে বেঁচে গেছি, তারা আজ বলতে পারছি, আমরা করোনা দেখেছি। জীবাণুর বিরুদ্ধে সমগ্র মানবজাতির এ যুদ্ধ বহুকাল বেঁচে থাকবে ইতিহাসের আলো কেড়ে নিয়ে। যাকে নিয়ে এতো কথা, সেই করোনা কী? করোনা হলো কোভিড ১৯ নামের সার্স-২ ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট মুখ্যত শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এ রোগে শ্বাসকষ্ট হয়, রক্তে অক্সিজেন পরিপৃক্তের হার কমে যায়, জ্বর আসে, নাকে কোনো ঘ্রাণ থাকে না, সারাদেহে তীব্র ব্যথা বোধ হয়। কারও কারও পেটে ব্যথা হয় এবং পাতলা পায়খানাও হতে পারে। শুকনো কাশি থাকে এবং ক্লান্তি দেখা দেয়। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে সামুদ্রিক মাছের দেহে প্রথম করোনা শনাক্ত করা হয়।

একত্রিশে ডিসেম্বর দুহাজার ঊনিশ সালে চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডঐঙ কে জানায়, নিউমোনিয়া ধরনের অজানা কোনো রোগে আক্রান্ত রোগীদের কথা। দুহাজার কুড়ি সালের বারো জানুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিশ্চিত করে যে, করোনাভাইরাস চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের জনগণের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে। জানুয়ারিতে এই রোগের প্রাদুর্ভাবকে জনস্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর এগারো মার্চ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ রোগের সেই প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। দুহাজার ঊনিশ সালের ডিসেম্বরে জীবাণুটির সংক্রমণ শুরু হয় বলে একে কোভিড ১৯ নামে নামকরণ করা হয়, যাতে কোন্ সালে হয়েছিলো তা সহজেই মনে রাখা যায়। বাংলাদেশে মার্চের আট তারিখে প্রথম করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তারা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ এবং মাদারীপুরের রোগী, যারা ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। রাজধানীর মিরপুর টোলারবাগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করেছিলো, বাংলাদেশে কমপক্ষে কুড়ি লাখ লোক মারা যাবে করোনায়। কিন্তু তৎকালীন সরকার প্রধানের দূরদর্শিতায় এ সংখ্যা মাত্র আটাশ হাজার পার হয়েছে, যা আক্রান্তের এক দশমিক ছয় তিন শতাংশের সমান। শনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে দুজন পুরুষ প্রবাসী বাংলাদেশি ছিলেন, যারা সবেমাত্র ইতালি থেকে ফিরে এসেছিলেন এবং তাদের একজন মহিলা আত্মীয় ছিলেন, যিনি তাদের কোনো একজনের সংস্পর্শে এসে সংক্রামিত হন।

করোনা সংক্রমণ নিয়ে চাঁদপুরেও বেশ আলোচনা শুরু হয়। দশ জানুয়ারি দুহাজার কুড়িতে যখন মুজিববর্ষের সূচনার জন্যে কাউন্টডাউন ক্লক স্থাপন করা হয় লেকের পাড় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন সিএনজি স্ট্যান্ডে, সেদিনের জনসমাবেশেও তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), আমি এবং একজন টেলিভিশন সাংবাদিকের মধ্যে আলোচনা হয় করোনার সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে। সাক্ষাতের শুরুতে হ্যান্ডশেক করার পরিবর্তে আমরা প্রত্যেকে হাত মুষ্টি করে পিঠের দিক স্পর্শ করিয়ে প্রতীকী হাত মিলাই। এভাবেই জনে জনে শুরু হয়ে যায় করোনা নিয়ে আলোচনা। শুরুর দিকে বাংলাদেশি প্রবাসীদেরও দেশে ফিরে আসার হিড়িক পড়ে যায়। তাদের না এসে উপায় ছিলো না অবশ্য। কারণ প্রবাসে পরিচর্যার লোক যেমন নেই তেমনি লক ডাউনের কারণে অনেকের চাকরিও ছিলো না। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়ে তাদের দেশে ফিরে আসা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। কিন্তু তাদের অনেকের মধ্যে সেই মাত্রার সচেতনতা কিংবা সাবধানতাও ছিলো না। শুরুর দিকে তারা অনেকেই এটাকে ছেলেখেলা হিসেবে মনে করেছিলেন। বিমান বন্দরে কোয়ারেন্টাইনের জন্যে চৌদ্দ দিনের আলাদা ব্যবস্থার কথা বলা হলে কেউ কেউ কর্তৃপক্ষকে যেমন গালিগালাজ করেছিলেন, তেমনি চিৎকার চেঁচামেচি করে হৈ হুল্লোড় ফেলে দিয়েছিলেন। সরাসরি ঘরে যেতে না দিলে নিজেদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা উল্লেখ করে আবেগীয় পরিস্থিতি তৈরি করেন। এ সময় তারা নিজেদের দূরদর্শিতা ও স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি রহিত ছিলেন। ফলে করোনা অপ্র্যাশিত দ্রুততায় অপ্রস্তুত বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়। পাশাপাশি এমন কয়েকজন অভিভাবক মাকেও দেখেছি, করোনার শুরুতে সরকার স্কুল কেন বন্ধ দিচ্ছে না, বাচ্চারা অতিশয় অনিরাপদ--এই বলে খেদোক্তি করতে। আবার এই মায়েরাই পরবর্তী সময়ে সরকার যখন বাধ্য হয়ে দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিচ্ছিলো, তখন তাদের বাচ্চাদের লেখাপড়া ধ্বংস হয়ে গেছে বলে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। পরন্তু কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস যখন চালু হলো তখনও আবার এনাদের সমস্যা দেখা দিলো। এনারা ডিভাইস হাতে বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে রব ওঠালেন।

সরকার প্রথমবার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সতের মার্চ দুহাজার কুড়ি সাল থেকে। তার আগের সন্ধ্যা ও রাতে আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজের মাঠে একজন আমজনতারূপে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে ছিলাম। ওখানেই শুনতে পাই পরদিন থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর সাথে সাথে পরদিন থেকে অনুষ্ঠিতব্য মুজিব জন্মশতবর্ষের সকল অনুষ্ঠানও স্থগিত হয়ে গেলো।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাইশে মার্চ দুহাজার কুড়ি সাল হতে, দশ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। এ ছুটি পরবর্তীতে সাত দফা বাড়িয়ে ত্রিশে মে পর্যন্ত করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ এগার সেপ্টেম্বর দুহাজার একুশ তারিখে সরাসরি ক্লাসের জন্যে খুলে দেয়া হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মিউটেশনে তৈরি হওয়া নতুন রূপ ওমিক্রনের বিস্তারের কারণে দুহাজার বাইশ সালের ছয় ফেব্রুয়ারি থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দু দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়। সারা বাংলাদেশের মতো চাঁদপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতেও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন, ফেইস মাস্ক বিতরণ করা হয়।

পার্শ্ববর্তী লকডাউনে থাকা এলাকা থেকে বিধিনিষেধ ভেঙ্গে নৌপথে চাঁদপুর আসা এক তরুণের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার মাধ্যমে চাঁদপুর কাগজে কলমে প্রথমবার করোনাক্রান্ত হয়। পাঁচ এপ্রিল দুহাজার কুড়ি সালে ওই তরুণ চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় শ্বশুরবাড়িতে আসেন। নয় এপ্রিল বৃহস্পতিবার নমুনা পরীক্ষায় তার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। চাঁদপুরের তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। করোনা শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে জেলা প্রশাসন, চাঁদপুর নয় এপ্রিল বৃহস্পতিবার হতে সারাজেলা লকডাউন ঘোষণা করেন। নয় এপ্রিলের ছয়দিন পর, পনের এপ্রিল বুধবার চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তি শনাক্ত হয়। পনের এপ্রিল সিভিল সার্জন কার্যালয়ে আইইডিসিআর থেকে রিপোর্ট আসে, মৃত ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ হতে আগত ওই ব্যক্তি শনিবার এগার এপ্রিল বিকেলে চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা গ্রামে তার শ্বশুর বাড়িতে মারা যান। শ্বাসকষ্টসহ করোনার বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এ ঘটনায় ওই দিনই করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে দাফনও করা হয়। ফয়সাল নামের একচল্লিশ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের পাঠানতলী এলাকায় বসবাস করতেন। তার পৈত্রিক নিবাস মতলব উত্তর উপজেলার কাসিমপুর পাদুয়া মুন্সি বাড়িতে। নারায়ণগঞ্জের এসিআই ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি।

করোনাকালে কিছু কিছু শব্দ বা পদবাচ্য এযুগের মানুষের কাছে নতুন হয়ে ধরা দেয়। পিপিই, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, ট্রায়োজ, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স ইত্যাদি মানুষকে করোনা বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলে। এ সময় মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে প্রশাসন হিমশিম খায়। যতই বলে ভিড়ে না যেতে, হাঁচিকাশি জনসমক্ষে না দিতে, ততই যেন নিয়ম ভাঙ্গার প্রতিযোগিতা চলে। সোশ্যাল ডিস্টেন্স তো দূরের কথা। মনে হয়, সকল ভালো জিনিস মিশে আছে বাজারের ভিড়ে, মার্কেটের জনারণ্যে। তিন ফুটের ব্যবধান তিনমুষ্টির চেয়েও কমে আসে মানুষের অসচেতনতা ও আইন অমান্যতায়। খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট হলেও সরকার, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, দানশীল ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চাউল, ডাল, তেল, পিঁয়াজ, আলু, সাবান সাধ্যমতো দেওয়া হয়। কাউকে কাউকে নগদ আড়াই হাজার করে টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়। সহযোগিতা হয়তো অপ্রতুল, কিন্তু চেষ্টায় ঘাটতি ছিলো না। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বিষয় ছিলো, মা-বাবা আক্রান্ত হলে ছেলেমেয়েদের পরিচর্যায় অসম্মতি। কেউ কেউ আক্রান্ত বাবা-মাকে ঘরের বের করে দেয়। আক্রান্ত মাকে শিশু হতে আলাদা রেখে দেওয়ায় শিশুর অভিব্যক্তিও ছিলো দেখার মতো। করোনায় অনেক মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হয় এবং শহর ছাড়তে বাধ্য হয়। অনেক লোক কর্মহারা হয়ে পড়ে।

আমাকে করোনা শুরুর প্রাক্কালে বাসা পাল্টাতে হয়। দুহাজার কুড়ি সালের মার্চের কুড়ি-বাইশ তারিখে আমি বাসা পাল্টিয়ে নিকটস্থ নাভানা হাসপাতালের চারতলায় আসি। স্টেডিয়াম রোডের শিউলি ভিলা থেকে নাভানার চারতলায় এসে একটু বেকায়দায় পড়ে যাই। কারণ হাসপাতাল হওয়ায় জেলা প্রশাসনের বাধ্যবাধকতার জন্যে কর্তৃপক্ষ আমার ওপাশের ফ্ল্যাটকে করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড ঘোষণা করে। ফলে প্রতিনিয়ত আমার পরিবারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। আমি চিকিৎসক হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সুবিধা হয়ে যায়। আমাকে রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার দেখিয়ে তারা করোনাকালে দিব্যি হাসপাতাল চালিয়ে যায়। অথচ আমি বাসায় ওঠার সময় তারা হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়ে শুধু ডাক্তারের চেম্বার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু রেখেছিলো। আমি তখনও পিপিই পাইনি। সরকারি হাসপাতাল ও প্রশাসনের অনেকেই সরকারের তরফ থেকে পিপিই পেয়েছে। আমি বেসরকারি চিকিৎসক বলে পিপিই দেওয়ার কোনো কর্তৃপক্ষ ছিলো না। ঔষধ কোম্পানির পক্ষ থেকে বেক্সিমকো প্রথম আমাদের পিপিই দেয়। প্রথম দুসপ্তাহ বন্ধ রাখার পর পিপিই পেয়ে চেম্বার শুরু করি। চেম্বারে রোগীকে একটু দূরে বসাই। আর আমি ফেসশিল্ড ব্যবহার করে রোগী দেখতে শুরু করি। এ সময় জ্বরের রোগী এলে মনে হয় আমার নিজেরই জ্বর উঠে যেতো ভয়ে। পিপিইগুলো এতো গরম ছিলো, ঘামে ভিজে যেতো শরীর। তাই পুরো সেট পিপিই বেশিদিন পরিনি। টেলিফোনে কয়েকশ করোনাক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত আসার কষ্ট ও ভয় লাঘব করে দিয়েছি। আমার নিজের তিন মামাও করোনাক্রান্ত ছিলেন। তারাও টেলিফোনে চিকিৎসায় সেরে ওঠেন। চাঁদপুর বিএমএ থেকে বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের ফোন নম্বর ছাপিয়ে রোগীদের মধ্যে অনলাইনে বিতরণ করা হয়, যাতে করোনাক্রান্ত হলে চিকিৎসা নেওয়া যায়। আমার ফোন নম্বরও এতে দেওয়া ছিলো। রাতেদিনে অনেককেই উত্তর দিয়েছি ফোনে চিকিৎসার মাধ্যমে। প্রথম দুমাস রোজগারের সংকট দেখা দিলেও পিপিই পাওয়ার পর সে সংকট দূর হয়। ফলে নিজের পেট চালানোর পাশাপাশি আমার পত্নীর নেতৃত্বে চলমান সাংস্কৃতিক সংগঠনের কয়েকজনকেও সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ হয়। করোনাকালে পত্রিকাগুলো বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। পাঠক কমে যায় এবং কেউ পত্রিকা রাখার সাহস দেখাতো না। দুপুর দুটোয় মনোযোগ ও উৎসাহ নিয়ে শুনতাম অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনার করোনা ব্রিফিং। এ যেন অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদের মতো ছিলো। জেলা প্রশাসকের আহ্বানে আমার পত্নী তার সংগঠনের মাধ্যমে অনলাইনে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি চালাতে শুরু করলো। খুব স্বল্প পরিসরে। আমার দুছেলে, তাদের মা আর আমি। মাঝে মাঝে আবু বকর সিদ্দিক ও অন্যরা আসতো। মিঠুনও ছিলো। এর উদ্দেশ্য ছিলো, করোনা ভীতি কাটানো, মানসিক বিষণ্নতা দূর করা এবং মানুষকে করোনাযুদ্ধে মানসিক শক্তি দেওয়া। শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে আর্ট এগেইনস্ট করোনা কর্মসূচিতে জুম প্লাটফর্মেও অংশ নিয়েছি। এ সময়ে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে আমার লেখা ও কণ্ঠে ছড়া কলাম শুরু হয়। প্রতিদিন এক এক বিষয় নিয়ে ছড়া লিখে ও পড়ে পাঠাতাম। কাজী শাহাদাত ভাইয়ের নির্দেশে কাওসার তা পরিচালনা করতো।

আমার বিকেলের কিছু সময় কাটতো ছেলেদের পড়িয়ে। কিছু সময় কাটতো নিজে বই পড়ে। এর পাশাপাশি লেখালেখিও চলেছে। চারতলার বারান্দায় বসে রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে পৃথিবীর আত্মশুদ্ধির প্রয়াস আমি দেখেছি। রাস্তায় কোনো গাড়ির ধোঁয়া ছিলো না, ছিলো না বর্জ্যের বাড়াবাড়ি। আমি আকাশের খইরঙা মেঘ দেখে দেখে বিকেলের গোধূলিকে আলিঙ্গন করতাম দুচোখের মমতায়। আমি আর বন্দি পাখির মধ্যে কোনো ভেদ ছিলো না তখন। ঘরে বসে বসে শিশুকিশোর উপযোগী দুটো পাণ্ডুলিপি তেরি করা হলো ‘ভুতুড়ে পাখা’ ও ‘লুই পা’র কলম’ শিরোনামে। বই দুটো প্রকাশিত হয়েছিলো প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স থেকে। একটি করোনা সংকলন বের করেছিলেন কবি খসরু পারভেজ, ‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়’ শিরোনামে। এই সংকলনে আমার একটা কবিতা স্থান পেয়েছে।

করোনামুক্তির ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে নারীর অবদান অপরিসীম। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম করোনা ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেন জেনিফার হ্যালার নামের চৌত্রিশ বছর বয়স্কা দুই সন্তানের এক জননী। বাংলাদেশে প্রথম করোনা টিকা নেন ঢাকা কুর্মিটোলা ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালের সেবিকা রুনু ভেরোনিকা কস্তা। করোনার টিকা আবিষ্কার করে দুহাজার তেইশ সালে দুজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পান। এরা হলেন : হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী ক্যাটালিন ক্যারিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রু ওয়েইসম্যান। সারাদেশের মতো চাঁদপুরেও সাত ফেব্রুয়ারি তারিখে করোনা টিকা দেওয়া শুরু হয়। প্রথম দফায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টিকা বরাদ্দ ছিলো। আমি ও আমার পত্নী দুজনে দু-একদিন পরে টিকা নিই। টিকা বিনামূল্যে দিলেও মানুষকে টিকা নিতে রাজি করাতে সরকারকে বেশ কসরত করতে হয়েছো। বরাবরের মতো এদেশের অনেকেই টিকার বিরুদ্ধে নানা গালগল্প ছড়াতে শুরু করে এবং ভারত বিরোধিতা যোগ করে তাতে টিকা নেই পানি আছে শিরোনামেও অপপ্রচারে লিপ্ত থাকে। কেউ কেউ টিকা নেওয়ার পর তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াকে এতো রংচং মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন যে, এই মুর্খামি বলার মতো নয়। তারপরও প্রায় সবাই টিকার আওতায় চলে আসে। বয়স্ক ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়োজিত ব্যক্তিদের চার ডোজ টিকা দেওয়া হয়। বেশির ভাগ মানুষ তিন ডোজ টিকা নিয়েছেন। স্কুলের শিক্ষার্থীরাও দু ডোজ টিকার আওতায় এসেছে। টিকাকে কেন্দ্র করে সম্পন্ন ঘরের নারীদের বিশেষ ধরনের ব্লাউজ সেলাই করে নিতে দেখা যায়, যাতে সহজে টিকা নেওয়া যায়। চাঁদপুর সদর হাসপাতালে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার সুযোগ ছিলো যাতে কারও খারাপ লাগলে তা প্রতিকার করা যায়।

করোনাকালে প্রমাণিত হয়ে যায় আরও একবার, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের সেই অমিয় বাণী। বাঙালি হলো ব্যাঙের মতো। তাকে মাপা যায় না। সব সময় তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে পড়ে নিক্তি থেকে। একদিকে যেমন অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়ার নিষেধ মানেনি, তেমনি অন্যদিকে ফেস মাস্কও ঠিকমতো ব্যবহার করেনি। কেউ নাকে, কেউ নাকের নিচে, কেউ কপালের ওপরে, কেউ এক কানে মাস্কটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে। কেউ কেউ সেই যে কোন্ কালে একটা কিনেছে, তা আর পাল্টানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। আবার কনুইতে হাঁচি সামলানোর কথা বলা হলেও হাটেমাঠেঘাটে বহাল তবিয়তে ধূমপান বজায় রেখেছে, সাথে ফ্রি কাশি। করোনাকাল একটা নতুন স্বেচ্ছাসেবক শ্রেণি তৈরি করে দিয়ে গেছে। কেউ কেউ বাজার করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে বিকাশে টাকা পেয়ে, কেউ কেউ ঘরে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়ে গেছে। চাঁদপুর রোটারী ক্লাব নিজ উদ্যোগে কয়েকটা অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণ করেছে রোগীদের স্বার্থে। চাঁদপুরে ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ ট্রাস্টের পক্ষে পিসিআর ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে করোনা শনাক্তকরণ সহজ ও সুবিধাজনক হয়েছে। দুশ পঞ্চাশ শয্যার চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন হওয়ায় আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসকষ্ট দূরীকরণ সহজ ও সম্ভব হয়েছে। করোনাকাল সেইসব অকুতোভয় নিঃস্বার্থ মানুষদেরও চিনিয়ে দিয়ে গেছে, যারা নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে করোনায় মৃত মানুষদের দাফন করেছে। চাঁদপুরের করোনাকাল বিশেষত মনে থাকবে একটি চিকিৎসক দম্পতির জন্যে। ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল এবং ডা. সাজেদা পলিন। দুজন তাদের নিজেদের অবস্থানে থেকে করোনা মোকাবেলায় সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছেন। করোনাকে জিতলেও ডা. রুবেল জীবনকে জিততে পারেননি। দুহাজার তেইশের দুই সেপ্টেম্বর তারিখে রুবেল চলে গেছে তার চূড়ান্ত গন্তব্যে। করোনায় নয়, ভিন্ন কোনো অসুখে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়