মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৩

আগুনের নদী

মিজানুর রহমান রানা
আগুনের নদী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এগারো.

রাত প্রায় তিনটা। জুতোর আওয়াজে ঘুম ভাঙলো জামশেদের। চোখ দুটি খুলতেই অপার বিস্ময় অপেক্ষা করলো তার সামনে। ইরফান সাইলেন্সার লাগানো রিভলবারটি তার দু চোখের মাঝখানে ধরে আছে। প্রথমে সে ভাবলো স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করে দেখলো, এটা স্বপ্ন নয় বাস্তব।

হঠাৎ করেই সে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এখানে কীভাবে? আমার সশস্ত্র প্রহরী ভেদ করে এখানে এলে কীভাবে?’

‘তোমার সব প্রহরী, সশস্ত্র গুণ্ডাদেরকে তোমার পার্টির পানীয়ের সাথে ঔষধ মিশিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। গতকাল যে মেয়েটি চিকিৎসক হিসেবে তোমার চাকুরি নিয়েছে সে আমার গুপ্তচর ছিলো। তার দেহে জিপিএস সিস্টেম ছিলো। তা অনুসরণ করে আমিও তোমার কাছে পৌঁছে গেছি জামশেদ। ওঠো। ঘুম থেকে ওঠো।’

জামশেদ ভাবলো সারাজীবন এতো সাবধান থেকে সামান্য এক নারীর ছলনায় সে পরাজিত হয়ে গেলো। সে ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি চিকিৎসক হিসেবে চাকুরির প্রস্তাবে একজন নারী তার সারাজীবনের খেল খতম করে দিবে।

‘কী ভাবছো জামশেদ?’ তাড়া দিলো ইরফান ‘তুমি আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলে তাই না? দেখো আজ সেই অস্ত্রের নিশানায় তুমিই পড়ে গেছো। আশা করছি তোমাকে বাংলাদেশে নিতে হবে না। এখানেই রেখে যেতে হবে। ওঠো।’

উঠে বসলো জামশেদ। এমন সময় একটি গুলি ইরফানের বুকের পাশ দিয়ে শিষ কেটে চলে গেলো। পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো নিয়াজকে। ঘুম ঘুম চোখে টলছে নিয়াজ, তাই তার গুলির নিশানা ব্যর্থ হয়েছে। খুবই দ্রুত নিয়াজকে গুলি করলো ইরফান। বুকের বাম পাশে গুলি খেয়ে নিয়াজ আর্তচিৎকার করে পড়ে গেলো। তারপর দ্রুতই আবার জামশেদের দিকে রিভলবার তাক করলো ইরফান। তারপর বললো, ‘এটাকে ঘুমের ঔষধ বেশি করে খাওয়ানো হয়নি হয়তো, তাই মৃত্যুদূত ওর সাথে চিরঘুমের জন্যে সাক্ষাৎ করেছে। তুমি এবার কী করবে জামশেদ?’

জামশেদ ভাবছে। কী হতে কী হয়ে গেলো! সে জানতো ইরফান তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু এই দুর্ভেদ্য কটেজেও সে চলে আসতে পারবে সেটা তার ভাবনায়ও ছিলো না।

এমন সময় আবারও গুলির আওয়াজ পেলো ইরফান। গুলিটা তার ডান বাহু ছুঁয়ে চলে গেলো। পেছনে ফিরতেই ইলিয়াস মণ্ডল ও সুমনকে দেখতে পেলো ইরফান। পেছন ফিরতে দেরি, তার হাত থেকে দুটো গুলি বের হতে সময় লাগলো না। ইলিয়াস মণ্ডল ও সুমন গুলি খেয়ে কুকুরের মতো ছটফট করতে লাগলো। এ সময় পাশের কামরা থেকে বের হয়ে এলো অধরা, অনন্যা ও মোনালিসা। মোনালিসা তার বাবার মৃত্যু দৃশ্য দেখে হেসে উঠলো, তারপর বললো, ‘বাবা আমি তোমাকে বলছিলাম না? পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। আজ কি তুমি তার প্রমাণ পেয়েছো? তোমার যতোই যন্ত্রণা হচ্ছে আমার মনে ততোই আনন্দ লাগছে। তুমি আমার প্রিয় মানুষটাকে ভয়াবহভাবে খুন করে নদীতে ভাসিয়েছো। আজ তোমার পরিণতি এমনটাই হওয়া উচিত ছিলো।’

ইরফান জামশেদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। ধীরে ধীরে ট্রিগারে হাত নিচ্ছে। এমন সময় কথা বলে উঠলো জামশেদ। সে বললো, ‘আমাকে মারার আগে আমি কিছু কথা বলতেই চাই এএসপি ইরফান সাহেব। আমাকে কি একটা মিনিট সময় দেওয়া যাবে?’ ইরফান হাসলো। তারপর বললো, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন ডনের মুখে এমন সরল কথা শুনে আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে তুমি সত্যিকার জামশেদ নও। যে জামশেদ মানুষকে টুকরো টুকরো করে বাথরুমের কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিতে পারে, সেই জামশেদ এতোটা সরল হবে, এটা তো আমি বিশ্বাস করতে পারি না। তুমি কথাচ্ছলে হয়তো সুযোগ নিতে চাইবে। আর আমাদেরকে কুপোকাত করার শেষ সুযোগ হাতছাড়া করবে না। তাই না?’

জামশেদ ইরফানের কথার উত্তর না দিয়ে বলতে লাগলো, ‘শোনো এএসপি ইরফান। আমার পরিকল্পনায় ডিআইজি নজির সাহেব রিটায়ার্ড করার আগেই কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে। এখন সে সিঙ্গাপুর আছে। আগামীকাল যাবে কানাডায় তার নিজ রিসোর্টে। তুমি সামান্য চাকুরি করে সারাজীবন কতো টাকা রোজগার করতে পারবে। তারচেয়ে রিভলভারটি ঘোরাও, আমার সাথে হাত মেলাও। তোমাকে ডিআইজি নজিরের চাইতে হাজার গুণ বেশি সম্পদশালী করে দিবো এক মাসের মধ্যে। তোমার আর বাংলাদেশে যেতে হবে না। এই দেশে অথবা কানাডায় নবাবী জীবনযাপন করতে পারবে। তোমাকে সব ধরনের সুন্দরী ললনা মিলিয়ে দিবো। যেটা মনে চায় বেছে দু-একজনকে নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে জীবনটা কাটিয়ে দিবো উল্লাসে।’

‘তাই নাকি? তারপরও তুমি বেঁচে থাকতে চাও?’

‘হ্যাঁ, আমি তো বাঁচবোই। বাঁচবো না কেনো? এমন লোভনীয় প্রস্তাব কেউ ফিরিয়ে দেয় নাকি? নজির সাহেবকেও তো আমি রাজা বানিয়ে দিয়েছি। কোটি কোটি টাকা নিয়ে এখন তিনি কানাডার পথে।’

‘শোনো জামশেদ। তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি। তবে একজনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।’ খুশিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো জামশেদ। সে মনে মনে ভাবলো, ঘুঘু এবার ধান খেতে এসেছে। ধান ক্ষেতে যে ফাঁদ পাতা আছে ঘুঘু সেটা জানে না!

ইরফান এক হাতে জামশেদের দিকে অস্ত্র তাক করে অপর হাত দিয়ে মুঠোফোনে কল করলো। অপর প্রান্ত থেকে কল রিসিভ করলেন ডিআইজি আজহারুল ইসলাম। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ ০০৪। বলো তোমার রোগীর খবর কি?’

‘স্যার বেডে বসে আছে। সে বলছে তার কোনো সমস্যা নেই। আমাদের যদি কোনো সমস্যা থাকে সে সলভ করে দিবে। এখন আমরা কী সিদ্ধান্ত নিবো?’

‘ওখানকার রোগী ওখানেই চিকিৎসা করে আসো। এই দেশে আনার তো সিস্টেম নেই।’ উত্তর দিলেন ডিআইজি আজহারুল ইসলাম। তারপর বললেন, ‘ওকে বলো সবাইকে সে যেনো নজির আহমেদ না ভাবে। নজিরের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। শীঘ্রই তাকে আমরা দুদকের মামলায় কোর্টে হাজির করবো। তারপর তারও বিচার হবে নিয়ম মতোই। তবে তোমার রোগী যেহেতু এমন দেশে আছে, যে দেশ থেকে আমরা নিয়মমতো আনতে পারছি না, সেহেতু তাকে সেখানেই চিকিৎসা দিবে, যাতে সে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে পারে। আর যাতে জীবনে কখনোই সুখে থাকতে ভূতে না কিলায়।’ কথাগুলো বলেই হাসলেন তিনি।

কল রেখে দিলেন ডিআইজি আজহারুল ইসলাম। এতোক্ষণ লাউড স্পিকারে কথা শুনছিলো জামশেদ। সে প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে?’

‘যেহেতু তোমার অধরা নামের একজন প্রাইভেট চিকিৎসক আছে, সেহেতু বসের কথা অনুসারে চিকিৎসার ভারটা তারও উপর।’ এই বলে অধরাকে ইঙ্গিত করলো ইরফান। অধরা তার পকেট থেকে কালো লিকুইডযুক্ত একটা সিরিঞ্জ বের করলো। তারপর সেটা ধীরে ধীরে পুশ করতে গেলো জামশেদের শরীরে। পাশে থেকে অনন্যা অধরার কাছাকাছি হলো। তারপর বললো, ‘অধরা, কাজটি আমাকেই করতে দিন। আমি চাই, যার ভুক্তভোগী আমি তাকে নিজ হাতে ওই বিষের সিরিঞ্জটা শরীরে প্রবেশ করিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণাটা বুঝিয়ে দেই। তার ইশরায় আমিনুল আমার জীবনটা বাঁধভাঙ্গা ঢলের মতো করে দিয়েছে। আমিই তাকে শাস্তিটা দিতে চাই।’

ইরফানের দিকে তাকলো অধরা। ইরফান সায় দিলো। অনন্যা অধরার হাত থেকে বিষযুক্ত সিরিঞ্জটা নিয়ে একটু চারদিকে ঘুরলো। এরপর মুচকি হাসলো। সিরিঞ্জটা এদিক সেদিক করে ধীরে ধীরে জামশেদের বাহুতে পুশ করে দিলো। আস্তে আস্তে নিঃস্তেজ হয়ে পড়লো জামশেদ। তারপর ঠাস্ করে পড়ে গেলো বিছানায়।

ইরফান সবাইকে দ্রুত তার সাথে আসার নির্দেশ দিলো। সাথে সাথেই অধরা, মোনালিসা ও অনন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে।

হোটেলের কামরায় সকালে এসে প্রবেশ করলো। সবাই ব্রেকফাস্ট সেরে নিলো।

তারপর অনন্যাকে বললো, ‘তুমি যাকে খুন করেছো তার জন্যে তোমার নামে বাংলাদেশে একটি মামলা হয়েছে। তুমিও আমার সাথে চলো, যেহেতু তুমি আমিনুলের নির্যাতনে নিজকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে খুন করেছো, তাই তোমার বিচারে যাতে সাজা কম হয় সেজন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো। যতদিনই সাজা হোক, পাঁচ থেকে সাত বছর হতে পারে। তারপর তুমি নতুন জীবন লাভ করবে। আর মোনালিসা তুমিও চলো। তোমার স্বামীও যেহেতু নেই। বাংলাদেশে গিয়ে তুমি যাতে তোমার একটা আশ্রয়স্থল খুঁজে পাও সে জন্যে আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো।’

‘আর আমি?’ অধরা প্রশ্ন করলো।

হাসলো ইরফান। তারপর বললো, ‘তুমি তো আইসল্যান্ডেই ফিরে যাবে। তোমার চাকুরিতে, তোমার বাবা মায়ের পাশে।’

অধরা নিশ্চুপ। কোনো কথা বললো না। সে কাঁদছে।

‘কী হয়েছে তোমার, তুমিও কি বাংলাদেশেই যেতে চাও?’

‘হ্যাঁ। প্রায় ৫ বছর হয়েছো বাংলাদেশে যাইনি। তোমার সাথেই যেতে চাই। ঘুরে আসবো।’

‘ঠিক আছে। আজ আমরা সবাই ঘুরবো, কেনাকাটা করবো। আগামীকালের ফ্লাইটে সবাই বাংলাদেশে রওয়ানা হবো। ঠিক আছে?’

এবার অধরা কান্না ভুলে হাততালি দিলো। গভীর আনন্দ লাগছে তার কাছে।

বিকেলে সবাই বেরিয়ে পড়লো। একটা সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করছিলো ইরফান। এ সময় হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো অনন্যা নেই। পেছনে শুধু মোনালিসা ও অধরা আছে। ‘অনন্যা কোথায়?’ অধরাকে প্রশ্ন করলো ইরফান।

অনন্যা ও মোনালিসা চারদিকে তাকালো, কিন্তু অনন্যাকে খুঁজে পেলো না। তারা সবাই মিলে পুরো মার্কেট খুঁজলো, মার্কেটের বাইরেও খুঁজলো কিন্তু অনন্যা নিরুদ্দেশ। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়