প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৭
বিরল রক্তের গ্রুপ : বোম্বে ব্লাড গ্রুপ
![বিরল রক্তের গ্রুপ : বোম্বে ব্লাড গ্রুপ](/assets/news_photos/2025/02/10/image-58801-1739149730bdjournal.jpg)
মানুষের জীবনীশক্তিকে যে তরল দীপ্যমান রাখে তার নাম রক্ত। জীবন বঁাচানোর প্রয়োজনে রক্ত দিতে বা নিতে হলে রক্তের গ্রুপ জানা অতি জরুরি। কার্ল ল্যান্ড স্টেইনারের হাতে রক্তের গ্রুপ সনাক্ত হওয়ার পর থেকেই মানুষ রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে শিখেছে। বিশ্ব রক্ত পরিসঞ্চালন সমিতির হিসাব মতে মানুষের ক্ষেত্রে এ অব্দি মোট একচল্লিশ ধরনের রক্তের গ্রুপ নিরূপণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে সবকটা পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। রক্তের লোহিত কণিকার পৃষ্ঠতলে অ্যান্টিজেন নামক একধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে যাদের উপস্থিতির কারণে রক্তে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান তৈরি হয়। মূলত লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠতলে এই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির কারণে রক্তের গ্রুপে ভিন্নতা দেখা দেয়। এ-বি-ও-এবি ধরনের সাধারণ ব্লাড গ্রুপের পাশাপাশি রক্তে একটি ভিন্ন ও বিরল গ্রুপের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এই বিরল রক্তের গ্রুপের নাম বোম্বে ব্লাড গ্রুপ।
বোম্বে ব্লাড গ্রুপ আবিষ্কৃত হয়েছিলো ১৯৫২ সালে তৎকালীন বোম্বে শহরে, ডা. ওয়াই. এম ভেন্ডে কর্তৃক। তিনি যখন দেখলেন, একজন ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ সবধরনের রক্তের গ্রুপের সাথে বিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তখনই তিনি ঐ ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে মনোযোগী হলেন। ঐ ব্যক্তির রক্তের লোহিত কণিকায় এ, বি এবং এইচ নামের অ্যান্টিজেনগুলোর ঘাটতি ছিলো। কিন্তু রক্তের সিরামে অ্যান্টি-এ, অ্যান্টি-বি ও অ্যান্টি-এইচ অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়।
বোম্বে ব্লাডগ্রুপের অধিকারীরা কেবল অন্য বোম্বে ব্লাড গ্রুপের ব্যক্তিদের রক্তই গ্রহণ করতে পারে। তনে তারা এ-বি-ও-এবি রক্তের গ্রুপের যে কাউকে রক্ত দান করতে পারে। এই ব্লাডগ্রুপ ইউরোপে প্রতি দশ লাখে একজন এবং ভারতে প্রতি দশ হাজারে একজনের মধ্যে পাওয়া যায়। এইচ নামক জিনের পয়েন্ট মিউটেশনের কারণে বোম্বে ব্লাডগ্রুপ তৈরি হয়। আর মিউটেশন ঘটে ফুকোসিল ট্রান্সফারেজ নামক একধরনের প্রোটিন জাতীয় এনজাইমের অপর্যাপ্ত উৎপাদনের কারণে। উল্লেখ্য, এইচ-অ্যান্টিজেন তৈরিতে ফুকোসিল ট্রান্সফারেজ প্রয়োজন হয়। রক্ত সঞ্চালনোত্তর জটিলতা এড়াতে ব্যক্তির রক্তে বম্বে ফেনোটাইপ নিরূপণ করা জরুরি। যদিও সাধারণত এই গ্রুপকে ও-গ্রুপ বলে দেখানো হয় ভুলবশত।
এইচ-এইচ ফেনোটাইপের এ রক্তের গ্রুপ বিরল বিধায় কোন ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক এক ইতিহাসে বলে, ২০১৭ সালে কলম্বিয়ার এক ব্যক্তির এ ব্লাডগ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়েছিলো। তখন ব্রাজিল থেকে এ রক্ত নিয়ে যেতে হয়েছিলো। সারা ব্রাজিলে ওই সময় মাত্র তিনজন নিবন্ধিত বম্বে ব্লাড গ্রুপের অধিকারী ছিলেন। বোম্বে ব্লাড গ্রুপের অধিকারি সন্তানের বাবা-মা উভয়েই সাধারণত বোম্বে ব্লাড গ্রুপের অধিকারী হয়ে থাকেন। কিছু কিছু অভিজাত পরিবার আভিজাত্য ধরে রাখতে নিজেদের পারিবারিক সদস্যের মধ্যে বিবাহপ্রথা চালু রাখে। এ ধরনের পরিবারেও বোম্বে ব্লাডগ্রুপ পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রথম বোম্বে ব্লাড গ্রুপ সনাক্ত হয়েছিলো নারায়ণগঞ্জের এক ব্যক্তির দেহে। একই পরিবারের তিনজন আপন বোন পাওয়া গেছে বাংলাদেশে, যাদের রক্তের গ্রুপ বম্বে ব্লাড গ্রুপ। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে সানজিদা নামের পঁাচ মাসের এক গর্ভবতী মায়ের রক্তে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ শনাক্ত করা হয়। এ বিভাগ হতে পাওয়া তথ্যমতে, এখনও পর্যন্ত সনাক্ত করা তালিকায় দেশে বোম্বে ব্লাডগ্রুপের রক্ত আছে চল্লিশ জনের শরীরে। সারা বিশ্বে বোম্বে গ্রুপের রক্ত বহনকারী মানুষের সংখ্যা মাত্র আটাশ হাজার। উনিশশো বাহান্ন সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে বোম্বে গ্রুপের রক্ত নিয়ে ভারতীয় চিকিৎসক ওয়াই এম ভেন্ডে, সি কে দেশপান্ডে ও এইচ এম ভাটিয়া একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তাতে উল্লেখ আছে, ভারতে তৎকালীন একটি হাসপাতালে আহত একজন রেলশ্রমিকের শরীরে প্রথম এই রক্তের গ্রুপটি শনাক্ত হয়। বোম্বেতে শনাক্ত হওয়ায় এবং এই নগরীতে এ ব্লাড গ্রুপের ব্যক্তি অধিক বলে চিকিৎসক ভেন্ডে এই গ্রুপের রক্তের নাম দেন বম্বে ব্লাড গ্রুপ। এই গ্রুপের রক্তকে ইংরেজি ছোট হাতের অক্ষর এইচএইচ অথবা বড় হাতের ও এবং ছোট হাতের এইচ অক্ষরে প্রকাশ করা হয়।