প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১১
ব্যক্তিগত বিনোদন
পর্ব : দুই
শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল যাত্রা পালা। যাত্রাশিল্পীদের অভিনয়, গান, নৃত্য, কারুণ্য, কৌতুক আমাকে আবিষ্ট করে রাখত। নিজেদের গ্রামে, পাশাপাশি গ্রামে কিংবা দূরদূরান্তের গ্রামেও আমি যেতাম যাত্রা দেখার জন্য। গ্রামীণ জীবনে যাত্রাশিল্পীরা ছিলেন আজকের যুগের নায়ক-মহানায়কদের মতো জনপ্রিয়। ছেলেদের কাছে যাত্রাশীল্পের নায়িকারা ছিলেন প্রেমের মূর্তিমান রূপ। এদের অভিনয় দেখে দেখে আমার মধ্যে কী একটা বোধ তৈরি হয়- আমিও যদি এদের মতো অভিনয় করতে পারতাম!
এমন সময় কোথা থেকে একজন পাগল লোকের আবির্ভাব হয় আমাদের গ্রামে। পাটকলের শ্রমিকনেতা ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবতর্নের জের হিসেবে তিনি চাকরিছাড়া হন, বিতারিত হন। বহুদিন কোথা কোথা আত্মঘোন শেষে আশ্রয় নেন আমাদের পাশের গ্রামে। তিনিই গড়ে তোলেন একটি যাত্রশিল্পগোষ্ঠী। ওই গোষ্ঠীতে অনেকের সঙ্গে আমাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিনে।
তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। অহম-দুলাল বইয়ের দুই নায়ক হয়ে গেলাম আমি এবং আমার ৫দিনের বড় জেঠাতো ভাই হান্নান। হান্নান অহম আর আমি দুলাল। দুলালের ভূমিকায় অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলাম। সেই সময় আমাকে ফেরানোর জন্য বাবা যদি কঠিন পদক্ষেপ না নিতেন, তা হলে আজ যাত্রাশিল্পী হিসেবেই আমার পরিচয় হতো। তিনি আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করেননি, তবে গৃহান্তর করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার দুই সপ্তাহের ওই জীবন আমাকে যে কত কিছু শিখিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই শেখাটাও ছিল যূথবদ্ধ জীবনের অমৃত ও গরল থেকে শেখা।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন গ্রামে রেডিও ছিল। কিন্তু ঘরে ঘরে ছিল না। ফলে বাড়িতে একটি রেডিও থাকলেও আমাদের প্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর সময় রেডিও আমাদের দখলে চলে আসত। মনে পড়ে কতগুলো অনুষ্ঠান আমাদের খুব প্রিয় ছিল। যেমন অনুরোধের আসর ‘গানের ডালি’, সৈনিক ভাইদের অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’, সুখী সংসার, দর্পণ, বাংলা ছায়াছবির গান, ম্যাগাজিন ও নাটক। রেডিও মাঝে রেখে গোল হয়ে বসে আমরা রেডিও শুনতাম। ‘আকাশের হাতে আছে’, ‘আছেন আমার মোক্তার’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘পীচ ঢালা এই পথটারে’, ‘ভালোবাসার মূল্য যে কি’, ‘যার ছায়া পড়েছে’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’- এই গান কে শোনেনি তখন! কি যে আনন্দ হতো! একা শুনে সেই আনন্দ কখনোই পাইনি।
শীত মৌসুমে অলস মানুষেরা, আকাশবাণীর ঢাকা কেন্দ্র থেকে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান, বিবিসির সংবাদ, ভয়েস অব আমেরিকার সন্ধ্যা অধিবেশন শুনে সময় কাটাতো। বিশেষ করে লাইলি-মজনু, গাজি-কালু-চম্পাবতী, শিরি-ফরহাদ, পুঁথিপাঠ, জারিসারি, কবিগান, মীর মশাররফ হোসেন মহাগ্রন্থ ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাস থেকে শুনে অনেক বর্ষীয়ানই খুশি হতেন, মাঝেমধ্যে চোখের জলও ফেলতে দেখেছিলাম। আমাদের একজন দাদি ছিলেন। আমার বাবার চাচি। এই দাদি ছাড়া আমরা আর কোনো দাদিকে দেখিনি। তিনি ছিলেন আমাদের শৈশবের পরম বন্ধু। বাবা-মার মাইর থেকে আমাদের বাড়ির প্রতিটি শিশুকে উদ্ধার করার জন্য তিনি বহুদিন বেঁচে ছিলেন। তিনি পড়তে জানতেন না। কিন্তু তার ঘরে কয়েকটা বই ছিল- মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ তার মধ্যে অন্যতম। মাঝেমধ্যেই তিনি এই বই থেকে পড়ে শোনাতে বলতেন। আমরা কারবালার প্রান্তে হাসান-হোসেনের মর্মান্তিক আখ্যান যতটা পারা যায় করুণ সুরে দাদিকে পড়ে শোনাতাম। বাড়ির আরও কয়েকজন চাচি-জেঠি এসে জড় হতেন ওই গল্প শোনার জন্য। দাদি যে আমাদের কাছ থেকেই শুনছেন তা নয়, এর আগে বহু বছর ধরে আমাদের চাচা, বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকেও তিনি বিষাদ-সিন্ধুর এই গল্প শুনতেন।
এখন আর ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ নামে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি অনুষ্ঠান ছিল রেডিওতে। বিজ্ঞাপন তরঙ্গে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি প্রচারিত হতো অনুরোধের আসর ‘গানের ডালি’ অথবা রকমারি গানের অনুষ্ঠান ‘গিতালী’। স্রোতাদের অনুরোধে প্রচারিত হতো জনপ্রিয় আধুনিক ও ছায়াছবির গান। সাধারণত সিনেমার গানের জন্য অনুরোধ আসতো ‘গানের ডালি’তে। ঘোষক বা ঘোষিকা বলতেন, ‘চুমকি চলেছে একা পথে/সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?/ হার মেনেছে দিনের আলো/রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো।’ মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের গাওয়া ‘দোস্ত দুশমন’ ছায়াছবির এই গানটার জন্য অনুরোধ পাঠিয়েছেন- লালবাগ ঢাকা থেকে পলি, সবুজ, ইয়াকুব রানা; চট্টগ্রাম থেকে সামা, শিমু, সুমন, মামুন; নারায়ণগঞ্জ থেকে শিবানী, অঞ্জন, সীমা সিদ্দিকী, আনোয়ার হোসেন; মুন্সীগঞ্জ থেকে রতন, রনি; ফেনী থেকে নুরুল আমিন হৃদয়, রাসেদ মাজহার, তানভীর; নোয়াখালী থেকে জাহান, ফরহাদ কিসলু, মায়মুনা লীনা ও শম্পাসহ আরও অনেকে। এরপর গানটি পরিবেশন করা হতো। আমরা শিশু-কিশোররা অনুরোধের আসরের এইসব গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম।
যারা চিঠি পাঠাত, গান শোনার জন্য অনুরোধ করত, তারা যে ওই গানটি একাই শুনত তা কিন্তু নয়, তাদের নাম রেডিওতে বলবে, সারা দেশের মানুষ সেই নামটি শুনবে তার সাক্ষী রাখার জন্য মনের আনন্দে সে শ্রোতা হিসেবে আরও লোক জড় করত। আর এইসব অনুষ্ঠান যারা শুনত তারও কখনোই এক একা শুনত না। অনেকে একত্র হয়ে না শুনলে সেই অনুষ্ঠান শোনার কোনো মজাই পেত না সে সময়ের শ্রোতারা।