বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাজীগঞ্জে তাল গাছ থেকে পড়ে আহত যুবকের মৃত্যু
  •   অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন চৌধুরী মারা গেছেন
  •   ছেলের মামলা-হামলায় বাড়িছাড়া বৃদ্ধা মা
  •   মতলব উত্তরে ইকবাল হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
  •   মতলবে ১০ কেজি গাঁজাসহ আটক ৩

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:০৬

অবেলায় বেলা ফুরোল

হুমাইরা জাকিয়া পুতুল
অবেলায় বেলা ফুরোল

আমি হোস্টেলে থাকি। ভার্সিটি বন্ধ হওয়ায় আজ বাড়ি যাচ্ছি। বাস চলছে প্রায় ২০ মিনিট ধরে। পেছনের সিটে বসেছি। বাসে বসার পর স্বভাবতই জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ভালো-মন্দ গল্প মনে পড়তে থাকে একে একে। সেগুলো অনেক সময় নিজের অজান্তে ঠেঁাটের একপাশে হাসির রেখা টেনে দেয়, আবার অনেক সময় মনের গহিন জায়গাটা কালো করে দেয়। তবে আজ দুটি শিশুকে দেখে সময় ভালোই যাচ্ছে।

 

প্রচণ্ড জোরে হঠাৎ ধাক্কা লাগে বাসের সঙ্গে এক ট্রাকের। ধাক্কাটা মারাত্মক ছিল। বাসের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ছিটকে পড়ল সবাই একেক দিকে। বাসের এক দিকে পুরো চ্যাপটা হয়ে গেল। আমি বেশ জোরেই আঘাত পেলাম মাথায়। মনে হয়েছিল আর বোধ হয় জীবন ফিরে পাব না। বারবার মনে প্রশ্ন জাগছিল, এখানেই কি আমার সমাপ্তি?

 

জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল। বাইরে মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। দুর্ঘটনা এলাকার মানুষ তঁারা। এখনো পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিস আসেনি। তার মানে, আমি জ্ঞানহীন অবস্থায় পঁাচ থেকে ছয় মিনিটের বেশি ছিলাম না। বাসের ভেতরটা পুরো মুচড়ে গেছে। বীভৎস অবস্থা। কে কোনটা, বোঝা যাচ্ছে না।

 

অনেকে এখনো বেঁচে আছে। গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে অনেকের। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত।

 

আশ্চর্যজনকভাবে আমার মাথায় একটুও ব্যথা হচ্ছে না। সুস্থ লাগছে।

 

ধীরে ধীরে ভাঙা জানালা দিয়ে বের হয়ে এলাম। কয়েক পা হঁাটার পর মনটা নাড়া দিয়ে উঠল। আমি চলে যাচ্ছি সুস্থ আছি বলে, আর বাসের ভেতরে ওরা যে পড়ে আছে অসহায়ের মতো! ওরাও তো বেরিয়ে আসতে চাইছে ওই মৃত্যুপুরী থেকে! ওদের তো সাহায্যের প্রয়োজন। ওদের সাহায্য করা উচিত।

 

আচ্ছা বাসের পাশের সিটে বসা দুই থেকে তিন বছরের ছোট্ট শিশু, যে কিনা বারবার তাকাচ্ছিল কৌতূহলী চোখে আমার দিকে; বারবার হেসে হেসে মুখ লুকাচ্ছিল মায়ের বুকে। সে কী অবস্থায় আছে এখন! বেঁচে আছে তো!

 

আর সেই ছেলেটা! যে সদ্য নবম শ্রেণিতে উঠেছে। আজ বাবার হাত ধরে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছে। চোখে-মুখে তার আনন্দের ঝলকানি। খুশি যেন ঠিকরে পড়ছিল চেহারা থেকে। মুখ থেকে হাসি মিলাচ্ছিলই না। তার হাসিতে যেন অসম্ভব এক শান্তি লুকিয়ে আছে। শিশুদের মতো তার বাবাকে বলছিল, ‘দেখে নিয়ো বাবা, আমি একদিন ভার্সিটির প্রফেসর হব।’

কথাগুলো শুনে তার বাবার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠেছিল।

 

ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব ভালো পড়াশোনায়।

 

কি জানি, কোন অবস্থায় আছে সে! সৃষ্টিকর্তা ভালো রেখো সবাইকে।

ইতিমধ্যে অনেক লোককে উদ্ধার করেছেন স্থানীয় লোকজন। আমি বাসে ঢুকে খুঁজতে থাকলাম শিশু দুটিকে।

 

হঠাৎ চোখ পড়ল একটা ছোট্ট হাতের ওপর। হাতটার মধ্যে ছোট কাচের তিনটি চুড়ি, কিন্তু দেহটা নেই হাতের সঙ্গে। চিনতে দেরি হলো না, ওই হাতটা যে ওই শিশুর, যে আমাকে ২০ মিনিটেই তার মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠব, ঠিক তখনই চোখ পড়ল মেধাবী ছেলেটার দিকে। নিচে শুয়ে আছে নীরব হয়ে। তার বাবুই পাখির মতো কথাগুলো চুপ হয়ে গেছে। গাল থেঁতলে গেছে। কিন্তু হাতের সেই অ্যাডমিট কার্ড হাতেই রয়ে গেছে। ওটা সে ছাড়েনি। রক্তে তার সাদা শার্ট ভরে গেছে। নিজেকে আর পারলাম না ঠিক রাখতে। হাউমাউ করে কঁাদতে লাগলাম। কী নির্মম পরিহাস! কীভাবে সহ্য করব ভেবে পাই না। মানুষ এত স্বপ্ন, এত ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে কীভাবে মরে যায়! ওরা কত্ত ছোট! এত ইচ্ছা আশা নিয়ে কীভাবে অকালে ঝরে পড়ে!

 

পারলাম না দঁাড়িয়ে থাকতে। বেরিয়ে এলাম। বের হতেই দেখি হাতবিহীন সেই শিশুর লাশ মাটিতে। মানুষ এক এক করে লাশ বের করে সারিবদ্ধভাবে রাখছে মাটিতে। হঠাৎ একটি লাশের দিকে তাকিয়ে আমার সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিছুই। এটা কীভাবে সম্ভব!

আমি তো এখানে! তাহলে মাটিতে ওই লাশ কার? আমার ড্রেস, আমার হাতঘড়ি, দেখতেও হুবহু আমার মতো! মাথায় আঘাতের চিহ্ন! বাসে তো ওকে দেখিনি! তাহলে সে কে?

ধীর পায়ে কাছে গেলাম। লাশটা স্পর্শ করলাম! কিন্তু পারলাম না। পানিতে যেভাবে হাত দিলে তা আবার অনায়াসে বের হয়ে আসে, কোনো বাধা পায় না। ঠিক তেমনি তার মাংস বা হাড়ের মধ্যে কোনো বাধা না পেয়ে আমার হাতটা অনায়াসে ফিরে এল। ধরতে পারলাম না তাকে। আমি নাকি মেয়েটা অদৃশ্য, সেটা বোঝার জন্য আরেকটা লাশ ধরলাম, কিন্তু পারলাম না। বুঝতে বাকি রইল না আমি যে মৃত। আমি আর মানুষ নেই। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কত ইচ্ছা, কত স্বপ্ন ছিল আমার। কত রাত জেগে পড়েছি বড় হব বলে, কিন্তু হলো না। বিসিএস ক্যাডার হব, মা-বাবাকে বাড়ি বানিয়ে দেব। কোনো ইচ্ছাই পূরণ হলো না।

মৃত্যু কখন কার জীবনে আসবে, আর সব স্বপ্নের ইতি ঘটাবে, বোঝা যায় না। এতক্ষণ শিশু দুটির জন্য কেঁদেছিলাম। অবেলায় বেলা ফুরিয়ে গিয়েছিল তাদের, সেই জন্য।

তখন বুঝিনি, আমারও অবেলায় বেলা ফুরিয়ে গেছে তাদের সঙ্গেই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়