প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫০
শিক্ষার দারিদ্র্য নিরসনে একটি প্রস্তাব
অনুন্নত দেশে অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের পাশাপাশি শিক্ষার দারিদ্র্যও বিরাজ করে। এখানে এক দল মানুষ শিক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে বা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। আর শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্তরা পায় নিচুমানের বা অনুপযোগী শিক্ষা। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষার যে পর্যায়ে যতটুকু শিক্ষা লাভ করা উচিত, তা সে পাচ্ছে না। এর চমৎকার উদাহরণ বিশ্বব্যাংকের তুলে ধরা একটি তথ্য। ‘কুকুরের নাম পাপি’ বাক্যটির অর্থ জিজ্ঞাসা করলে দেখা গেলÑকেনিয়া, তানজানিয়া ও উগান্ডার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীর চারজনের মধ্যে তিনজনই এর অর্থ বলতে পারেনি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশের সরকারি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষার্থী বাংলায় যতটুকু দক্ষতা প্রয়োজন, তা দেখাতে পারছে না। গণিতের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণিতে এই হার প্রায় ৬০ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ। আমার অনুমান, বাস্তব অবস্থা আরও খারাপ।
শিক্ষার দারিদ্র্যকেও দারিদ্র্যের মতো একটি ফাঁদ হিসেবে ভাবা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিচুমানের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করে যারা কলেজে শিক্ষক হচ্ছেন, তারা খারাপ পড়াচ্ছেন। কলেজে পড়ে যারা স্কুলে শিক্ষক হচ্ছেন, তারা আরও খারাপ শিক্ষক হচ্ছেন। ফলে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা যথাযথ শিক্ষা লাভ করছে না। এর পাশাপাশি অভাব থাকে ভালো গ্রন্থাগার, শিক্ষার উপকরণের। শিক্ষকদের বেতন থাকে কম বা নামমাত্র। শিক্ষকদের ভালো পড়ানোর উৎসাহ থাকে না।
এ অবস্থার কারণ কী এবং এ থেকে কীভাবে আমরা বের হতে পারি, তা নিয়ে এখন নানা বিশ্লেষণ ও পরামর্শ তুলে ধরা হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার রূপান্তরের রূপরেখা বোঝাতে একটি পরীক্ষণের কথা বলা যায়। পরীক্ষণটি করেছিলেন জর্জ রিচমন্ড নামে এক শিক্ষক। তিনি পড়াতে এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের গরিবদের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শ্রেণিকক্ষে গিয়ে তিনি দেখলেন, শিক্ষার্থীরা হইচই করছে। তিনি যা পড়ানোর চেষ্টা করলেন, তার দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, ছেলেদের মধ্যে বেশ মারধর হয়। শ্রেণিতে যে সবচেয়ে দৈহিকভাবে শক্তিশালী, সবাই তার অনুগত ও তার কথা শুনে চলে। শিক্ষকদের তারা একেবারেই তোয়াক্কা করে না। তাদের পড়ানোর সব চেষ্টাই ব্যাহত হয়। অনেকে ভাবতে পারেন, এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু তা নয়।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের শ্রমিক শ্রেণির ছেলেমেয়ের মধ্যে একই বিষয় তুলে ধরেছেন পল উইলিস তাঁর যুগান্তকারী গবেষণায়, যা পরে প্রকাশিত হয়েছে ‘লার্নিং টু লেবার’ শিরোনামে গ্রন্থে।
জর্জ রিচমন্ড বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে ক্লাসে এসে ঘোষণা করলেন, তিনি একটি খেলার আয়োজন করেছেন। তিনি ক্লাসে এক থেকে পাঁচশ ডলারের কিছু ফটোকপি দেখিয়ে বললেন, বানান ও গণিত পরীক্ষায় যে যত নম্বর পাবে, সে তত বেশি কাগজের ডলার পাবে। মাস শেষে তিনি ক্লাসে কেক, কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসবেন। ছাত্ররা তাদের কাগজের ডলার দিয়ে এসব জিনিস কিনতে পারবে। এর ফলে কয়েক দিনের মধ্যে শ্রেণির সমাজ কাঠামো পুরো বদলে গেল। শারীরিকভাবে ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্র অঙ্কে ও পড়াশোনায় ভালো বলে শ্রেণির নেতা হয়ে গেল। মারধরে ওস্তাদ ছাত্ররা তখন এই দুর্বল ছাত্রের কাছে অঙ্ক ও বানান সমাধান করার জন্য সাহায্য নিতে শুরু করল।
এই পরীক্ষণটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। একে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে রূপান্তর বা যুদ্ধ থেকে সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। এটি অর্থনীতিরও একটি মৌলিক সূত্র। সঠিক প্রণোদনা দিতে পারলে কর্মদক্ষতা ও সৃজনশীলতা বেড়ে যায়। শিক্ষাক্ষেত্রেও একই নিয়ম কাজ করে।
আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিউইয়র্ক নগরের বিদ্যালয়টির মতো। মনোবিজ্ঞানের একটি মৌলিক সূত্র, মানুষের আচরণ বদলাতে শাস্তির চেয়ে পুরস্কার অনেক বেশি কার্যকর।
সুতরাং এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে খেলার নিয়ম পাল্টাতে হবে। জ্ঞান ও গবেষণা, বিশেষ করে প্রকাশনার জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। মেধাকে যথার্থ মূল্য দিতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়নের অনেক চমৎকার উদাহরণ জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে রয়েছে। সব উদাহরণের পেছনে একটাই সূত্র কাজ করেছে। অর্থনীতিবিদরা যাকে ‘খেলার নিয়ম’ বলেন, সেটিকে তারা বদলে ফেলেছে। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় (১৯৬৬-১৯৭৬) চীনের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। তার সত্যিকার অগ্রযাত্রা শুরু হয় নব্বই দশকে। ২০০৬ সালে আমার পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন টোকিওকে ছাড়িয়ে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে এশিয়ার ১ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল।
কয়েক বছর পর টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম– এত বৈভবশালী বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে যাওয়া কত কঠিন কাজ ছিল, তা ভাবা যায় না! চীন তা বলতে গেলে দেড় দশকের মধ্যে করতে পেরেছিল যথাযথ প্রণোদনার মাধ্যমে। আমরাও যদি সঠিক প্রণোদনা দিয়ে আমাদের দারুণ মেধাবী তরুণদের উজ্জীবিত করতে পারি, তাহলে এক দশক বা দেড় দশকের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটকে আমরা এশিয়ার ১০টি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নিয়ে যেতে পারব।