প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:২২
তুই অধম বলে কি আমি উত্তম হবো না
সে শতভাগ কচিহাত। চিন্তায়-চেতনায়, আহারে-নিদ্রায়। শৈশব হতে তো বটেই। এমনকি বড়ো হয়েও সে পূর্ণাঙ্গ কচিহাতই রয়ে গেলো। যদিও তার চেহারায় কিংবা বচনে-ভাষণে বয়সের পরিণতি দৃশ্যমান। তবুও সে কচিহাত। সে যেমন আশৈশব কচিহাত তেমনি সে আজীবনও কচিহাত। যাকে নিয়ে আমার এতো মন ভালো করা, ক্ষণকে আলোয় রাঙিয়ে তোলার স্মৃতিচারণ, সে আমার বালকবেলার বন্ধু। হাফপ্যান্ট পরা মধ্য নব্বইয়ের দশকের সেই নির্মল বালকটি আজ শত শত তরুণ-তরুণীর আইডল। আজ আর চেষ্টা করলেও সে হাফপ্যান্ট পরে সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে ফেরৎ যেতে পারবে না। সে আমার মনের ঘরে আশৈশব বাসিন্দা হয়ে আছে কলেজিয়েট স্কুলের হিরণ্ময় দিনগুলো হতে। যার কথা বলছি তার কেতাবি নাম গোফরান উদ্দিন, ঘরের নাম টিটু। সেই হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটিই আজ ওমরগণি এমইএস কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাণ, অধ্যাপনায় যার পেটের ও আত্মার ক্ষুণ্নিবৃত্তি যুগপৎ মিটে যায়।
সে কেন কচিহাত? সে কচিহাত কারণ বালকবেলা হতে, স্কুলের দুরন্ত দিনগুলো হতেই সে 'কচিহাত' নামের একটি শিশুতোষ প্রকাশনার সাথে জড়িত। এখনও সে না চাইলেও 'কচিহাত' জড়িয়ে আছে তার গলগ্রহ হয়ে মনোবৃত্তিক সন্তানের পরিচয় নিয়ে। 'কচিহাত' তাকে আজ আর কচি রাখেনি বরং 'কচিহাত'ই তাকে পরিণতির বরমাল্য দিয়েছে তার লেখকসত্তাকে সংবর্ধিত করে। মাদারবাড়ি এলাকার মায়ের টিটু বন্ধু মহলে নন্দদুলালটি হয়ে থাকেনি বরং বন্ধু মহলে তার সপ্রতিভ সক্রিয়তার কারণে আজ সাহিত্য অঙ্গনে সে বাঙ্ময়। যারা কলেজিয়েট স্কুল সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন, এখানকার শিক্ষার্থীরা মেধার সাথে দুষ্টুমিরও সমান চর্চা করে। ফলে এই কারখানায় নিত্য নতুন দুষ্টুমি শুধু তৈরিই হয় না বরং ভাবীকালের দুষ্টুদের জন্যে তা কালজয়ী হয়ে জীবনও পায়। গোফরান টিটু এই কারখানার এক নিতান্ত ভদ্র শ্রমিক। শাখামৃগের অবলুপ্ত লেজ তার কখনও চোখে পড়েনি, তবে শাখামৃগদের সাথে সমান পাল্লা দিয়ে চলতে পারার তার সক্ষমতা ছিলো। এ কারণেই ভদ্র হয়েও গোফরান টিটু টিকে গিয়েছিল দুষ্টুমি তৈরির কারখানায়।
টিটু কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি হতে পড়লেও আমি তার সাথে যোগ দিয়েছিলাম অষ্টম শ্রেণিতে। বন্ধু বাৎসল্যে আমি কম যাই না, কিন্তু সে আমার অধিক। ফলে দুজনের বন্ধুত্বে কোনো কাবাবের হাড্ডি ছিল না। আমাদের বন্ধুতায় তবে পাশার দান ছিলো। এ পাশা শকুনী মামার বা দুর্যোধনের নয়, এ পাশা যুধিষ্ঠিরেরও নয়। এ পাশা ঠাকুরমার ঝুলির রাজকন্যারও নয়। এ পাশা ছিলো মিয়া সরওয়ার কামাল পাশা। তার সংযোগ আমাদের বন্ধুতাকে সুদৃঢ় যেমন করেছে তেমনি সমৃদ্ধও করেছে। পাশা আর আমার একটা জায়গায় মিল ছিলো খুব। আমাদের পরিবারের কাছে আমরা একই নামে আহুত হতাম। যদি পাশাপাশি বাসা হতো তবে হয়তো ঘটনাচক্রে ওকে ডাকলে আমি কিংবা আমাকে ডাকলে ও নিজেই সাড়া দিয়ে ফেলতো। যাই হোক, দুপরিবার দূরে থাকায় সে বিভ্রাট আর ঘটেনি। তার আর আমার, দুজনেরই ডাক নাম বাবলা। নাম বাবলা হলেও নিজ চোখে আজও বাবলা গাছ দেখতে পাইনি একটাও। আমি, টিটু ও পাশাকে স্কুল যেমন এক শিকে গেঁথে কাবাব বানিয়েছে, তেমনি তিনজনের হাতে খই হয়ে ফোটা ছড়ার ফুলও আমাদের বন্ধুতায় মাল্যদান করেছে। ফলে আমরা ত্রিভুজের আলাদা তিন শীর্ষ না হয়ে বরং ত্রিবেণীর ত্রিধারার সম্মিলন ঘটিয়ে সাহিত্যের মহাসমুদ্রে লীন হয়েছি।
নাশারাহর বাবা গোফরান সেলিমার কাছে শুধু মেয়েকেই পায়নি বরং তার সকল বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গত সাহচর্যকেও পেয়েছে। সেলিমা ভাবীও একজন শিশু সাহিত্যিক তথা ছড়াকার। তাঁর মনের সরোবরও প্রগতি ও উদারতার লীলাক্ষেত্র। মজার বিষয় হলো এখানেই, গোফরান ও সেলিমা ভাবীর জন্মদিন একই তারিখে। দশ অক্টোবর। কেকের খরচ বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্যে যোগসাজশ করেই তা করা হলো কি না জানি না, তবে তা কাকতালও নয় মনে হয়। কারণ নিয়তি যা নির্ধারণ করে রাখে তাকে কাকতাল বলাটা অপরাধ। সেই নিয়তির কাছে আমিও সমভাবে সমর্পিত। আপনারা তাই ভাববেন না, আমি ইচ্ছে করেই আমার জন্মদিনও দশ অক্টোবর বানিয়েছি। আসলে তা নয়, প্রকৃতির খেয়ালেই আমারও জন্মদিন দশ অক্টোবর। অর্থাৎ আমি, টিটু ও সেলিমা ভাবী একই তারিখে মাতৃগর্ভ ছেড়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। কেবল বর্ষে গরমিল। অক্টোবরের দশ তারিখের তিন জাতক কেবল জন্মদিনের ঐক্যতানে সীমাবদ্ধ নই, বরং মাত্রা-মিল-পর্ব নিয়েও ছড়া রাজ্যের গর্বিত প্রজা হয়ে আছি। নাড়িটেপা দুই ডাক্তার পাশা ও পীযূষকে নিয়ে বাংলার টিটুকে জানি অনেক গলদঘর্ম হতে হয়, কেননা বন্ধুসুলভ খোঁচাখুঁচি আমরা কম করি না তাকে। সে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিলেও কখনও আমাদের বেকায়দায় ফেলেনি। টিটু আমাদের কাছে তাই নট টু, ওনলি ওয়ান।
টিটু যে কেবল নাশারাহর প্রযত্ন তা নয়, সে রাদিয়ারও প্রযত্ন। একমাত্র কন্যা নাশারাহর স্নেহময় পিতা আরও একটা পিতৃত্বের অধিকারী। তবে এই পিতৃত্ব যে খুব একটা ভাবীর অগোচরে তা-ও নয়। তার এই পিতৃত্বের কথা সর্বজন বিদিত। রাদিয়া হয়তো কোন মানবশিশু নয়, তবে তার চেয়ে কোন অংশে কমও নয়। রাদিয়া হলো টিটুর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। রাদিয়া প্রকাশন নামে তার এই প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম অর্জন করেছে। চট্টগ্রামের সাহিত্য জগতে টিটুর রাদিয়া আজ আর শিশু নেই, কৈশোর ছাড়িয়ে যেতে চললো। অধ্যাপনা বা প্রকাশনা জগতের বাইরে টিটু এক ঋদ্ধ ছড়াশিল্পী। ইতোমধ্যেই সে তার জায়গা করে নিয়েছে আত্মদক্ষতায়। টিটুর ছড়া পড়লেই বোঝা যায় সহজে, তার মধ্যে মায়ের জন্যে কী পরিমাণ ভালোবাসা ও টান রয়েছে। টিটুর ছড়ায় গর্ভধারিণী মা যেমন আছেন, তেমনি দেশমাতাও আছে সমানভাবে। টিটু আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক। তার ছড়ায় বাংলাদেশের সবুজ শ্যামলিমার প্রতি যে টান আমরা দেখি তা সত্যিই আগামী প্রজন্মের জন্যে অনুকরণযোগ্য। টিটু তার ছড়ায় যে উত্তরাধিকার নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে তেমনি তার সমান উত্তরাধিকারে সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে লালন করে। নিছক শিশুতোষ ছড়া কেবল নয়, টিটুর ছড়ায় সামাজিক অসঙ্গতিগুলোও উঠে এসেছে সমকালীন বাস্তবতায়। ছড়াকার টিটু যে কিছুটা ইঁচড়ে পাকা ছিলো তা-ও আমরা বুঝতে পারি তার সাম্প্রতিক লেখা একটা ছড়া থেকে। তার বালকবেলার অবুঝপ্রেম যেন ঝলকে উঠেছে সংকলনভুক্ত এ ছড়াটিতে।
এ লেখার শিরোনাম নিয়ে পাঠকের অস্বস্তি হতে পারে। কারণ এখনও সে বিষয়ে কোনো বয়ান আসেনি। কিছুটা খোলাসা না করলে পাঠকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। গত বছর আমার পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিক উপলক্ষে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে নিয়ে একটা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। আমি আমার দুই ছড়াকার বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলাম, তারা যাতে এই গ্রন্থে প্রকাশের জন্যে লেখা পাঠায়। কামাল পাশা একটা ছোট কিংবা অণু লেখা পাঠায়। তা-ও তার সুমর্জি হয়েছিলো। তাই তার প্রতি অঢেল কৃতজ্ঞতা। কিন্তু টিটুকে বলার পর সে আমার কথায় কোনো পাত্তাই দেয়নি। অথচ সবার আগে আমি টিটুকেই বলেছিলাম। এরপর দুবার তাগাদাও দিয়ে গেছি। কিন্তু তার ব্যাটারিতে মনে হয় চার্জ ছিলো না। তাই সে কোনো পাত্তা দেয়নি। ফলে আমার 'প্রাণবন্ত পঞ্চাশে' শিরোনামের স্মারকগ্রন্থে টিটুর কোনো লেখা যায়নি। তখন বুঝলাম, আসলে টিটুর ভেতরে সাড়ে চৌদ্দ আনা বৃটিশ ঢুকে বসে আছে। যাই হোক, মনে একটু কষ্ট ছিলো, প্রিয় বন্ধু আমাকে নিয়ে কিছু লিখলো না। তবে আমাদের এসএসসি পাশের রজতজয়ন্তী উৎসবের স্মারকগ্রন্থে সে আমার লেখাটাকে সমাদর করেছে যথেষ্ট। এ কথা মনে করে সেই ক্ষতে কিছুটা মলমের প্রলেপ লাগাতে চেষ্টা করি। কিন্তু এক মাঘে তো আর শীত যায় না। টিটুর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিক এ বছরে। এবার কোথায় যাবে বাছাধন! আমিও পেয়ে গেলাম মওকা। টিটু আমাকে সবার আগে ফোন দিলো। দোস্ত, একটা লেখা আমাকে দিতেই হবে। আমার পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিক স্মারকের জন্যে। আমি সানন্দে রাজি হলাম। কিন্তু হুট করে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে আমার লেখার কথা মাথায় ছিলো না। আমি নিজেও কেমন জানি লেখার জটে ভুগলাম কিছুদিন। সময় চলে গেলো। হঠাৎ গত চৌদ্দ সেপ্টেম্বর টিটু আমাকে ফোন দিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় বললো, ‘অডা, তুই কি আঁর উদ্দি প্রতিশোধ লঅরদে না?’ আমি হেসে দিলাম। আমার মনে পড়লো তার জন্যে লেখার কথা। জিভে কামড় খেয়ে বললাম, না বন্ধু, তুই অধম বলে আমি কেন উত্তম হবো না। সে তখন আমাকে বললো, দোস্ত, এটাই তোর লেখার শিরোনাম করবি। লেখাটা আজকেই আমাকে পাঠিয়ে দে। আমি পনের সেপ্টেম্বর বইটা প্রেসে ছেড়ে দেবো। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম লেখা সময়মত দেওয়ার ব্যাপারে। তবে চৌদ্দ তারিখ আমার প্রয়াত পিতার স্মৃতিতে আমার বাসায় সংঘদান (বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান) আয়োজনের কারণে আর লেখাটা ধরা হয়নি। পনের তারিখ অরুণোদয়কে সাক্ষী রেখে বন্ধু গোফরানকে স্মরণ করলাম লেখায়। আমার বন্ধু গোফরান আমার হৃদয়ের গভীরে জায়গা পাওয়া একমাত্র বৃটিশ। তার সকল অপকর্ম তাই পরম ভালোবাসায় ক্ষমা করে দিয়ে সে অধম হলেও আমি উত্তম হয়ে থাকলাম এ লেখার মধ্য দিয়ে। বন্ধু, তুই শতায়ু হ, নিরোগ ও সক্রিয় জীবন হোক তোর। তুই কালজয়ী হয়ে থাক সাহিত্যের সরোবরে। বন্ধুতার জয় হোক।