বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৩, ১০:১০

মূল্যবোধ অর্জনের সারথি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম

এম. আব্দুল আজিজ শিশির
মূল্যবোধ অর্জনের সারথি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম

মূল্যবোধ হলো মানুষের বিশ্বাসবোধ, যার মাধ্যমে কোন কাজ, ঘটনা বা অবস্থার ভালো-মন্দ বিচার করা হয়। এটি মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ড। মূল্যবোধ বলতে ব্যক্তির জ্ঞানগর্ভ আচরণকে বুঝায়, যাতে মানবিক এবং সামাজিক মূল্য বিদ্যমান। অন্য কথায় বলা যায়, মূল্যবোধ হচ্ছে একধরনের নীতি বা বিশ্বাস, যা যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত সমাধান বা অগ্রাধিকার নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমাজবিজ্ঞানী জ ঞ ঝপযধবভবৎ তাঁর ঝড়পরড়ষড়মু গ্রন্থে বলেছেন, ‘ভালো বা মন্দ কাঙ্খিত বা অনাকাক্সিক্ষত এবং ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে সমাজের বিদ্যমান ধারণার নামই মূল্যবোধ। সমাজ জীবনে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড যেসব নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে মূল্যবোধ বলে। এক কথায় বলা যায়, শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা, সৌজন্যতা প্রভৃতি সুকুমারবৃত্তি বা মানবীয় গুণাবলির সমষ্টিই হলো মূল্যবোধ।

জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নের সঙ্গে মূল্যবোধ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিদ্যমান। ব্যক্তির চরিত্র গঠন ব্যক্তির বিভিন্ন বা পরিবর্তিত পরিবেশে কিভাবে মিশবে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কিভাবে আচরণ করবে, কাকে স্নেহ করবে আর কাকে শ্রদ্ধা করবে কোন্ বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে মূল্যবোধের উপর। পরিণত বয়সে ব্যক্তি তার কর্মক্ষেত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কী ভূমিকা রাখবে সেটাও নির্ধারিত হয় বাল্যকাল ও কৈশোরের অর্জিত মূল্যবোধ থেকে। একজন ব্যক্তিকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য যথোপযুক্ত করে তোলে তার মূল্যবোধ। অন্যায়-অনাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি আশ্রয়-প্রশ্রয়দানের বিরোধিতা করে মূল্যবোধ। মূল্যবোধের অনুপস্থিতিতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ,পরিবেশ ও রাজনীতিসহ সর্বত্র মানব জীবনব্যবস্থা হয়ে উঠে দুর্বিষহ ও অস্থিতিশীল।

শিক্ষা ভালো-মন্দ বিচার করতে শেখায়। এই ভালো-মন্দের বিচার মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। শিক্ষার কাজ শুধু সার্টিফিকেটধারী মানুষ তৈরি করা নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দ ও বোধহীন শিক্ষাকে শিক্ষা বলতেই নারাজ। শিক্ষার অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ব্যক্তির মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো। মূল্যবোধ বিকাশে শিক্ষার দায় ব্যক্তি পর্যন্ত বিবেচনা করতে হয়। কারণ শিক্ষার প্রভাব সবচেয়ে গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মনে রাখা দরকার, অল্প কয়েকদিনের অনুশীলন মানসিকতা পরিবর্তন করে না, অনুশীলন প্রয়োজন দীর্ঘদিনের। আর শিক্ষার গুরুত্ব এই জায়গাটিতেই। যে শিশু শৈশবকাল থেকেই পড়ালেখার তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে বেড়ে ওঠে, ক্লাসে প্রথম হওয়া, জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য তুমুল প্রতিযোগিতা, যেখানে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে যায় বেশি বেতনের চাকরি পাওয়া, সেখানে শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ অসম্ভব। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে পরিবার ও সমাজের যোগসূত্র না থাকলে শিশুদের মানসিক বিকাশ সহজ হয় না। আর তাই তথাকথিত মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, শুধু তথ্য মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে এসে পরীক্ষায় ভুরি ভুরি জিপিএ ফাইভ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু মূল্যবোধ তৈরি বা মানসিক বিকাশ সম্ভব হয় না। সার্টিফিকেটধারী লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার যুবক তৈরি করা যায় কিন্তু দক্ষ নাগরিক তৈরি হয় না। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে অন্যায়, অবিচার, অমানবিকতা, দুর্নীতি দূর করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

শিক্ষায় মূল্যবোধের চর্চা অনুসরণ ও উন্নয়ন জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে। মূল্যবোধ সকল ধরনের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপকে প্রভাবিত করে। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ তৈরি করা হয়েছে যোগ্যতাভিত্তিক। গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে কোনো প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রভৃতির সন্নিবেশ ঘটিয়ে কর্মসম্পাদনের যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে। শিক্ষার মাধ্যমে নিজ দেশ ও সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরি চর্চা অনুসরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে হলে সেগুলোকে অর্জন করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে। এ মূল্যবোধের উৎসগুলো হলো বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পরিচয় ও ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চা বর্তমানে ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক মূল্যবোধ। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১-এ মুখস্তবিদ্যার পরিবর্তে দেশপ্রেম, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, শুদ্ধাচার ইত্যাদি মূল্যবোধ অনুশীলনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা একক কাজ, জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজ, প্রজেক্ট উপস্থাপন, শ্রেণিকক্ষের বাইরে সরাসরি দেখার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ, চিত্র ও উপকরণ তৈরি, হাতে-কলমে কাজ সম্পাদন ও উপস্থাপনসহ নানা রকম কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে উপরিউক্ত মূল্যবোধগুলো অনুশীলন করবে। উপরোক্ত মূল্যবোধগুলি অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে সততা, উদ্যম, গণতান্ত্রিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, উদ্যোগ, ইতিবাচকতা, মানবিকতা, দায়িত্বশীলতা, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি জাগ্রত হবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভব হবে। আজকের শিক্ষার্থীরা বিশ্ব নাগরিকত্বের দক্ষতা, চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যার সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, সুব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, মৌলিক দক্ষতা--সর্বোপরি ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করে ব্যক্তি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশে ও বিদেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে একটি বৈষম্যহীন বিশ্ব তৈরি করবে এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল, সুরক্ষিত এবং টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলবে।

এম. আব্দুল আজিজ শিশির : সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি), হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদপুর ও মাস্টার ট্রেইনার, জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ বিস্তরন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়