প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ কেন প্রয়োজন?
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে সবার প্রথমে যা চলে আসে, সেটা খাদ্য। পরিমিত আর পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা পূরণ যেমন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেই খাবারের যোগান সব সময় নিরাপদ রাখা। আর এক্ষেত্রে যেকোনো জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে জানেন? কৃষক। কবির ভাষায়,
সভ্যতার শুরু থেকে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষ চলে এসেছে অনেক দূর। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ অতিক্রম করা তো দূর অতীত, এখন মানুষ পা রাখছে চাঁদের বুকে, স্বপ্ন দেখছে মঙ্গল জয়ের। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়েও কৃষক এবং কৃষির গুরুত্ব কখনোই কমেনি, বরং দিন দিন বেড়েছে। মানুষ দিন দিন আবিষ্কার করছে নতুন নতুন প্রযুক্তি, যা কৃষির উন্নতিতে, সর্বোপরি মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহারই আজকের কৃষিতে এত জয়জয়কার বয়ে এনেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের এই কল্যাণকর অবদান কৃষকের কাছে পৌঁছে তো দিতে হবে। এই কাজটিই করে থাকে বাংলাদেশে কৃষি মন্ত্রণালয় এর অধীনে কাজ করা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কৃষি সম্প্রসারণ কী?
কৃষি সম্প্রসারণকে কৃষি বিষয়ক উপদেশমূলক পরিসেবাও বলা যায়। ব্যবহারিক পরিভাষায়, সম্প্রসারণের অর্থ হলো আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষুদ্র কৃষকদের– তাদের উৎপাদনশীলতা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকা উন্নত করার জন্য কৃষি সংক্রান্ত কৌশল এবং দক্ষতা সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া।
এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে :
উন্নত বীজ, মাটির গুণাগুণ, হাতিয়ার, পানি ব্যবস্থাপনা, শস্য সুরক্ষা, কৃষি পদ্ধতি এবং পশুসম্পদসহ ব্যবহারিক তথ্যের প্রচার এবং খামারে এই জ্ঞানের প্রয়োগ।
গ্রামীণ উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি সম্প্রসারণ কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের একটি অপরিহার্য অংশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দরকারি প্রযুক্তি তৈরির প্রযুক্তিগত দিকগুলোতে গুরুত্বারোপ করে। কৃষি সম্প্রসারণ কৃষকদের দ্বারা সেই প্রযুক্তিগুলো গ্রহণ এবং ব্যবহারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। দুই ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্বের সাথে কাজ করা উচিত।
কারা কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদান করে?
কৃষি সম্প্রসারণের তিনটি প্রধান উৎস রয়েছে।
১) পাবলিক সেক্টর: মন্ত্রণালয় এবং কৃষি বিভাগ, এবং কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
২) বেসরকারি অলাভজনক খাত: স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), ফাউন্ডেশন, কমিউনিটি বোর্ড এবং অ্যাসোসিয়েশন; দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সাহায্য প্রকল্প, এবং অন্যান্য অবাণিজ্যিক সমিতি।
৩) বেসরকারি লাভজনক খাত: বাণিজ্যিক কোম্পানি (যেমন ইনপুট নির্মাতা এবং পরিবেশক); বাণিজ্যিক কৃষক বা কৃষক গ্রুপ-চালিত উদ্যোগ যেখানে কৃষকরা উভয়ই ব্যবহারকারী এবং কৃষি তথ্য সরবরাহকারী; কৃষি-বিপণন এবং প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলি; বানিজ্য সংঘ; এবং ব্যক্তিগত পরামর্শ এবং মিডিয়া কোম্পানি।
উন্নয়নশীল বিশ্বে কৃষি সম্প্রসারণ
উন্নত কৃষিখাত সমৃদ্ধ অনেক দেশ, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ডেনমার্ক, শক্তিশালী সম্প্রসারণ পরিসেবা নিশ্চিত করে থাকে। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বে সকল ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ সবসময় কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
বিশ্বব্যাংকের তৈরি ‘প্রশিক্ষণ এবং পরিদর্শন’ সিস্টেমটি ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিক থেকে ভারতের সবুজ বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যর্থও হয়েছিল। এটি বৃষ্টিনির্ভর এলাকায় বৈচিত্র্যময় কৃষি ব্যবস্থার জন্য উপযুক্ত ছিল না। এটি স্থায়িত্বের উন্নতি, বৈচিত্র্যের প্রচার এবং কৃষকদের বাজারের সাথে সংযুক্ত করার মতো ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতেও সংগ্রাম করেছে।
আফ্রিকায়, তাদের কৃষিক্ষেত্রের উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর উপর গবেষণার ফোকাসের অভাবে ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে সীমাবদ্ধতা তৈরিতে অবদান রেখেছে। আফ্রিকার কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র পর্যায়ের শ্রমিকের সীমাবদ্ধতার উপর নজর দিয়েছিল, যা নতুন উদ্ভাবনের সাথে যুক্ত ঝুঁকি এবং মূলধনের প্রাপ্যতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, দুর্বল ফলন এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের অভাবের ফলে এই খাতে দারিদ্র্য বজায় থাকে, যার সুদূরপ্রসারী ফলাফল এখনও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তরুণদের শহর ছেড়ে যাওয়া, অপর্যাপ্ত নগর পরিকাঠামোর চাপ এবং তার সাথে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।
এজন্য উন্নত প্রজনন উদ্যোগের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নতিতে সাহায্য করা আবশ্যক। কিন্তু সেজন্য একে কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজনীয় কৃষি সম্প্রসারণ জরুরি।
বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ
বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। এই দেশের জনসংখ্যার ৭৫% গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৫৯.৮৪ শতাংশ আর শহুরে জনগোষ্ঠীর ১০.৮১ শতাংশ কৃষিকাজের সাথে জড়িত। কৃষিখাত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১৯.১% জোগান দেয় এবং জনসংখ্যার ৪৮.১ শতাংশ কৃষি থেকে উপার্জন করে থাকে।
ধান, পাট, তুলা, আখ, ফুল ও রেশম চাষ, মাছ চাষ, শাকসবজি, প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, বীজ উন্নয়ন এবং বিতরণসহ বাগানের সম্প্রসারণ কৃষি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে। এই দেশের কৃষকরা প্রায়ই ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে চাষ করে। কৃষি উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য অধিকাংশ কৃষক এখনও লাঙ্গল, মই এবং গরুর উপর নির্ভর করে। তারপরেও বর্তমান কৃষি প্রযুক্তির অবদানে অনেক কৃষক এখন তাদের ফলন বাড়াতে পারছে। ধান ও পাট দেশের প্রধান ফসল হলেও গম, চা, আখ, আলু এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজিও যথেষ্ট পরিমাণে জন্মানো সম্ভব হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় হলো বাংলাদেশের কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য নিযুক্ত মন্ত্রণালয়, এবং এটি বিভিন্ন প্রকল্প ও সংস্থার মাধ্যমে এই খাতকে উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি, কৃষি প্রকৌশল এবং কৃষি-অর্থনীতি সংক্রান্ত গবেষণা, সেই সাথে কৃষি পণ্য এবং কৃষিভিত্তিক কোম্পানিগুলোর বিকাশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যকরী সেবার ফলে কৃষিতে অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) উচ্চ ফলনশীল বীজের জাত সম্প্রসারণ ও বিক্রির জন্য কাজ করছে। বিএডিসির ১৫টি কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স জোন এবং ২১টি বীজ বৈচিত্রকরণ খামার রয়েছে। ১২টি বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে, কৃষিপণ্যের বীজ যান্ত্রিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তদুপরি, বেসরকারি ব্যবসা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক গ্রুপগুলোও কৃষিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষির উন্নতিতে নারীদের অংশগ্রহণেও দিতে হবে সমান গুরুত্ব; Image Source: samakal.com
কৃষি সম্প্রসারণের নতুন পন্থা
কৃষিক্ষেত্রে নতুন এবং ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, প্রযুক্তি এবং স্থায়িত্বের জন্য নতুন চিন্তার প্রয়োজন। কৃষি সম্প্রসারণের এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত:
চাহিদানুযায়ী পরিষেবাগুলোকে এগিয়ে নিতে অংশগ্রহণমূলক পন্থা, কৃষি সম্প্রসারণ পরিষেবার একাধিক প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি উদ্ভাবন ব্যবস্থা বিকাশের কৌশল।
উন্নয়নশীল বিশ্বে পাবলিক সেক্টরের গবেষণা এবং সম্প্রসারণ পরিষেবার ট্রেডিশনাল বিভিন্ন উৎস থাকলেও এটি একা সব লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না। উন্নয়ন অর্জন করতে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য, ক্ষুদ্র কৃষকদের তাদের প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো পেতে একত্রে কাজ করতে হবে। উপরন্তু, সম্প্রসারণে কোম্পানি এবং এনজিওর অংশগ্রহণের বাধা দূর করতে হবে, এবং উদ্ভাবনী সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব গঠন করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ পরিসেবার গুরুত্ব
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মসূচী গ্রামীণ দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবেলার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এর কারণ, এতে প্রযুক্তি হস্তান্তর, গ্রামীণ প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা সমর্থন, সমস্যা সমাধানে কৃষকদের সহায়তা করা এবং কৃষকদের কৃষি জ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে জড়িত করার উপায় রয়েছে। এফএও-এর সংজ্ঞানুযায়ী, কৃষি সম্প্রসারণ বলতে,
যে সিস্টেমগুলো কৃষক, তাদের সংগঠন এবং অন্যান্য কৃষির সাথে জড়িত মানুষের জন্য জ্ঞান, তথ্য এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বাড়াবে; গবেষণা, শিক্ষা, কৃষি ব্যবসা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়া সহজতর করবে; এবং তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত, সাংগঠনিক এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা এবং অনুশীলন বিকাশে তাদের সহায়তা করবে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে।
এই সংজ্ঞানুসারে, কৃষি সম্প্রসারণকে কৃষি, এর সাথে সম্পর্কিত কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে জনগণের চাহিদা মেটাতে আরও কার্যকর ও দক্ষ করার প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই একে কৃষিপণ্যের নিরাপত্তা ও গুণগত মান উন্নয়নের জন্য একটি নীতির হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণের লক্ষ্য মূলত গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য কৃষকদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা; যেমন- কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য এটিকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে মনে করা হয়। এ কারণেই কৃষি সম্প্রসারণকে উন্নয়নের সুবিধার্থে একটি প্রধান উপাদান বলা হয়, কারণ এটি কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সূত্র : রোর বাংলা।