প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২১, ১৬:৩৫
যে গানগুলোর জন্য ফকির আলমগীর গণমানুষের শিল্পী (ভিডিও লিংকসহ)
চলে গেলেন একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আলোড়িত কণ্ঠস্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর। মেহনতি মানুষের কথাগুলো সংগীতের ভাষায়, গভীর ভালোবাসায়, গণমানুষের কানে পৌঁছে দিয়ে হৃদয়ের গহীনে ঠাঁই করে নিয়েছেন নিজের অজান্তেই। কখনো গেয়েছেন পপ সংগীতের মিউজিকে 'জন হেনরি..,' কখনোবা হৃদয় উত্তাল করে মায়াবী সুরে মায়ের মায়ায় জর্জরিত হয়ে উচ্চ স্কেলে গেয়েছেন 'মায়ের এক ধার দুধের দাম..'।
|আরো খবর
আবার হাজারো রিক্সা চালকেরও যে একটি মন আছে, সে মনে ভালোবাসা আছে। রিক্সাচালকও যে তার যৌবনে কোন এক সখিনার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে গেয়েছেন, 'ও সখিনা গেছোছ কি না ভুইলা আমারে..।' শুধুই কী তাই? মৃত্যুর পর লাশের পাশের কান্না যে মোটেই সুখকর নয় এতে মুর্দারের কষ্ট হয় তা বার বার সন্তানহারা মা-দের স্মরণ করিয়ে দিয়ে করুণ সুরে গেয়েছেন, 'কাইন্দোনা রহমতের মা, কান্দলে মুর্দার আজাব হয়..।' -এমনই শত শত গান আর মায়ার টান অমর করে রাখবে ফকির আলমগীরকে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ১৯৯৯ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত গণসংগীতের শিল্পী ফকির আলমগীরের শ্রেষ্ঠ কিছু সংগীত ভিডিও লিংকসহ চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
মায়ের একধার দুধের দাম... 'মা' শব্দটি যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ, মায়ের ঋণ যে কখনও শোধ হবার নয় এমনকি সন্তানের গায়ের চামড়া কেটে পা মোছার পাপস বানালেও সে ঋণ শোধ করা যাবে না তা গানে গানে গেয়েছেন প্রিয় এই শিল্পী। বাবা সন্তানকে সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেও মা যে তাকে আগরে রাখেন আজীবন তার বর্ণনা শ্রোতার মনে দীর্ঘশ্বাসের ঝর তোলে। গানটি যতবার গেয়েছেন ততবারই কেঁদেছেন ফকির আলমগীর। ১৯৭৭ সালে আরিচা ঘাটে এক অন্ধ বাউলের কণ্ঠে প্রথম তিনি এই গানটি শোনেন। তখন তিনি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে, ঢাকায় ফিরে নিজের মতো করে গানটি রেকর্ড করেন। প্রচারিত হয় বিটিভিতে। সেই থেকেই মানুষের মুখে মুখে মায়ের গান।
ভিডিও: https://youtu.be/pbZqKCDk8Dc
ও সখিনা গেছোছ কি না ভুইলা আমারে... সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ঢাকার ফুটপাতে শুয়ে পুরানো প্রেমিকা সখিনাকে কল্পনা করা আর স্বপ্ন রাজ্যে তাকে প্রশ্ন করতে করতে ফকির আলমগীর গেয়েছেন 'ও সখিনা গেছোছ কি না ভুইলা আমারে/আমি এহন রিস্কা চালাই ঢাহার শহরে..'। জীবন্ত দৃশ্যপটের মতই শিল্পী গানের শেষ অন্তরায় গেয়েছেন 'লক্ষ মশার উৎপাতে/রাত কাটে না ফুটপাতে/লয় মনে আজ বদলা লমু/ঊইড়া যামু তোর কাছে...। ১৯৮২ সালের বিটিভির ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পর দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে। কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি গানটির সুরও করেছেন ফকির আলমগীর।
ভিডিও: https://youtu.be/KHqyykp4jFk
কাইন্দো না রহমতের মা... সন্তান হারা প্রতিটি মা-কে বারংবার সাবধান করে রহমতের মা-কে কাল্পনিক চরিত্রে বিণয়ী কণ্ঠে বলেছেন ফকির আলমগীর কাইন্দো না রহমতের মা/কান্দলে মুর্দার আজাব হয়/এসো সবাই মিলে দোয়া করি/রহমত যেন বেহেস্ত পায়..' মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিনী সুরাইয়া আলমগীর যখন লাশের পাশে কাঁদছিলেন তখন যেন এই গানটিই উঁকি দিচ্ছিলো তাঁর হাজারো ভক্তের মনে।
ভিডিও: https://youtu.be/R0oi348Lfwg
মন আমার দেহ ঘড়ি... আব্দুর রহমান বয়াতির লেখা ও সুরের আধ্যাত্মিক গান 'মন আমার দেহ ঘড়ি' গেয়ে দর্শকের মন জয় করেছেন ফকির আলমগীর। তাঁর কণ্ঠে শুনে মানুষ দেহ নামক ঘড়িটিকে নিয়ে নতুন করে ভেবেছেন। শিল্পী গাওয়া পংক্তিগুলো মানুষের মনে ভাবনার সৃষ্টি করেছে। যেমনটি গেয়েছেন তিনি, ও একখান চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া/জনম ভইরা চলতে আছে/মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি/কোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে/মন আমার দেহ ঘড়ি ..
ভিডিও: https://youtu.be/wECyeVplVy4
নাম তার ছিলো জন হেনরি.. বিশ্ব শ্রমিক দিবসে বাংলাদেশী কোন গানের কথা মনে হলে সবার আগে ভেসে আসে ফকির আলমগীরের 'জন হেনরি' গানটি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অনূদিত জন হেনরি গানটি ১৯৭৩ সালে গেয়ে জানান দেন তিনি পপ সংগীতেও অবদান রাখতে পারেন। চ্যানেল আইতে গানটি প্রচারিত হলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শ্রমিকদের জন্য প্রেরণার একটি গান ফকির আলমগীরের কণ্ঠের জন হেনরি গানটি। গানের দ্বিতীয় চরণে শিল্পীর দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, কালো পথরে খোদাই জন হেনরি/জানাইছে গড়া পেশী ঝলমল/হাতুড়ীর ঘায়ে ঘায়ে পাথরে আগুন ধরে/হাতুড়ী চালানো তার সম্বল/হো হো হো হো হাতুড়ী চালানো তার সম্বল...।
ভিডিও: https://youtu.be/KpO-dGAxde0
আহারে কাল্লু মাতাব্বর... দালালের খপ্পরে পড়ে গ্রামের ভিটে মাটি ছেড়ে ঢাকায় এসে দোটানায় পড়া মানুষদের জন্য ফকির আলমগীর গেয়েছেন, আহারে আল্লু মাতব্বর/ফাঁকি দিয়া আনলি ঢাকায় ভাইঙ্গা আমার ঘর...। তাইতো ঢাকায় এসে যারাই বিপদে পড়েছেন তারাই মনের অজান্তে গুন গুন করে গেয়েছেন গানটি।
ভিডিও: https://youtu.be/EA8wu1DdUg4
কোকড়া লম্বা চুলগুলো দু'পাশে নাড়িয়ে দুই হাতের দুই তর্জনী আকাশের দিকে তুলে কিংবা মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত ঊর্ধ্বমুখি করে আর গাইবেন না ফকির আলমগীর। বিশাল দেহের, কোমল মনের আজন্ম সংগীত প্রিয় মানুষটি আর গাইবেন না অমর সংগীতগুলো। উঠবেন না গানের তালে নেচে। গণসংগীতাঙ্গণ একা করে বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে ওপাড়ে পাড়ি জমালেন গণমানুষের প্রিয় এই শিল্পী।