বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৮

সাংস্কৃতিক শিক্ষার গুরুত্ব

সৈয়দ মো. সিয়াম
সাংস্কৃতিক শিক্ষার গুরুত্ব

মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক হলো সংস্কৃতি এবং শিক্ষা, যা সমাজ কর্তৃক প্রতীয়মান হয়। সংস্কৃতি প্রবহমান, গোষ্ঠীগত ঐতিহ্য যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসছে। অন্যদিকে শিক্ষা ব্যক্তিত্ব বিকাশের মাধ্যমে মানুষের আচরণিক অপেক্ষাকৃত ইতিবাচক স্থায়ী পরিবর্তন আনে সেইসাথে আমরা যে সমাজে বসবাস করি তা সম্পর্কে বুঝতে ও জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করে।

মানুষের আচরণমালার সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি। এখানে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি শাব্দিকভাবে ভিন্ন অর্থ ও সংজ্ঞাবিশিষ্ট হলেও প্রতিটি প্রত্যয় ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত রয়েছে এবং একে অপরের ওপর গভীর প্রভাব রাখছে। শিক্ষা যেকোনো সমাজের বিকাশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সত্যিকারের শিক্ষা ব্যক্তির মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে গঠন করতে, জ্ঞানকে প্রশমিত করতে এবং জীবনে সাফল্যের জন্য দক্ষতা প্রদান করতে সাহায্য করে। শিক্ষা সংস্কৃতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।

আমরা সবাই বেড়ে উঠি একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির বাতাবরণে যা প্রতিফলিত হয় আমাদের কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে, চলনে-বলনে, আকার-ইঙ্গিতে। সংস্কৃতি হলো বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভাষা, রীতিনীতি, ধর্ম এবং ঐতিহ্যের বুনিয়াদ, যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সমাজকে সংজ্ঞায়িত করে।

শিক্ষা যেমন সংস্কৃতিকে গতিশীল রাখে, আবার সংস্কৃতিও শিক্ষার দ্বারাই অর্জিত হয়। ফলে উভয়ই যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা, ভাবধারা, রীতি-নীতি, বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, জ্ঞান, কৌশল, দক্ষতা, দর্শন ইত্যাদি সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির আরেক নাম ‘সামাজিক উত্তরাধিকার (ঝড়পরধষ ঐবৎরঃধমব)’, সংক্ষেপে ‘সংস্কৃতি’ বলতে একটি মানবগোষ্ঠীর সমগ্র জীবন ধারাকে বোঝায়। ‘ঈঁষঃঁৎব রং ঃযব ঃড়ঃধষ ধিু ড়ভ ষরভব’। এ হলো একটি মানবগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আহার-বিহার, বিলাস-ব্যসন, উপকরণ প্রভৃতি সবকিছুই।

আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে মানুষের ব্যক্তিত্বে উৎস মূলত দ্বিবিধÑএকটি জন্মগত ও অপরটি সংস্কৃতিগত। অর্থাৎ সমাজ-সংস্কৃতির ওপর মানুষের ব্যক্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভরশীল। বস্তুত, মানুষের ব্যক্তিত্বকে রূপায়ন করে তার সংস্কৃতি। মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠিত ও বিকশিত হয় তার সামগ্রিক সংস্কৃতিরই অংশ হিসেবে। শিক্ষার দ্বারা মানুষ তার জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটায় এবং দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্গঠন করে। এভাবে শিক্ষা মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। এক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। একটি সংস্কৃতির স্বরূপ নির্ধারিত হয় তার পারিপার্শ্বিকতা, আবহাওয়া, প্রযুক্তি, জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা। এসব নিয়ামক সমূহের প্রতিফলন ঘটে মানুষের আচার-ব্যবহার, মূল্যবোধ ও ভাষার ওপর।

এমনকি একই দেশে একই সমাজে গোষ্ঠীভেদে সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ সংস্কৃতি হলো, মানুষের অর্জিত বিষয়, সহজাত নয়। একেকটি জাতির, গোষ্ঠীর, অঞ্চলের বা ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ কারণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির কথা বলা হয়।

আর শিক্ষা এই আবহমান কাল ধরে চলে আসা ধ্রুপদ সংস্কৃতি সংরক্ষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আর সেটি রক্ষা করে শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি করা এবং সেটি শিক্ষার্থীদের চর্চা করানোর মাধ্যমে। আর এই ধ্রুপদ সংস্কৃতি সংরক্ষণে বিশ্বের উন্নত অনুন্নত সব দেশেই জোর ভূমিকা রাখে।

জাপানে বিশেষ দিনে বিশেষ আয়োজন হলে তা স্কুলের দরজায় রাখা কাচের বাক্সে রেখে অভিভাবকদের দেখানো হয়। কোনো বিশেষ উৎসব বা ঋতু পরির্বতন হলে তার নমুনাও প্রবেশদ্বারের টেবিলে সাজিয়ে রেখে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। অভিভাবকদেরও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় উৎসবের আগমন। বিদ্যালয়ে সেই উৎসব যেমনভাবে পালিত হয় ঠিক তেমনই পাঠ্যবইতেও এ জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে আসা হয়।

কানাডার শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সৌরভ বড়ুয়া নামক একজন গবেষকের ইউনেস্কো পরিচালিত কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স উপস্থাপিত সংস্কৃতি সংরক্ষণ বিষয় সংক্রান্ত প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেখানকার আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের যান্ত্রিকতার চাপে স্থানীয় ভাষারগুলোর অবলুপ্তি।

কানাডার মূলধারার স্থানীয় অভিবাসী ও আদিবাসী সংস্কৃতির শেকড়ের ভাষার চর্চা বজায় রাখার পাশাপাশি কানাডা স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে কানাডা সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগের দিক আলোকপাত করেন। একইসাথে সেখানকার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার বিষয়ে গুরুত্বেও বিষয়টি নিয়ে আসেন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে দেখা যায় ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে তারা সর্বদাই তৎপর। তারা তাদের শিশু সাহিত্যে ও প্রাথমিক বিদ্যালয় (মাদ্রাসাগুলোয়) তাদের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চা করে থাকেন। তারা তাদের নওরোজ উৎসবসহ ধ্রুপদ পারস্য সংস্কৃতি তত্ত্বীয়ভাবে বইয়ে আলোচনা ও ব্যবহারিকভাবে পালন করে থাকে।

২০১৯ সালে ইরানের রসুলবাদের বাসিন্দারা ঠিক করেছিল গ্রামের সব রাস্তার আবার নতুন করে নামকরণ করা হবে। আর সেই নাম হবে পারস্য সাহিত্যের বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন বইসমূহের নামে।

ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যতিক্রমধর্মী হিসেবে সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হলেও তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে। সেখানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রচলিত বইখাতা সমেত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য গতানুগতিক স্কুলে যেতে না হলেও শিশুরা এসময় শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান (সোশ্যাল ক্লাব) থেকে আর সেখানকার মূল কাজ শিক্ষার্থীরা তাদের মৌলিক শিক্ষা এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানবে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেও বিদ্যালয়গুলোয় রয়েছে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি শেখানোর পাশাপাশি রাজ্যেও নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার ব্যবস্থা, সেগুলো বইয়ের ভাষায় জানানোর পাশাপাশি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন উৎসব পালনের রীতিনীতি।

এরকম নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে আমাদের বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উন্নত এবং সভ্যদেশসমূহ সদা তৎপর কেননা আবহমান সংস্কৃতি রক্ষা আর শেকড় রক্ষা একই এবং সেগুলো তারা সবসময় ছড়িয়ে দিতে চায় সারা বিশ্বে। যেমনটা আমরা দেখতে পায় বিশ্বব্যাপী আয়োজিত বড় খেলাধুলার আসর যেমন অলিম্পিক গেমস, প্যারালিম্পিকসহ বিশ্বকাপ ফুটবল ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার আসরে সেখানে আয়োজক দেশ তাদের নিজস্ব আবহমান সংস্কৃতি বিভিন্ন ডিসপ্লের মাধ্যমে তুলে ধরে ছড়িয়ে দেয় বিশ্বব্যাপী। আর এই কাজটি সহজ হয় বিদ্যালয় পর্যায় থেকে সেটি চর্চা করার মাধ্যমে।

মানুষ সংস্কৃতিপ্রবণ। একমাত্র মানুষেরই সংস্কৃতি আছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ সাংস্কৃতিক আবহে বাঁচে, সংস্কৃতির জন্ম দেয়। মানুষের সব ধরনের আচার-আচরণ, চিন্তা-কর্ম, সৃষ্টি সবই তার সংস্কৃতি। প্রতিটি সমাজের মানুষই তার নিজস্ব সংস্কৃতি বহন করে। মানুষ যেমন সংস্কৃতি সৃষ্টি করে তা আবার সমাজে লালন করে, বহন করে অর্থাৎ সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আবার তা হস্তান্তর করে যায়।

সমাজের দল বা গোষ্ঠী সংস্কৃতি বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেমন পরিবার একটি সামাজিক দল বা গোষ্ঠী। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা সেই পরিবারের আচার-আচরণ, প্রথা পালনের মধ্যে দিয়ে তা সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে যেসব পালন করতে শিখিয়ে বা শিক্ষা দিয়ে যায়। এভাবেই যুগ যুগ ধরে সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও হস্তান্তর চলতে থাকে। আর বংশ পরম্পরায় কোনো আচরণ শিখিয়ে দেওয়া ও শিখে নেওয়ার ব্যাপার চলতে থাকে এটিই শিক্ষা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যে শিক্ষা গ্রহণ করেন তা তারা নিজের মধ্যে ধারণ বা সংরক্ষণ করেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেই শিক্ষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। এভাবেই শিক্ষার মাধ্যমে আবহমান ধ্রুপদ সংস্কৃতি সংরক্ষণ চলমান থাকে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়