প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৫
প্রাথমিকে প্রয়োজন সর্বজনবিদিত শিক্ষাব্যবস্থা

শিশুদের সম্ভাবনা অপরিসীম। জন্মগতভাবেই তারা শেখার প্রতি আগ্রহী, অনুসন্ধিৎসু ও সৃজনশীল। তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা, সহায়ক অনুকূল পরিবেশ ও কার্যত সহায়তা করলে তারা সব কিছু অর্জন করতে পারে। ‘শিশু সব পারে’ অপার সম্ভাবনার বিকাশ হতে পারে এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো। ‘শিশু সব পারে’ দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি আশাবাদী ও উদ্দীপক শ্লোগান। এটি শিশুদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও শিক্ষার প্রতি আত্মবিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে।
‘আমার ছেলে সব পারে, আপনি ওকে প্রশ্ন করতে পারেন, ও বাড়িতে অ, ক, খ, ধ, ন, প এবং সংখ্যা ১ ২ ৩ ৪ অথবা বাবার নাম, মায়ের নাম, ঠিকানা সব বলতে পারে। আমি ওকে বাড়িতে প্রতিদিন পড়াই। আপনি ওকে আপনাদের স্কুলে নিতে পারেন।’ কথাগুলো আমার না, একজন মায়ের। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার শিশুর বয়স কতো, শিশুটির মা বললেন, ওর বয়স ৩ বছর ৯ মাস, তা আপনি ওকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন কিন্তু ওর তো এখনো বয়স হয়নি আমাদের এখানে ভর্তি হওয়ার।
এরপর শিশুটির মা যা বললেন, তাতে তো অবাক। কী বললেন জানেন, অনেক প্রাইমারি স্কুলের ছেলে মেয়েরা তো ধ, ন, প বাবার নাম, মায়ের নাম, ও ঠিকানা বলতে পারে না।
শিশুর সঙ্গে কাজ করতে যেয়ে আমার এরকম অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন, এসব পারা শিশুকে কেনো শেষ পর্যন্ত পরিষেবা অব্যাহত রাখতে পারি না। প্রবীণ অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ তার এক বইতে শিশুর মস্তিষ্ককে, ‘বিশ্বভরা বিস্ময়’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরো বলেন ‘প্রতিটি শিশু এক অসীম প্রতিভাবান সজীব ও উন্মুখ সত্তা’। ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগ ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সেলীনা হুসনা বানু তার শিশুর প্রথম এক হাজার দিনের বিকাশ বইতে, বলেন, ‘এক একটি শিশু যেন এক একটি যাদুর বাক্স’।
আমিাদের প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অংশগ্রহণ, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা এবং তাদের বিকাশ নিয়ে ম্ক্তু আলোচনা করা আমার মূল উদ্দেশ্য। বিদ্যমান প্রচলিত ধারণা, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে, শিশুদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও স্ব-আন্দোলিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, আনন্দদায়ক ও সর্বজনবিদিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার অভিপ্রায়, প্রয়োজনীয়তা এখানে তুলে ধরার সামান্য প্রায়াস।
শিশুদের সম্ভাবনা অপরিসীম। জন্মগতভাবেই তারা শেখার প্রতি আগ্রহী, অনুসন্ধিৎসু ও সৃজনশীল। তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা, সহায়ক অনুকূল পরিবেশ ও কার্যত সহায়তা করলে তারা সব কিছু অর্জন করতে পারে। ‘শিশু সব পারে’ অপার সম্ভাবনার বিকাশ হতে পারে এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো। ‘শিশু সব পারে’ দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি আশাবাদী ও উদ্দীপক শ্লোগান। এটি শিশুদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও শিক্ষার প্রতি আত্মবিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গত কয়েক দশকে নিরীক্ষার মানদণ্ডে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন না করলে ও একটা জায়গায় নিশ্চিত উন্নয়ন হয়েছে সেটা স্পষ্ট করে বলা যায় ভুলভাল চটকদার বিজ্ঞাপনের মতো শিশুর ভালো অভ্যাস গড়ে তোলার ২১ দিনের নিশ্চিত ফর্মুলা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ৮৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুদের ভর্তির হার ৯৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্তির হার ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
আমরা জানি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে প্রায় শেষ হতে বসেছে। এটা এক দিনে শুরু হয়নি আবার একদিনে শেষ হবে না। যে দল ক্ষমতায় আসে সে তার মতো করে শিক্ষাব্যবস্থাকে শোষণ তোষণ করে। বিগত সময়ে দেখেছি শিক্ষাক্রম ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে যেয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছিলো। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিটা একটা সময়ে বেসরকারিভাবে পরিচালিত হতো। সব সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ঢালাওভাবে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি না থাকলেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হতো। সরকার প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিটা সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে মোট পাঁচটি শ্রেণি করলো। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য অভিভাবকের অসচেতনতার দোহাই দিয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিটা নেই করে দিলো। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কিন্ডারগার্টেনগুলো শিশুদের বাগিয়ে নিলো। তবে সব প্রাথমিক স্কুলে যে এমনটা হয়েছে তা নয় আবার সব কিন্ডারগার্টেন যে এটা করেছে তাও নয়। আমাদের কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন আছে যারা বরাবরই ভালো, আগেও ছিলো এখনো আছে। তবে লক্ষণীয় বিষয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হচ্ছে। আমাদের অভিভাবকরা এখন সচেতন হচ্ছে। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিশুদের ধরে রাখার কোনো কৌশল বা অভিপ্রায় ব্যক্ত করে না। আমি কোনো তুলনা করছি না একটা কিন্ডারগার্টেনে যে শিক্ষক ক্লাস পরিচালনা করেন তাদের যোগ্যতা কি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি? না তা নয়। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকদের কাছে শিশুরা পড়তে যায় কেনো? এমন কি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকার ছেলে মেয়েরাও কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। যেখানে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস নেই সেখানে অন্যদের ওপর বিশ্বাসটা রাখা যায়? এর একটাই কারণ আমরা নিজেরা শিখি না আবার অন্যদের শেখানো দেখে অনুপ্রাণিত হই না। এই বিষয়ে একটা কথা না বললে বড় ভুল হয়ে যাবে।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও সমাজহিতৈষী, সুফী সাধক খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জের নলতা মোবারকনগর গ্রামে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের নাম মোবারকনগর ছাপিয়ে নলতা নামটা সমাধিক পরিচিত। এই নলতাতে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ প্রি-ক্যাডেট স্কুল আছে যেখানে ৪০ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরা সদর এবং ৩৫ কিলোমিটার দূরের শ্যামনগর মুন্সিগজ্ঞ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। এমনকি এই স্কুলে ছেলেমেয়ের পড়ানোর জন্য অভিভাবক বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।
নিশ্চয়ই ভালো বলে তাদের সুনাম আছে আবার শিক্ষক-শিক্ষিকা বিশেষ আন্তরিক তাই এমনটা সম্ভব হয়েছে। পাসে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে সেটিও নামকরা। আমি কথাটা এই জন্য বললাম, বেসরকারি হয়েও বিশেষ কিছু কৌশল আছে বলে তারা তাদের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে সরকারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যেও বিশেষ গুণ আছে বলে তারাও তাদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। কোনো স্কুল তো বলতে পারে না সব অভিভাবকদের জন্য সম্ভব হয়েছে। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার এই চিত্রটা বেশি প্রথমে জেলা শহর পরে উপজেলা সদর। আরো একটা ছোট জেলার নাম বলি, সেখানে সদর রোডে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন মেলা বসেছে। জেলাটির নাম বরগুনা। আমরা বলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা পড়তে পারে না, লিখতে পারে না। আমার জানতে ইচ্ছা করে। যে শিশুটা পড়তে বা লিখতে পারে না সে বছরের পর শ্রেণি অতিক্রম করে কী করে? আমরা কি তার শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি না? সব পারা শিশুকে না পারার দোহাই দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য টুঁটি চেপে ধরছি! এভাবে আর কতকাল?
প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের জীবন পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সরকার এই শিক্ষাকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী, সরকার সব শিশুকে বিনামূল্যে ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার অঙ্গীকার করেছে।
একটি শিশু শেখার ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল। যদি তাদের উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ দেয়া হয়, তবে তারা তাদের মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে। শিশুরা, তদন্ত ও অনুসন্ধান করতে পারে। তারা তাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখে, প্রশ্ন করে ও সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হয়। সৃজনশীল হতে পারে। চিত্রাঙ্কন, গান, নাটক ও গল্প লেখার মাধ্যমে তারা নিজেদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করে। সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিতে পারে। দলগত কাজ ও বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা পারস্পরিক সহযোগিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে পারে। এর জন্য আমাদের বিশেষ কিছু দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
শ্রেণি কার্যক্রমের প্রতিফলন ঘটে শ্রেণিকক্ষে। তাই শ্রেণিকক্ষে ইতিবাচক পরিবেশ আবশ্যক। শ্রেণিকক্ষে উপযুক্ত জ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই প্রয়োজন শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বলতে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিল করার জন্য ভৌত এবং মানবীয় উপাদানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করে জ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সামগ্রিক প্রক্রিয়াকেই বোঝায়। অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষাক্রমের আলোকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়াকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকেন, তাকেই শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বলে।
শ্রেণিকক্ষের ভৌত সুবিধাদি এ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। যেমন-শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী উপযোগী আসন সামগ্রী, বোর্ড, বোর্ডে লেখার সামগ্রী। শিক্ষার্থীর পাঠ ধারণ উপযোগী সুবিধাদি এ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। যেমন-আসনবিন্যাস, শিখন পদ্ধতি ও কৌশল, পরিকল্পিত কাজ, পাঠ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি, ফলপ্রসূ পাঠ উপস্থাপন, শিক্ষার্থীর মনোযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি, বিষয়বস্তু সংশ্লিষ্ট উপকরণ ব্যবহার ও মূল্যায়ন।
আমরা জানি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ন্যায্য কিছু দাবি আছে। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পান আমাদের মানুষ গড়ার কারিগররা। কিন্ত দাবি আদায় আর নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ্য বিনিয়োগ না করা, অবহেলার দায় যেনো আমার সব পারা শিশুর ওপর না বর্তায়।