বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৪

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য প্রয়োজন পাঠাভ্যাস

ড. আলাউদ্দিন
জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য প্রয়োজন পাঠাভ্যাস

বাংলাদেশে বই পড়ার সংস্কৃতি এক সময় ছিল অন্যতম সামাজিক শক্তি; যা সমাজে নানা রকম ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর সাক্ষী হয়েছিল। এ সময়কালে তরুণ সমাজ বই পড়ার মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যকর্ম এই রেনেসাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ অনেকের লেখাগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছিল আদর্শ।

বই পড়া শুধু যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয় তাই নয়, বরং এটি ব্যক্তি চিন্তা ও মনন গঠনের জন্য একটি অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। স্বাধীনতার পর যদিও কিছুটা শ্লথগতি দেখা গিয়েছিল, তবু আশি ও নব্বইয়ের দশকে তরুণদের মাঝে বই পড়ার প্রতি আকর্ষণ অক্ষুণ্ন ছিল। হুমায়ূন আহমেদসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে ভিড় হতো। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি লেখক যেমনÑসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার কিংবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয় ছিল। মেলায় বিভিন্ন ধরনের বই কেনা এবং লেখকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগও ছিল। লাইব্রেরিগুলো ছিল পাঠকের আড্ডা, জ্ঞান ভাগাভাগির স্থান এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের কেন্দ্র।

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে প্রযুক্তি ও নগরায়ণের ফলে বই পড়ার সংস্কৃতি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং উন্নয়নের মোড়কে যেন বই পড়ার সংস্কৃতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তবে এটি শুধুই সময়ের প্রতিক্রিয়া, নাকি সমাজে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার গুরুত্বের অভাব; তা গুরুত্বের সঙ্গে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

একটি পাবলিক লাইব্রেরি সমাজের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু পড়াশোনার স্থান নয়; বরং পাঠকদের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা ও আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। এখানে শিক্ষার্থীরা যেমন মানসম্পন্ন পাঠ্যবই ও গবেষণামূলক তথ্য সহজেই পায়, তেমনি সাধারণ মানুষও নতুন জ্ঞান ও চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা প্রায়শই মানসম্পন্ন বই, গবেষণামূলক তথ্য ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী থেকে বঞ্চিত হয়, যা তাদের শিক্ষাগত অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। লাইব্রেরি তাদের এমন সব জ্ঞান ও তথ্য সরবরাহ করে, যা তাদের শিক্ষাকে সমৃদ্ধ ও সম্পূর্ণ করে তোলে এবং শহরের শিক্ষার সঙ্গে তাদের শিক্ষার ব্যবধান কমিয়ে আনে। পাশাপাশি পাবলিক লাইব্রেরি একটি শিক্ষামূলক কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন বয়সি ও শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে। এটি একটি গণতান্ত্রিক ও সামাজিক পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে। তাই প্রতিটি সমাজেই লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কারণ এটি সমাজকে জ্ঞান ও প্রগতির আলোয় আলোকিত করে।

লাইব্রেরি কেবল শিক্ষার কেন্দ্র নয়, এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার স্থান, যেখানে মানুষ তাদের সৃষ্টিশীলতা ও জ্ঞানকে একত্রিত করতে পারে। এখানে সাহিত্যিক, শিল্পী, লেখক এবং গবেষকরা একত্রিত হয়ে নিজেদের চিন্তা ও কাজ ভাগাভাগি করতে পারেন, যা সমাজের সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহযোগিতাকে আরও মজবুত করে তোলে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার জন্য পাবলিক লাইব্রেরি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কারণ এখানে নানা ধরনের বই, পত্রিকা ও জার্নাল সহজলভ্য। লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য আলোচনা, প্রকাশনা অনুষ্ঠান এবং সাহিত্য আসর তরুণ প্রজন্মের মাঝে সাংস্কৃতিক চর্চার আগ্রহ তৈরি করে। এর ফলে তারা নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারে এবং সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ ছাড়া লাইব্রেরি মতামতের ভিন্নতা সত্ত্বেও শ্রদ্ধাশীল আলোচনার একটি নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে প্রত্যেকের মতামতকে সম্মান করা হয়। এটি সামাজিক বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে। কারণ এখানে ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি থেকে আসা মানুষ একত্রে আলোচনা করতে পারে, যা সমাজে সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। লাইব্রেরি তাই শুধু জ্ঞানের উৎস নয়; এটি সমাজের মেলবন্ধন ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের একটি অপরিহার্য স্থান।

লাইব্রেরি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে সমানভাবে বই পড়ার এবং জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিয়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। এখানে শ্রেণি, ধর্ম কিংবা বর্ণের কোনো ভেদাভেদ নেই; বরং এটি এক উন্মুক্ত স্থান, যেখানে সবাই সমান অধিকার নিয়ে জ্ঞান আহরণের সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে লাইব্রেরি ব্যক্তির চিন্তাশক্তি ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে, কারণ এখানে বৈচিত্র্যময় বই, পত্রিকা এবং গবেষণাপত্র রয়েছে; যা পাঠককে নিজস্ব মতামত গঠন এবং চিন্তা বিকাশে প্রভাবিত করে। লাইব্রেরি একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করে, যা মানুষকে ভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে শেখায় এবং সুস্থ আলোচনার মাধ্যমে নিজস্ব মতামত প্রকাশের সাহস জোগায়।

লাইব্রেরিতে সমৃদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের ভান্ডার রয়েছে, যা তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সঠিক তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। এটি সামাজিক বিভাজন কমাতে সহায়তা করে, কারণ এখানে সব শ্রেণির মানুষের একই ধরনের সুযোগ থাকে এবং তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে সহায়তা করে। এভাবে লাইব্রেরি একদিকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখে এবং অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রসার ঘটায়। লাইব্রেরির এই ভূমিকা একটি উন্নত, শিক্ষিত এবং সহনশীল সমাজ গঠনের জন্য অত্যন্ত কার্যকর ও প্রয়োজন।

বলাবাহুল্য, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে ইন্টারনেটে এখন অসংখ্য তথ্য সহজলভ্য হলেও সব তথ্যই যে নির্ভরযোগ্য বা প্রাসঙ্গিক, তা বলা যায় না। ইন্টারনেটে পাওয়া অনেক তথ্যের উৎস ও প্রামাণিকতা যাচাই করা কঠিন, যা ভুল তথ্যের প্রসার ঘটাতে পারে। এর বিপরীতে পাবলিক লাইব্রেরি হলো এমন একটি স্থান যেখানে সংরক্ষিত বই ও গবেষণাপত্রগুলো সাধারণত নির্ভরযোগ্য এবং যাচাই করা উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। এটি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য সঠিক তথ্য ও রেফারেন্সের উৎস হিসেবে কাজ করে, যা তাদের শিক্ষা ও গবেষণাকে ভিত্তি প্রদান করে।

লাইব্রেরির এই প্রামাণিক তথ্যভাণ্ডার শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর গবেষণার প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে তথ্য যাচাই করার সক্ষমতা বাড়ায়। লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত বই ও গবেষণাপত্রগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গবেষণার বিভিন্ন পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণের কৌশল এবং সঠিকভাবে রেফারেন্স ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারে, যা তাদের চিন্তাভাবনাকে আরও সুসংগঠিত ও তথ্যভিত্তিক করে তোলে। এভাবে পাবলিক লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে এবং তাদের মধ্যে সঠিক তথ্যের প্রতি আস্থা তৈরি করে, যা তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আরও বেশি প্রয়োজনীয়।

লাইব্রেরি একটি দেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। লাইব্রেরির অপরিসীম তাৎপর্য বিবেচনায় জেলা শহর থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লা ও প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল পর্যন্ত লাইব্রেরি স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি।

লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবে, যা তাদের শিক্ষাগত ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। লাইব্রেরির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব, যা তাদের সঠিক জ্ঞান ও নৈতিকতা শেখাতে সহায়তা করবে। রাষ্ট্রের উচিত নিয়মিতভাবে লাইব্রেরিগুলোর আধুনিকায়ন ও প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। এতে করে জনগণ সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী এবং নতুন বইয়ের সুযোগ পাবে, যা তাদের নিজস্ব মেধা ও প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করবে।

লাইব্রেরিতে মেধাবিকাশে সহায়ক বইগুলো সহজলভ্য থাকলে তাদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, যা ভবিষ্যৎ শিক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে সমাজে শিক্ষিত ও চিন্তাশীল প্রজন্ম তৈরি হবে, যারা জ্ঞান অর্জন এবং জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বড় হবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকায় ফেব্রুয়ারি মাসে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা আয়োজন করা হয়। এই মেলা শুধু ঘোরাঘুরি বা বিনোদনের স্থান নয়; এটি বইপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য উৎসব, যেখানে দেশ-বিদেশের বই কেনার সুযোগ মেলে। বইমেলা পাঠকদের কাছে নতুন বইয়ের সন্ধান পাওয়ার, প্রিয় লেখকদের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হওয়ার এবং সাহিত্যজগৎ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার বিরাট একটি মাধ্যম। এটি বইপ্রেমীদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক মিলনমেলা তৈরি করে, যেখানে সাহিত্য, জ্ঞান এবং চিন্তাধারার আদান-প্রদান হয়। তবে ঢাকার বইমেলার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে বইমেলার আয়োজনও অত্যন্ত জরুরি।

বর্তমান সময়ের প্রতিযোগিতাপূর্ণ যুগে লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এটি শুধু পাঠাভ্যাস গড়ে তোলে না, বরং একটি উন্নত, সচেতন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হয়। পাঠাভ্যাসের বিস্তার এবং লাইব্রেরির প্রতি আগ্রহ জাগ্রত করার মাধ্যমে আমরা জাতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে পারি। তবে পাঠাগারের ব্যবহারেও কর্তৃপক্ষ ও পাঠকদের সচেতন হতে হবে। কোনোভাবেই পাঠাগারকে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির কেন্দ্রে পরিণত করা যাবে না। জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় পাঠকদের বিচরণ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশে পাবলিক লাইব্রেরি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পাড়ামহল্লায় লাইব্রেরি গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা একটি সংস্কৃতিমনস্ক, শিক্ষিত এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব। দেশের প্রতিটি নাগরিককে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য, যা একটি উদার, মানবিক এবং সমৃদ্ধ জাতি গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়