প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:০৬
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব

আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র আর আমরা প্রতিনিয়ত উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত হওয়ার পথে চলছি। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি জনবহুল দেশ। আপাতদৃষ্টিতে অধিক জনসংখ্যা দেশের উন্নয়নের পথে অন্তরায় মনে হলেও আমরা বাংলাদেশের এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার মাঝেই খুঁজি সম্ভাবনার অবারিত দুয়ার।
দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠী সম্পদে পরিণত করতে পারলে খুব দ্রুতই আমরা উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। বিশাল এই জনগোষ্ঠী দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে, তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ আর দক্ষতার উন্নয়ন জরুরি। আর এজন্য গতানুগতিক ধারার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল), কারিগরি শিক্ষা আর কর্মমুখী শিক্ষার বিকাশ ঘটানো। যেখানে প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের জোগান দেওয়াই হলো কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষার মূল লক্ষ্য।
আর কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরের মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে এক সময় জনসংখ্যাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে পরিকল্পিত নীতির কারণে জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। এ সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার বিষয়টি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে।
বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের মাত্র ১ শতাংশ লোক কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল। বর্তমানে এই হার প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। এই ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে আশা করা যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আমাদের সমাজে এখনো এই ধারণা প্রচলিত আছে যে, তুলনামূলক কম মেধাবী বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যায়—যাতে শিক্ষা শেষ করেই অপেক্ষাকৃত ছোট চাকরিগুলোয় ঢুকতে পারে। এই ধারণা যে পুরোপুরি ভুল, তা বলা যাবে না।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোয় যারা ভর্তি হয়, তাদের অনেকেই হয় অন্যকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না; নয়তো আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে বা নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সেখানে ভর্তি হতে হয়। আমাদের এই ধারণাগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা জরুরি।
সেইসাথে একইসঙ্গে নতুন নতুন শিল্প ধারণা সৃষ্টি করে সেই শিল্পে মানুষের দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে যুগোপযোগী করে এর বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব। আবার এর উৎকর্ষ, পরিবর্তন ও কারিগরি জ্ঞান থেকে অর্জিত ফলাফল যাচাইয়ের সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে সব পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।
প্রযুক্তির সান্নিধ্যে থেকে বাস্তবধর্মী ও হাতেকলমে শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা। যে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প, কৃষি ও কলকারখানার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অর্থাৎ আমাদের শ্রমবাজারকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিকে রূপান্তর ও দেশের শিল্পায়নের পথে কারিগরি শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব এতটাই বেশি যে শতভাগ কর্মসংস্থানই তার প্রমাণ। আমাদের দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরের শেষ দিকে এসে ভোকেশনাল শিক্ষার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হয়। এরপর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার পর ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সুযোগ বিদ্যমান রয়েছে। এই শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হলো বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নত দেশগুলো কারিগরি শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহার ও কৌশল প্রয়োগ করে শিল্প ও কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কারিগরি শিক্ষা একটি উৎপাদনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, যা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
কারিগরি শিক্ষা শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, এতে করে শ্রমিক সহজেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে প্রবেশ করে দক্ষ জনশক্তি ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ বৃদ্ধি করে। কারিগরি শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়, প্রয়োজনীয় মূলধন অর্জন করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব হয়।
কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঐঁসধহ ঈধঢ়রঃধষ অর্থাৎ মানবসম্পদে রূপান্তর করে শিল্পায়নে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে, আত্মকর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
একটি দেশের পরবর্তী শিক্ষাস্তর কেমন হবে তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের মানবসম্পদকে কীভাবে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তার ওপর। এখানে শুধু কর্মসংস্থানের বিষয়ে ভাবলেই হবে না, বরং একজন শিক্ষার্থী যাতে তার অর্জিত শিক্ষা প্রয়োগ করে উদ্যোক্তা হতে পারে সে বিষয়েও ভাবতে হবে।
কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতীয় শিক্ষা কমিশন বলেছে, ‘ঊফঁপধঃরড়হ ংযড়ঁষফ নব ফবাবষড়ঢ়বফ ধং ঃড় রহপৎবধংব ঢ়ৎড়ফঁপঃরারঃু.’। বর্তমান বিশ্বে চাকরির বাজারে উৎপাদনশীল খাতই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে।
বর্তমানে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিল্পায়নের ফলে নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে আর তাতে বিনিয়োগ করছে পৃথিবীর তাবৎ বড় বড় পণ্য ও সেবা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এসব কারণেই আমাদের দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বিদ্যমান বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) ও কারিগরি শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে ও সেইসাথে আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
কারিগরি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানো হয়; তবেই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব হবে। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করেছে। এ লক্ষ্যে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য আগামীতে অষ্টম শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষা চালুর চিন্তাভাবনা করছে।
কারিগরি শিক্ষা চালু হলে তা শিক্ষার্থীরা ধারণ করে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা গবেষণা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে যে শিল্পকারখানাগুলো রয়েছে সেগুলোর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে কী ধরনের কারিগরি শিক্ষার প্রচলন করা হলে তা শিল্পে প্রয়োগযোগ্য হবে সেটা জানতে হবে।
আবার কারিগরি শিক্ষা যেহেতু হাতে-কলমে নিতে হয়, তাই এ শিক্ষা প্রয়োগের আগে কারিগরি উপকরণগুলো যথেষ্ট পরিমাণ আছে কিনা সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ছাড়াও বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে ল্যাব গড়ে তোলার মনোভাব দেখাতে হবে। এটি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও আসতে পারে।
মনে রাখতে হবে, এটিকে কোনো দান নয় বরং কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সঙ্গে যারা এ কারিগরি শিক্ষা প্রদান করবেন, তারা হাতে-কলমে এ শিক্ষা প্রদানে সক্ষম কিনা সেই বিষয়টিও ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে যারা এ ধরনের শিক্ষা দান করবেন, তাদের এখন থেকেই বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
কারিগরি শিক্ষার শিক্ষাক্রম এমনভাবে তৈরি করতে হবে—যাতে মানুষের কল্পনাশক্তি তার কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের একটি উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করে সমাজ ও দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার মাধ্যমেই আমাদের দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ জনশক্তির প্রবল অভাব রয়েছে। যা মানবসম্পদ রপ্তানির অন্যতম চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাকে যদি মানব উন্নয়নের একটি অন্যতম সূচক ধরা হয়, তাহলে সেই শিক্ষার ধরনটা এমন হওয়া উচিত, যেখানে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের পাশাপাশি প্রাপ্ত শিক্ষাকে ব্যবহার করে একজন শিক্ষার্থী জীবনধারণে সক্ষম হবে ও ক্রমশ উন্নতি করবে।
আর এখানেই বাংলাদেশ পিছিয়ে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের চেয়ে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপির হার অনেক বেশি। অথচ ১৯৭০ সালে এই দেশগুলোর জিডিপির হার আর বাংলাদেশের হার ছিল প্রায় কাছাকাছি। তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে একমাত্র কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
কাজেই আমাদেরও শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল থেকে প্রবর্তিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে নতুনভাবে বাস্তবমুখী করে সাজাতে হবে। যদি প্রাথমিক স্তরে জীবনাচরণ সম্পৃক্ত শিক্ষা প্রবর্তন করা যায়, তবে যে উদার ও সৃজনশীল চিন্তা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে, তা তাকে পরবর্তী শিক্ষা স্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করবে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটি জাতি পারে তার সমাজ, দেশ তথা সারা বিশ্বের পরিবর্তন করতে। শিক্ষা ব্যতীত কোনো দেশ বা জাতির পরিবর্তন কখনো সম্ভব না। জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষা। আর শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভরশীল। মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন সেটি বের করা প্রয়োজন। যখন আমরা মানবসম্পদের কথা বলি তখন জীবনসম্পৃক্ত শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন শিক্ষাকে জীবনসম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, তখন কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।