প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২
একমুখী বা বহুমুখী শিক্ষা : বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ
সরকার ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে বহুমুখী শিক্ষা চালুর ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ আবার চালু হচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে মাধ্যমিক পর্যন্ত একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর অংশ হিসেবে এ বিভাজন বন্ধ করা হয়। বিভাগ বিভাজন বা বহুমুখী শিক্ষা চালু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, ১৯৬১ সালে। সে সময় নবম ও দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর জন্য বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ গণিত বাধ্যতামূলক রেখে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যÑএ তিন বিভাগের যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার নিয়ম চালু হয়। তবে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের সবাইকে আবশ্যিক হিসেবে সাধারণ বিজ্ঞান পড়তে হতো। এটা চলেছে পরবর্তী বহু দশক।
২০০৩ সালে তদানীন্তন সরকার একমুখী শিক্ষা চালু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে তারা মাধ্যমিকে উল্লিখিত বিভাজন তুলে দিয়ে একমুখী শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই সময় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রস্তাবিত এ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বিভিন্ন সেমিনার অনুষ্ঠানে এ পদ্ধতিতে ‘বিজ্ঞান শিক্ষা ক্রসফায়ারে চলে যাবে’ বলে বক্তব্য দেন তিনি; শুরু করেন পত্রিকায় লেখালেখি। তবে ওই একমুখী বিজ্ঞান শিক্ষাকে সমর্থন জানিয়ে আংশিক সংযোজন ও বিয়োজনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম পত্রিকায় লিখলেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করলেন, মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেলে আধুনিক যুগের সম্পূর্ণ নাগরিক গড়া বাধাগ্রস্ত হয়। সেজন্যে সাধারণ বিষয়ের সঙ্গে যে বিজ্ঞান শিক্ষা থাকবে, এতে জটিলতর গণিত ছাড়া সহজবোধ্য ভাষায় বিজ্ঞান বই থাকতে হবে। কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে আন্দোলনে নিয়ে গেলেন। যুক্তি একটাইÑএই একমুখী শিক্ষায় জাতি পিছিয়ে পড়বে। আন্দোলনের আকার চরম পর্যায়ে পৌঁছালে সরকার একমুখী শিক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়।
এরপর দেশের রাজনীতিতে নানা ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। এসেই তারা চলমান বহুমুখী শিক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করে। বলা হলো, এখন থেকে মুখস্থ ও নকল করে পাস করার দিন শেষ। কিন্তু এতে বাস্তবে কী লাভ হয়েছে? মুখস্থনির্ভরতা কমেনি। বাজারে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি ও উত্তর পাওয়া যেত। নকলও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
এর পর ২০২৩ সাল থেকে সিলেবাস পরিবর্তন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যায়ক্রমে আবার একমুখী শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। পাঠ্যক্রম বোর্ড ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের পরিবর্তন করে নতুনভাবে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে। বাড়ি থেকে অ্যাসাইনমেন্ট লিখে এনে শিক্ষকের কাছে জমা দিতে হয়। ষাণ্মাসিক, বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল হয়। ২০২৪ সাল থেকে নবম শ্রেণিতে আবার একমুখী শিক্ষা চালুর প্রচেষ্টা চলে। এর নেতৃত্ব দেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ আরও কয়েকজন। ২০০৫ সালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও কয়েকজন বুদ্ধীজীবী একমুখী শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঝড় তোলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সে সময়ে একমুখী শিক্ষা বাতিল হয়। আবার সেই ব্যক্তির নেতৃত্বে সরকার কীভাবে একমুখী শিক্ষা চালু করে? তাঁর মতো ব্যক্তির এমন দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করা খুবই দুঃখজনক।
এ শিক্ষানীতির অধীনে প্রণীত সপ্তম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানে তৃতীয় লিঙ্গের বিষয় নিয়ে শরীফার গল্প জুড়ে দেওয়া হয়। স্কুলে ডিম ভাজি, রান্নাবান্না শেখানো শুরু হয়। অনুশীলনী চর্চার নামে ফেসবুকে তৈরি উত্তর ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি থেকে লিখে আনে। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এরই মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ঘটে যায়। সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দাবিতে আবার দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে ঝড় ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে সংশোধন ও পরিমার্জন করে পাঠ্যপুস্তক চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষার বদলে বহুমুখী শিক্ষায় ফিরে যায় দেশ।
বহুমুখী শিক্ষা নিয়ে কলিঙ্গ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রয়াত ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী সবার জন্য বিজ্ঞান শীর্ষক লেখায় স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমাদের দেশের মাধ্যমিকে নবম শ্রেণি থেকে অবশ্যই একদিন সবাইকে একমুখী শিক্ষায় যেতে হবে। আমরা আগামীতে সেদিনের অপেক্ষায় থাকব।
এবার শিক্ষার প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে সুপারিশরূপে কিছু কথা বলতে চাই :
এক. স্কুল পরিচালনায় একটি ম্যানেজিং কমিটি রয়েছে। এটি রাজনৈতিক দলনির্ভর দুর্নীতির কাঠামোয় তৈরি। এটি বদলাতে হবে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি একজন অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার বা কলেজ শিক্ষক হতে পারেন। রাজনীতি থেকে স্কুলকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে।
দুই. স্কুল-কলেজের ছুটি কমাতে হবে। বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি রাখার কোনো অর্থই নেই। এ ছুটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আরও বহির্মুখী ও প্রাইভেটকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে মুক্ত হতেই হবে। তিন. শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক।
চার. সিলেবাস ও বইপুস্তকে প্রতিটি সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে নানা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সংযোজন-বিয়োজন হয়। এসব বন্ধে সত্য ঘটনা তুলে ধরতে হবে।
পাঁচ. এ দেশের মতো এত নিম্নবেতন বিশ্বের কোনো দেশে শিক্ষকদের দেওয়া হয় না। বিশেষত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পরিবর্তন করে সরকারি স্কুলের সমকক্ষদের সমান করতে হবে। বেসরকারি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে স্নাতক, সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ আয়োজিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক পদে নিয়োগ পান। অনেক ধাপ অতিক্রম করে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তারা বহুবিধ বৈষম্যের শিকার। তারা শুধু সংশ্লিষ্ট গ্রেডের বেসিক ১২ হাজার ৫০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে ১৬ হাজার টাকা পান। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া মাত্র ১ হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা যোগ হয়। পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করছি, আগামী বাজেটে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের অন্তত মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া এবং ঈদ/পূজার বোনাস পূর্ণ স্কেলের সমান দেওয়া হোক। রাজনৈতিক দলগুলো আগামী দিনে ক্ষমতায় এসে শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূর করবে, এটাই আশা। দেশে মাত্র ৪০০-৫০০ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। বেসরকারি বিদ্যালয় ২০-২৫ হাজার। তাই বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পরিবর্তন না করে শিক্ষার মানন্নোয়ন সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, মাধ্যমিক শিক্ষকদের অসন্তুষ্ট রেখে একমুখী বলুন আর বহুমুখী শিক্ষাই বলুন, বাস্তবায়ন অবশ্যই কঠিন।