প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৩, ১০:১৫
শিক্ষা এবং সামাজিক স্বাস্থ্য রক্ষার আখ্যান
শিক্ষার সঙ্গে জীবনাচরণ ও মানবিকতার কিছু পাঠ গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে। আর মানুষের জীবনাচরণ তার নিত্যদিনের বিচিত্র কর্ম, আচার-ব্যবহার ও খুঁটিনাটি অভ্যাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। মানুষ পরিবার-পরিজন থেকে, পাড়া-প্রতিবেশী থেকে এবং সমাজ-সংসার থেকে এই জীবনাচরণের কিছু কিছু পাঠ গ্রহণ করে থাকে। এসব পাঠ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনানুষ্ঠানিক। এই অনানুষ্ঠানিক জীবনাচরণ ও জীবনাভিজ্ঞতা মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বিদ্যায়তনিক পটভূমির ভেতর দিয়ে এবং শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে মানুষ যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করে, তা সুপরিকল্পিত ও পরিমার্জিত।
তার মানে, এই জ্ঞান পাঠ গ্রহণ ও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সঙ্গে অনেকাংশেই সম্পর্কিত নয়। শিক্ষার্থীদের এই জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয় বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলের ভেতর থেকে। এর মধ্যে রয়েছে সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার দক্ষতা, সর্বত্র পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, প্রতিনিয়ত নানা কাজে বিচিত্র শ্রেণি-পেশার এবং ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেই সম্পর্ক সুষ্ঠু-সুন্দর ও মর্যাদাকর পরিস্থিতিতে পরিচালনা করা। এই হলো একটি সভ্য সমাজের প্রাথমিক কিছু জীবনসংহিতা। আমাদের সমাজে তা রক্ষা করার শিক্ষা আমরা কতটুকু পাচ্ছি?
পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে, কর্মস্থলে, অনুষ্ঠানাদিতে, সভা-সমাবেশে আমরা মানুষের যে জীবনাচরণ দেখতে পাই, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনে হয়, কোনো শিক্ষাই যেন আমরা গ্রহণ করি না। মনে হয়, পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কোথাও আমরা সুষ্ঠু কোনো মূল্যবোধ, কোনো নীতিনৈতিকতা, কোনো আদর্শ আমরা শিখছি না। সভ্য সমাজের যে কিছু কোড অব কন্ডাক্ট থাকে তার লেশমাত্রও আমরা অনুসরণ করি না।
কয়েকটি উদাহরণ দিই। মনে হবে, উদাহরণগুলো খুব স্থূল, নগণ্য ও উল্লেখের অনুপযোগী। কারণ, এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা প্রতিনিয়ত বসবাস করি যেখানে এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তা অনুভব করার বোধও আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। কিন্তু ঘর থেকে বের হলেই আমরা প্রায় প্রত্যেকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। সুতরাং বিষয়গুলোকে ক্ষুদ্র ও নগণ্য হিসেবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা শহরে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আমরা বসবাস করি। এই সংখ্যা ২ কোটি ৩৩ লাখেরও ওপরে। সুতরাং যখনই আমরা রাস্তায় পা বাড়াই তখনই আমাদের সতর্ক ও সুশৃংখলভাবে চলাফেরা করা উচিত। কেননা এত মানুষের চলাচলের রাস্তায়, জানবাহনে, হাটে-বাজারে, সভা-সমাবেশে আমরা যদি সতর্কভাবে ও সুশৃংখলভাবে চলাফেরা না করি তাহলে অনেক অঘটন ঘটতে পারে, অন্যের সমস্যারও কারণ হতে পারে। আর প্রতিনিয়তই তা ঘটছে।
প্রথমত, আমরা দেখি, প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই পথচারীর রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকছে, কথা বলছে কিংবা একাধিক ব্যক্তি রাস্তার মাঝ দিয়ে কথা বলতে বলতে এমনভাবে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে যে, তারা ছাড়া যেন অন্য কোনো লোক এই পথে হাঁটে না। এই পরিস্থিতিতে সবাই বিরক্ত হয়, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। কারণ, বললে উল্টো তার নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কা আছে। সুতরাং সবাই মুখ বুঝে এই অত্যাচার সহ্য করে।
দ্বিতীয়ত, সব বয়সের মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল চালায়। তাদের সকল মনোযোগ থাকে মোবাইলের দিকে। বলা যায়, ভয়াবহ পরিস্থিতি। অন্যের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া থেকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব হয়ে ওঠে পথচারীদের। অথচ ইচ্ছা করলেই ফোন করার জন্য কিংবা ফোন রিসিভ করার জন্য রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে জরুরি কাজ সেরে নিতে পারেন যে কেউ। কিন্তু আমরা এতই ব্যস্ত যে, একটু দাঁড়িয়ে ফোনের কাজটুকু করার মতো সময় নেই। আমাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হবে এবং মোবাইল চালাতে হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হলো, রাস্তা পাড় হওয়ার সময়ও অনেকে মোবাইলে কথা বলা বন্ধ করেন না। অনেকে ফুটওভারব্রিজ পাড় হওয়ার সময় সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মোবাইল চালান। অনেকটা আন্দাজের ওপর তিনি সিঁড়িতে পা রাখেন। এই বিষয়গুলো যে শুধু দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত তা নয়, সংবেদনশীল পথচারীদের মনঃকষ্টেরও কারণ। আমরা নিশ্চয়ই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছি। সুতরাং জিজ্ঞাস্য, আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে আমরা কী শিখি এবং স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বা আমরা কী শিখি? স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রমে বা পাঠ্যপুস্তকে সরাসরি এ ধরনের পাঠ থাকে না। কিন্তু পাঠই তো শেষ কথা নয়, পাঠান্তর বলেও কথা অছে, যেখান থেকে জীবনের কোড অব কন্ডাক্টগুলো শেখা যায়। এগুলোকে বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইপ্রোডাক্ট-উপজাত। আর এর মূল কথা হচ্ছে যৌক্তিক ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করার পাঠ। এ হলো একধরনের বোধ, চেতনা, সংবেদনা যা কেউ কাউকে শেখায় না, পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে শিখে নিতে হয় সবাইকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে আমাদের এই যৌক্তিক জীবনাচরণ অনুসরণ করার কথা, কিন্তু আমরা তা করি না।
তৃতীয়ত, অনেক লোক রাস্তা দিয় হাঁটতে হাঁটতে কিংবা গাড়িতে চড়তে চড়তে যেখানে-সেখানে থুতু ফেলেন, যেখানে-সেখানে কাশ ফেলেন, যেখানে-সেখানে নাক পরিষ্কার করেন, গলা খাকড়ান, পানের পিক ফেলেন। অথচ এমন একটি আচরণ কিছুতেই শোভন নয়, যৌক্তিক নয় এবং স্বাস্থ্যকর তো নয়ই। ইউরোপে সতের শ শতকের শেষভাগ থেকেই এই বাজে অভ্যাস থেকে লোকদের মুক্ত করার জন্য সামাজিক সচেতনতা তৈরি হয়। এমনকি সেখানে ‘কন্ডাক্টস বুক’ নামে এক ধরনের বই প্রকাশ হতে থাকে যেখানে বিস্তারিতভাবে সামাজিক নর্মসগুলোর উল্লেখ করা হয়। সর্বত্র কী করতে হবে আর কী করতে হবে না, তার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকত এই ধরনের পুস্তিকায়। কিন্তু আমাদের দেশে এই নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই, বিকার নেই, কোনো মাথাব্যথা নেই। এই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে রমজানের দিনগুলোতে। কিন্তু যারা এসব করেন তাদের রুচিবোধে কখনোই বাধে না যে, মলমূত্র ত্যাগের যে কাজগুলো আমরা পথে-ঘাটে করি না, এই কাজগুলোও মূত্রত্যাগের সমগোত্রীয়। পথে-ঘাটে তো নয়ই, এমনকি লোকসম্মুখে এসব করা শোভন নয়।
চতুর্থত, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে হাত দুলিয়ে দুলিয়ে এবং সিগারেট টানতে টানতে ব্যস্ততম রাস্তা দিয়ে পথ চলেন অনেকে। এতে অন্য পথচারীদের যে অসুবিধা হচ্ছে, কারও গায় যে আগুন লেগে যেতে পারে, সিগারেটের ধোঁয়ায় কারওে যে কষ্ট হতে পারে, অস্বস্তিবোধ হতে পারে-এই নিয়ে এদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার কারও কোনো অভিযোগ, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধও লক্ষ করা যায় না। অথচ জনসমক্ষে সিগারেট পান করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু কে মানছে আইন আর কে করছে আইনের প্রয়োগ?
উদাহরণগুলো খুবই সুলভ, খুবই সহজপ্রাপ্য। এমন কেউ নেই যে, প্রতিনিয়ত যাদের এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় না। আমার মনে হয়, ঢাকা শহরে কেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ শহরে-হাটে-বাজারে প্রতিনিয়ত আমাদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, এই পরিস্থিতির মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়।
পথচারীদের রাস্তার ওপর দিয় মোটরসাইকেল চালিয় যাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মোটরসাইকেলের এই উপদ্রব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা। এসব মোটরসাইকেলের চালকগণ কোনো কিছুকেই পরোয়া করেন না। এমনকি মানুষের পায়ের ওপর দিয়ে, তার গায়ে লাগিয়ে দিয়ে, তাকে কোণঠাসা করে মোটরসাইকেলের চালকগণ নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে ও বীরধর্পে প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তার কোনো বিধি-বিধান তিনি মানছেন না, যানবাহন চালানোর কোনো ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করছেন না। আর সকল পথচারী এই অত্যাচার নীরবে হজম করছেন। কারণ প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো অপদস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থা সারা দেশে প্রায় একই রকম। আরও একটি উদাহরণ দিই। যাত্রীবাহী বাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করেছে। অনেক সময় দেখা যায়, খুব স্বল্প পথ পাড়ি দিতেও তারা সিটে বসে থাকে। বয়স্ক ব্যক্তি, নারী কিংবা শিশুদের জন্যও তারা কোনো অবস্থাতেই সিট ছেড়ে দেয় না। এমনকি কোনো অসুস্থ মানুষের জন্যও এসব শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতী শিক্ষার্থীরা সিট ছাড়ে না। তাহলে বিদ্যায়তনিক শিক্ষা আমাদের কোন মানবিক গুণে গুণান্বিত করছে! মানুষের প্রতি সহানুভূতি, দয়া, দাক্ষিণ্য, স্নেহ, ভালোবাসা শিখতে হয় সাধারণত পরিবার থেকে এবং মূলত বিদ্যায়তনিক শিক্ষার ভেতর থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই মানবিক মূল্যবোধগুলো কাজ করছে না। বিষয়টি সহজভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের উত্তরপ্রজন্মের মধ্যে যদি মানবিক মূল্যবোধই কাজ না করে, তা হলে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা আর প্রতিষ্ঠা তেমন কোনো কাজে আসবে না।
আমাদের সামাজিক অবস্থা নিয়ে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো। উদাহরণগুলো এই জন্য উল্লেখ করা হলো যে, পারিবারিক শিক্ষা কিংবা বিদ্যায়তনিক শিক্ষার ভেতর থেকে আমরা যদি জীবনাচরণের কোড অব কন্ডাক্টগুলো আয়ত্ত না করি, তাহলে একটি সভ্য, সংস্কৃতিপরায়ণ ও রুচিশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। কোনো প্রতিষ্ঠাই টেকসই হয় না যদি তার সঙ্গে মানবিকতার জগৎ সম্পৃক্ত না হয়, যদি তার সঙ্গে পরিবেশ ও প্রতিবেশের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত না হয়। মূলত বিদ্যায়তনিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে আমাদের নিরন্তর উত্তরপ্রজন্মের মধ্যে সুষ্ঠু-সুন্দর ও মানবিক জীবনাচরণ জন্ম নেবে, এই প্রত্যাশা করি।