প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
শিক্ষক দিবস ও শিক্ষকের মর্যাদা
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
এই প্রথমবারের মতো ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশে ‘শিক্ষক দিবস’ পালন করার ঘোষণা করেছে সরকার। দিবসটি পালন করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে। যদিও ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শিক্ষকের মানসম্মান ও মর্যাদা সমাজে আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
|আরো খবর
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম দুঃখ করে বলেছিলেন, ভারতবর্ষে ডাক্তার চান তাঁর ছেলে ডাক্তার হোক। প্রকৌশলী চান তাঁর ছেলে প্রকৌশলী হোক। পুলিশ অফিসার চান তাঁর ছেলে পুলিশ অফিসার হোক। শুধু শিক্ষকরাই চান না তাঁর ছেলে শিক্ষক হোক। ব্রিটিশ সরকার একবার প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালকে স্যার উপাধি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। আল্লামা ইকবাল জানালেন, এটা তো সম্ভব না! আমাকে কোনো উপাধি দেওয়ার আগে আমার শিক্ষক মৌলভি হাসানকে উপাধি দিতে হবে। ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা তো অবাক! এটা কিভাবে সম্ভব? নানা ক্ষেত্রে আপনি অসামান্য অবদান রেখেছেন, নতুন চিন্তা, দর্শন, মতাদর্শ তৈরি করেছেন। কিন্তু আপনার শিক্ষক কী এমন করেছেন যে তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি দিতে হবে? জবাবে আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘তিনি আমাকে তৈরি করেছেন।’ আল্লামা ইকবালের শিক্ষক মৌলভি হাসানকে শামসুল উলুম খেতাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইকবাল বললেন, ‘আমার সেই শিক্ষকের শরীর ভালো না, তিনি এখানে আসতে পারবেন না। আপনাদের শিয়ালকোট গিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়ে এই উপাধি প্রদান করতে হবে।’ ইকবালের অনমনীয় ইচ্ছা মেনে নিয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল শিয়ালকোট গিয়ে মৌলভি হাসানকে শামসুল উলুম খেতাবে ভূষিত করে। ইকবালের জন্য মীর হাসানকে মানুষ চিনেছে। আর মীর হাসানের জন্য ইকবালের মতো দার্শনিক তৈরি হয়েছে। এটাই হলো একজন ছাত্রের একজন শিক্ষকের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পদার্থে নোবেল পাওয়া প্রফেসর সালাম বললেন, ‘আমার স্কুল শিক্ষক অনিলন্দ্র গাঙ্গুলী না থাকলে আমি আজকের সালাম হতাম না। এই সম্মান আমার শৈশবের সেই শিক্ষকের প্রাপ্য।’ তিনি ভারত সরকারের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন তাঁর শৈশবের শিক্ষককে খুঁজে বের করতে। তাঁকে খুঁজে বের করা হলো, প্রফেসর সালামের সঙ্গে কথা বলার আয়োজন করা হলো। প্রফেসর সালাম কুশল বিনিময় করে সব কিছু বললেন, শুধু নিজের নোবেলপ্রাপ্তির খবরটুকু বললেন না। তিনি বললেন, ‘এই খবর আমি সশরীরে তাঁর কাছে গিয়ে দিতে চাই।’ এবং তিনি তা-ই করলেন। পরের সপ্তাহে শিক্ষক গাঙ্গুলীর ভিটায় উপস্থিত হয়ে তাঁর হাতের স্পর্শ মাথায় নিয়ে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নোবেলপ্রাপ্তির খবর জানালেন। এটাই হলো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের বিনয়। এটাই হলো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হওয়ায় ফিনল্যান্ডে সবচেয়ে মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। কিন্তু ভারতবর্ষে এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। শিক্ষা বিভাগগুলো এখানে অবহেলিত। ফলে একজন শিক্ষা ক্যাডার চান অন্য ক্যাডারে যেতে। কারণ অন্য বিশেষ ক্যাডারগুলোতে এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে একজন শিক্ষককে তাঁদের সামনে নতজানু হয়ে থাকতে হয়।
আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এর জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা দায়ী। শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। পরিচালনা কমিটিতে থাকেন দলীয় ও অল্পশিক্ষিত লোকজন। তাঁদের কথামতো না চললে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের চাকরি থাকে না। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য যেকোনো ক্যাডারের চেয়ে অনেক কম। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষার্থীরা আজকাল খাতাণ্ডকলম নিয়ে লেখাপড়ার চেয়ে ডিভাইস ও প্রযুক্তিমুখী হয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রবাহের অবাধ স্বাধীনতা ও ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে বিপথগামী হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষকদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো সময়ই শিক্ষকদের অর্থবিত্ত ছিল না, হয়নি। তাই বলে একজন আদর্শ শিক্ষক জ্ঞান বিতরণে কোনোকালেই থেমে যাননি, ভবিষ্যতেও যাবেন না। এটাই হোক শিক্ষক দিবসে শিক্ষকের শপথ। একজন শিক্ষক হয়তো অর্থ বা ক্ষমতার দিক দিয়ে বড় কেউ নন; কিন্তু মহত্ত্ব এবং মর্যাদার দিক থেকে সবচেয়ে উঁচু জায়গায় তাঁদের অবস্থান। ম্যানকে হিউম্যান বানানোর কারিগর সব শিক্ষককে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। শুভ শিক্ষক দিবস।
লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।