প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫, ২১:১৪
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আলোচনা সভা
নারী পুরুষের বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্র, সমাজ ও বাস্তবতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ
----------জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে 'অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন' এই প্রতিপাদ্যের ওপর জেলা প্রাশাসন ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে এবং সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও টিআইবিসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে শনিবার (৮ মার্চ ২০২৫) র্যালি, মানববন্ধন এবং র্যালি পরবর্তী আলোচনা সভা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন।
|আরো খবর
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৯০৮ সালে নারী পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি থেকে নারী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তাদের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুদিন পরই নারী দিবস উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্যে রাষ্ট্র সবসময় নারীদের পাশে আছে। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র, সমাজ ও বাস্তবতা এই তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মূল আইন হলো আমাদের সংবিধান। সেই সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে নারীদের প্রতি সমান অধিকার ও বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে। নারীদের পেছনে ফেলে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করতে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র কোনোভাবেই নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে না। তিনি আরও বলেন, অনেক সময় নারীদের বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্রের আইনের চেয়ে সমাজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাকুরি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও সরকার নারীদের অনেক সুযোগ- সুবিধা দিয়েছে। নারীদের প্রতি বৈষম্য ক্রমশ দূর হওয়ায় সমাজ ব্যবস্থা বহু গুণে পাল্টে গেছে। রাষ্ট্র কোনোভাবেই অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয় না। তিনি আরও বলেন, নারীর প্রতি কোনো ধরনের অন্যায় রাষ্ট্র কোনোভাবেই মেনে নেবে না। সমাজের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নারীদের কোনো পদচারণা নেই। তিনি নারীদের আরও বেশি সাহসী হওয়ার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা এমন একটি দেশ দেখতে চাই, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। নারীদের পিছিয়ে রেখে সমাজ কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। তিনি নারী দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ জানান। অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন সনাক-চাঁদপুরের সহ-সভাপতি জেসমিন আক্তার জেসী।
ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেলের প্রোগ্রাম অফিসার এসএম তানভীর রশিদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুকুর চাকমা, চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাখাওয়াত জামিল সৈকত, জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাছিমা আক্তার, ব্র্যাক চাঁদপুরের প্রতিনিধি জিয়াউর রহমান, মহিলা বিষয়ক অধিপ্তরের প্রশিক্ষণার্থী মমতাজ আক্তার ও ডে-কেয়ার অফিসার কামরুন্নাহার ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জনে করণীয় হিসেবে সনাক-টিআইবি আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেছে। দাবিগুলো হলো--বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও 'নতুন বাংলাদেশ'-এর মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিকূলতা দূরীভূত করতে সকল অংশীজনের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে; টেকসই উন্নয়ন অর্জনের কর্মপরিকল্পনায় অভীষ্ট-৫ ও ১৬ কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধের পূর্বশর্ত হিসেবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণসহ আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে; নারীর প্রতি সহিংসতা ও নানা অজুহাতে যত্রতত্র হেনস্তা রোধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে; নারী ও শিশু নির্যাতনসহ সকল প্রকার নারী অধিকার হরণের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল প্রতিষ্ঠানকে, বিশেষ করে প্রশাসন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি প্রতিরোধ, শুদ্ধাচার, জবাবদিহিতা ও সার্বিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে; জেন্ডার সমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে নারীর অভিগম্যতা নিশ্চিত, ইন্টারনেট ও প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সুলভ করা এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; অনলাইনে সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিতে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাঙ্গনে বা সমাজে নারীর সমান সুযোগ দেওয়ার জন্যে কাজ করছে, তাদের উৎসাহিত করতে হবে, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে; নারীদের জন্যে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল বিনিয়োগ ও বরাদ্দকৃত বাজেটের স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যেন প্রকৃতপক্ষে নারীরাই উপকৃত হন। নারীদের জন্যে শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ও বেসরকারি উভয়ভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে; সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলসমূহের স্ব-উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক সংস্কার করতে হবে; দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় ও সম্পদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায় সম্পর্কে নারীদের সচেতন করতে প্রচারণা জোরদার করতে হবে; নারীর নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের আইনি দণ্ড সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি ও স্থানীয় সরকার, আইনি সংস্থা ও বিচারালয়সহ নারীরা সেবা নিতে যান এমন প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবা, বিশেষ করে নারীদের জন্যে প্রদত্ত সেবা সম্পর্কে জেন্ডার সংবেদনশীল পদ্ধতিতে তথ্য প্রচার করতে হবে এবং নারীদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে; সকল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তাসহ একটি নারীবান্ধব অভিযোগ প্রদান ও নিরসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে; নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বন্ধে ব্যক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা ও প্রভাব বিবেচনা না করে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে; নারীর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ ও নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিতে সাধারণ জনগণের ইতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কার্যকর প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আদিবাসী, দলিতসহ সকল প্রান্তিক নারীদের অধিকার নিশ্চিতে বিশেষায়িত সময়াবদ্ধ পথরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষার্থীবৃন্দ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সনাক-চাঁদপুর ইয়েস গ্রুপ ও অ্যাকটিভ সিটিজেন গ্রুপের সদস্যবৃন্দ।