প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
সামীম আহমেদ খান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, চাঁদপুর রিজিওনাল অডিটের অডিট অফিসার হিসেবে কর্মরত। ১৯৮৫ সালে মাসিক ‘নির্ঝর’ সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে পদার্পণ। ১৯৮৬ সালে সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুরের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, চাঁদপুর জেলা শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবে একজন আবৃত্তিকর্মীর সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কবি ও লেখক সংগঠন ‘কাব্যলোক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৪ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ, চাঁদপুর জেলা শাখার আয়োজনে কবি সম্মেলনে শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার ও উপস্থাপকের পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, চাঁদপুর জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)তে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে একক আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন এবং আবৃত্তিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কবি, লেখক ও প্রবন্ধকার হিসেবে তাঁর অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার ও গবেষণাধর্মী লেখা স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিক ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০১৯ সালে আবৃত্তিতে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সম্মাননার মনোনীত হন।
সামীম আহমেদ খান চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ১৯৮৫-১৯৮৬ শিক্ষাবর্ষে তিনি এ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ‘চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি : প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখোমুখি’ শীর্ষক দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার পর্বে সম্প্রতি মুখোমুখি হন তিনি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।
সামীম আহমেদ খান : আমার জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১০ ফাল্গুন ১৩৭৪ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার সকাল ৮টায় নানার বাড়ি চাঁদপুর শহরের তালতলা গাজী বাড়িতে। আমার বাবা চাঁদপুর মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরকারি চাকুরি করার কারণে আমরা তালতলা সরকারি বাসায় থাকতাম। সেখানেই আমার শৈশব-কৈশোরের সময়গুলো অত্যন্ত চমৎকারভাবে কেটেছে। বাসার সামনে কুমিল্লা রোডের পাশে (বর্তমানে আবদুল করিম পাটোয়ারী সড়ক) লম্বা একটি লেক ছিলো তখন, যা ভরাট করে বাউন্ডারি দেয়াল করা হয়েছে এবং এখনকার পাকা মসজিদটি তখন বাঁশ, বেড়া ও টিন দিয়ে তৈরি করা ছিলো। ফজরের নামাজের পর হুজুর যখন মসজিদে ‘ডাক সুরা’ পড়াতেন তখন পুরো বাসভবনের চারপাশে পবিত্রতার একটা মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়তো। মুনসুর হুজুর ও বশির হুজুর আমাদের পবিত্র কোরআন শরীফ শিক্ষা দিতেন। এ রাস্তায় যখন হেঁটে যাই হুজুরদের কণ্ঠ যেনো আজও কানে ভেসে আসে সুমধুর কণ্ঠ-মধুর স্মৃতি।
১৯৭১-এর বিভীষিকাময় দিনগুলোর কয়েকটি খণ্ডচিত্র মনে আছে আজও। আমাদের বাসার ঠিক সামনের মোড়েই পুলিশ বাহিনির সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিলো বালুর বস্তা দিয়ে ঘেরা ‘বাংকার’ তৈরি করে। সেই প্রথম দেখলাম, বাংকারের ভেতর থেকে ‘থ্রি নট থ্রি’ রাইফেলের তাক্ করা অবস্থান। আজও শিহরিত হই সেই দৃশ্যকে স্মরণ করে। পরে জানলাম সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা এবং সরকারি স্থাপনা রক্ষার্থে এ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে সর্বজনশ্রদ্ধেয় আবদুল করিম পাটোয়ারী আমাদের বাসায় এসে জানালার গ্লাসে ঠক্ঠক্ আওয়াজ করে আমার বাবাকে ডেকে বললেন, ‘জামাই বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। আপনি আজ (১৫ আগস্ট’ ১৯৭৫) অফিসে যাবেন না, আপনার বিপদ হতে পারে’। সেদিন বাবার জন্যে সবাই কেঁদেছিলাম।
উল্লেখ্য, আমার বাবা মরহুম আবদুল হামিদ খান একজন সরকারি চাকুরিজীবী হলেও মনেপ্রাণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে লালন করতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ছিলেন ও সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
তালতলা গাজী বাড়ি আমার নানার বাড়ি হওয়ার সুবাদে আমার বাবাকে শ্রদ্ধেয় মরহুম আবদুল করিম পাটোয়ারী অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং জামাই বলে সম্বোধন করতেন। এভাবেই বেড়ে ওঠা সময়ে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করি বিষ্ণুদী আজিমিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কত সালে, কোন্ শ্রেণিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন?
সামীম আহমেদ খান : প্রাথমিকের সেন্টার ও বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি নিয়ে হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি শেষ করে ১৯৮৫-১৯৮৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ বিজ্ঞান বিভাগে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সে সময় কলেজের পরিবেশ কেমন ছিলো?
সামীম আহমেদ খান : কলেজের দৃষ্টিনন্দন মূল ভবনটি ছিলো চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে অন্যতম। শিল্প-সংস্কৃতির পরশমাখা প্রাণের টান অনুভব করার মতো ছিলো সে সময়ের কলেজের পরিবেশ। ক্লাস না থাকলেও কলেজ মাঠে গিয়ে অথবা বাস্কেট গ্রাউন্ডের এক কোণায় বসে আড্ডা দিতাম। স্যারদের সান্নিধ্য ও সহপাঠীদের সৌহার্দ্য অজানা একটা বন্ধন তৈরি করে ফেলতো। এক কথায় একটি পরিবারের মতো মধুর বন্ধনে আমরা কলেজের পরিবেশটাকে উপভোগ করতাম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার প্রিয় শিক্ষক এবং সহপাঠী ছিলেন কারা? তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
সামীম আহমেদ খান : আমার প্রিয় শিক্ষক বাংলার শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ খলিলুর রহমান স্যার, ইংরেজি বিভাগের শ্রদ্ধেয় এ.বি.এম. ওয়ালিউল্লাহ স্যার ও খোরশেদ স্যার, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শ্রদ্ধেয় তাজুল ইসলাম স্যার। স্যারদের অসাধারণ পাঠদান পুরো ক্লাসে সম্মোহন সৃষ্টি করতো। সহপাঠী বলতে হাসান আলীর এসএসসি ’৮৫ ব্যাচের প্রতিটি বন্ধুই ছিলো আত্মার আত্মীয়ের মতো। কলেজজুড়ে আমাদের পদচারণা ছিলো আলোর ঝলকানির মতো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য কোনো সুখের এবং দুঃখের স্মৃতির কথা জানতে চাই, যা আজও আপনার মনে পড়ে।
সামীম আহমেদ খান : সুখের স্মৃতি অফুরন্ত। প্রতিটি ক্লাস, প্রত্যেক সহপাঠী, শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের প্রাণময় অভিভাবকত্ব সুখের স্মৃতিকে বাড়িয়ে তুলতো। দুঃখের স্মৃতি হলো, পাঞ্জাবী নিয়ে। আমি প্রায়ই ক্লাসে পাঞ্জাবী পরে যেতাম। আর শ্রদ্ধেয় এ.বি.এম ওয়ালিউল্লাহ স্যার ইংরেজি ক্লাসে এসে বলতেন, ‘পাঞ্জাবী পরা সামীম ছেলেটা দাঁড়াও’। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বসতে বলতেন। ক্লাসে পাঞ্জাবী পরে আসাটা স্যার পছন্দ করতেন না। পাঞ্জাবী পরার খেসারত আমাকে অনেকবারই দিতে হয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজে পড়াবস্থায় নিজেকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখতেন?
সামীম আহমেদ খান : কলেজে পড়াবস্থায় স্বপ্ন ছিলো এলোমেলো। মূলত সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। ১৯৮৬ সালে ২২তম বিএমএ লং কোর্চণ্ডএ ‘সেকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট’ পদে পরীক্ষা দিই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস চূড়ান্ত পর্যায়ে বাদ পড়ে গেলাম। একই ব্যাচের বন্ধুরা সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ক্লাস এবং আড্ডাবাজির স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
সামীম আহমেদ খান : কলেজের প্রথম ক্লাস ছিলো গ্যালারি হলরুমে। দারুণ এক উচ্ছ্বাস ও প্রাণবন্ত পরিবেশে ক্লাসগুলো অতিবাহিত হতো। পরম যত্ন করে ক্লাসে পড়াতেন শ্রদ্ধাভাজন স্যাররা। ক্লাসে হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ’৮৫ ব্যাচের বন্ধুরাই বেশি মাতিয়ে রাখতো, খুনসুটি করতো, বিভিন্ন সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে স্যারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। স্যারদের উদ্ভাবনী প্রশ্নের জবাবের কারণে ’৮৫ ব্যাচের অনেকের নাম ধরে ডাকতেন ক্লাসে।
বাস্কেট বল গ্রাউন্ডেই মূলত আড্ডা হতো বেশি। সেখানে প্রায়ই আমি দেয়ালিকা টানাতাম। কবিতা, ছড়া, কমিক্সের সমন্বয়ে নিজের হাতে লিখে দেয়ালিকা টানিয়ে দিতাম। কবিতা পাঠের আসর হতো। প্রতিদিনই যেতাম পাশের ইনডোর গেমস্ হলরুমে। সেখানে দাবা, কেরাম বোর্ড, টেবিল টেনিস খেলতাম। মনে হতো দাবা একটু ভালোই খেলতাম। সর্বোপরি ক্লাস ও আড্ডাবাজি ছিলো প্রাণবন্ত, উল্লাসময়, উচ্ছ্বাস ও উৎসবমুখর।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ৭৫ বছরপূর্তিতে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
সামীম আহমেদ খান : কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি মানে আলোকিত প্রাঙ্গণে পুষ্পিত রোদশয্যা, সমৃদ্ধ প্রেরণার নির্যাসশক্তি, কলেজের গোলপোস্টে এক চিলতে সবুজ ঘাস, বাস্কেট গ্রাউন্ডে শেষ বিকেলে আমার দেয়ালিকায় কবিতার চরণখানি। প্রাণপ্রিয় অধ্যক্ষ এ. ডব্লিউ. এম. তোয়াহা স্যারের ভিসুভিয়াস গর্জন, মুহাম্মদ খলিলুর রহমান স্যারের পাঠশালা, রতন দা’র লাইব্রেরিতে সাহিত্য পাঠ, সহপাঠী বন্ধু ও শ্রদ্ধাভাজন স্যার যাঁদের হারিয়েছি তাঁদের প্রতি সম্মান ও প্রার্থনা।
৭৫ বছরপূর্তির অনুভূতির প্রাক্কালে ২০০৮ সালে ৬২ বছরপূর্তিতে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বিতীয় পুনর্মিলন উৎসবের কথা মনে পড়ে গেলো। অনেক কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো ২০০৮ সালে। সাংগঠনিক কমিটিতে স্থান পেয়েছিলাম আন্তরিকভাবে নিজের বিদ্যাপীঠের জন্যে বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়েছিলাম বলে। অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, গৌরববোধ করেছিলাম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা/স্বপ্ন কী?
সামীম আহমেদ খান : চাঁদপুর সরকারি কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ হবে-এটাই আমার প্রত্যাশা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য অর্জন কী?
সামীম আহমেদ খান : কবি, লেখক ও বাচিকশিল্পী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কলেজ জীবন অনেকাংশেই জড়িয়ে আছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কোন্ কোন্ সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন?
সামীম আহমেদ খান : কলেজ জীবনে আমার নিজের গঠন করা প্রথম সংগঠন ‘কথক’ (দেয়ালিকায় কবিতাপত্র ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর), সেলিম ভাইয়ের স্পুটনিক সায়েন্স ক্লাব, কলেজ ক্রীড়া টিম, লাইব্রেরির পাঠক ফোরাম, ইনডোর গেমসের সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলাম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : নতুনদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন।
সামীম আহমেদ খান : এ প্রজন্ম জ্ঞান-বিজ্ঞানে আধুনিক, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অংশীদার। প্রথমেই পরিবারের মা-বাবা তারপর বিদ্যাপীঠ ও শিক্ষকদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসতে হবে। আত্মসংযম, পরিমিতিবোধ, শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা নতুনদেরকে যথার্থ মানুষ হবার পথ দেখাবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : উল্লেখিত প্রশ্নের বাইরে আপনার কোনো কথা থাকলে বলুন।
সামীম আহমেদ খান : চাঁদপুর সরকারি কলেজ হবে কিংবদন্তিতুল্য। শিল্প, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল মানুষ তৈরি হবে এ কলেজ থেকে। এই কলেজের শতবর্ষপূর্তি হোক রবীন্দ্রনাথের ১৪০০ সাল কবিতার মতো ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে/আজি হতে শতবর্ষ পরে’ (চাঁদপুর সরকারি কলেজের শতবর্ষপূর্তি উৎসব-২০৪৬ খ্রিস্টাব্দ)।