শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

এ মিলনমেলার সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি
চাঁদপুর কণ্ঠ রিপোর্ট ॥

সফিউদ্দিন আহমেদ চাঁদপুর সরকারি কলেজের ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি (২০০২)। চাঁদপুর জেলায় ২০২১ সালের দীর্ঘমেয়াদী করদাতা এবং হাসান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির একটানা ৪২ বছরের সাবেক সভাপতি।

‘চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি : প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখোমুখি’ শীর্ষক দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার পর্বে আজ সফিউদ্দিন আহমেদের কথা তুলে ধরা হলো।

চাঁদপুর কণ্ঠ : কত সালে, কোন্ শ্রেণিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন?

সফিউদ্দিন আহমেদ : আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজের ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। ফরিদগঞ্জের রামপুর মজিদিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৬২ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজে আইএ শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমি আর্টসের ছাত্র ছিলাম।

চাঁদপুর কণ্ঠ : সে সময় কলেজের পরিবেশ কেমন ছিলো?

সফিউদ্দিন আহমেদ : সে সময়ে চাঁদপুরে একটাই মাত্র কলেজ ছিলো। আর কোনো কলেজ ছিলো না। পার্শ^বর্তী জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা এসে এ কলেজে ভর্তি হতো। তারা বেশিরভাগই মেসে থাকতো। তখন কলেজে ৬ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী ছিলো। শিক্ষার পরিবেশও ছিলো খুবই চমৎকার। তবে কম-বেশি মারামারি হতো। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। আমাদের ভয়ে সরকারি দলের ছাত্ররা মাঠে নামতেই পারতো না। তখন দুটোই দল ছিলো, একটা ছিলো ছাত্রলীগ আরেকটা ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন। একটা ছিলো ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (ডিএসএফ) ও আইডিয়াল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (আইএসএফ)। আমি, জীবন কানাই, শেখ মতিউর রহমান, শ্যামল সেনগুপ্ত আমরা কলেজের বিভিন্ন নির্বাচনের নেতৃত্ব দিতাম। আমাদের সাথে তারা পেরে উঠতো না। পরবর্তীকালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আমরা ন্যাপ করি এবং ছাত্রলীগের নেতারা আওয়ামী লীগ করা শুরু করে।

খেলাধুলায় এ কলেজের খুবই সুনাম ছিলো। তখন ফুটবল খেলাটা খুব জমজমাট হতো। সামাদ ভাই, জানু, ঝন্টু তখন খুবই ভালো ফুটবল খেলতেন। আমরা তাদের খেলা দেখতে যেতাম।

চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার প্রিয় শিক্ষক এবং সহপাঠী ছিলেন কারা? তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

সফিউদ্দিন আহমেদ : আমি যখন চাঁদপুর কলেজে পড়ি তখন অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম উদ্দীন আহমেদ। শিক্ষক হিসেবে অনেকেই ছিলেন। সবার কথাতো মনে নেই। তবে খতিব হাবীবুর রহমান, আঃ ছাত্তার, ড. হাফিজ উল্যাহ খান, এস.এন. রায়, সত্যেন ভৌমিক, আবু সাইদ স্যারের কথা মনে আছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আঃ ছাত্তার স্যার। খুবই যত্ন সহকারে ক্লাসে পড়াতেন। আমাকে খুবই ভালোবাসতেন স্যার। স্যার বাংলার শিক্ষক ছিলেন।

আমরা যারা একসাথে পড়তাম তাদের সবার কথাতো মনে নেই। যাদের নাম মনে আছে তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, ফজলুর রহমান, সাংবাদিক শংকর, কামাল হোসেন মজুমদার, ঝন্টু প্রমুখ। তখনকার শিক্ষকরা ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র। তারা খুবই মনোযোগ সহকারে পড়াতেন। স্যারেরা ক্লাসে পড়ালে আর বাড়িতে গিয়ে পড়তে হতো না। এতো ভালো পড়াতেন তারা!

চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ৭৫ বছরপূর্তিতে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

সফিউদ্দিন আহমেদ : চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি ও মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হবে। সত্যি অনেক ভালো লাগছে। সবাই একত্র হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কলেজের ইতিহাস ঐতিহ্যকে স্মরণ করছে, যা অত্যন্ত আনন্দের। এ কলেজের শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেয়, দেশের কল্যাণে সবসময় কাজ করে এই কামনা করি।

চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা/স্বপ্ন কী?

সফিউদ্দিন আহমেদ : কলেজটি একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুনাম বয়ে আনবে-এই প্রত্যাশা করছি। পাশাপাশি পড়ালেখার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সারা বাংলাদেশ থেকে এ কলেজে যেনো শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে আসে এই প্রত্যাশা করি। আমার কলেজ জীবনের সকল স্মৃতি লিখতে গেলে একটা মহাকাব্য রচনা করা যাবে। তাই আজ এই পর্যন্ত থাকুক। আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি ও মিলনমেলা অনুষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি।

চাঁদপুর কণ্ঠ : উল্লেখিত প্রশ্নের বাইরে আপনার কোনো কথা থাকলে বলুন।

সফিউদ্দিন আহমেদ : স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার ছিলো চাঁদপুর কলেজ। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে আমরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর শুক্রবার চাঁদপুর স্টেডিয়ামে হেলিপ্যাড উদ্বোধনের জন্য মোনায়েম খাঁ চাঁদপুর আসবে এ সংবাদ শোনার পর আমরা শপথ নিলাম মোনায়েম খাঁ-কে কোনোমতেই চাঁদপুরের মাটিতে নামতে দেয়া যাবে না। আমরা চাঁদা তুলে ১১ টাকা পর্যন্ত উঠালাম। ৯ টাকা দিয়ে হোসেন ক্লথ স্টোর থেকে ২টা কালো কাপড় কিনলাম। ৫০ পয়সা করে ১ টাকা দিয়ে ২টা বাঁশ কিনলাম। বাকি এক টাকা দিয়ে পিন কিনলাম। কালো কাপড় ছোট ছোট করে কেটে বাঁশের মধ্যে বেঁধে, কালো ব্যাজ ধারণ করে কালো পতাকা হাতে নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করি। মোনায়েম খাঁ-কে হেলিপেডে নামতে দেয়া হয়নি। সেখান থেকেই পুলিশের সাথে আমাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। কলেজের ৩৪ জন ছাত্র ও ২১ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং ২জন তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে। কলেজের সামনে রাস্তার অপর পাশে আকবরী হোটেলের ছাদে ও রাস্তার সামনে আমরা ইটের স্তূপ গড়ে তুললাম। ছাদ থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মারতে থাকি। ওইদিনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৪ সালে কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন করিমউদ্দিন স্যারের নেতৃত্বে অন্যান্য শিক্ষকসহ ছাত্র-শিক্ষক একত্র হয়ে চাঁদপুর শহরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে মশাল মিছিল করেছি। এতে করে জনগণের মাঝে শান্তি ফিরে আসে।

জীবনে অনেক কষ্ট করেছি আমি। যেখানে অন্যায় দেখেছি সেখানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করে জীবন পার করেছি। আমাদের সাথেরই অনেক ছাত্রের ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, কিন্তু আমার একটাই ইচ্ছা ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। প্রতিবাদ করতে গিয়ে একাধিকবার আমাকে ও জীবন কানাইকে জেলে যেতে হয়েছে।

আমার আপন বড় ভাই সবসময় আমার প্রতিকূলে ছিলেন। আমাকে বাসায় খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে সরকার তাঁকে বাধ্য করে। তবে আমার প্রতিটি বিপদের সময় আমার ভাই-ই আমাকে ছাড়িয়ে এনেছে। একবারতো বাসা থেকেই বের হয়ে গেছি। তখন খুবই কষ্টে ছিলাম। ছয় আনা হলে পান্তাভাত খেতাম আবার দশ আনা হলে গরম ভাত খেতাম। ওইসময় কৃষ্টক্যাফের ধীরা আমাদেরকে রুটি ও বিনা পয়সার মিষ্টির শিরা দিতো। পুরো কলেজটা তখন আমরাই নিয়ন্ত্রণ করতাম। লতিফ মাওলানাকে জিএস এবং অ্যাডঃ মাহাবুব-কে ভিপি পর্যন্ত বানিয়েছি। আমি, লতিফ ও মাহাবুবের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব ছিলো। অনেকেই আমাদেরকে ত্রিরত্ন বলে ডাকতো। কলেজের সকল প্রোগ্রাম আমাদের দিয়েই বাস্তবায়িত হতো। সবসময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই সহযোগিতা করেছি। একাধিকবার আমাকে মুক্তিযুদ্ধের সনদ নেয়ার কথা বললেও আমি নিইনি। অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও আজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করে। মূলত এই কারণেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ করিনি। আমি এখনো চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি, জেলা প্রশাসক সভাপতি ও কমান্ডার এম.এ. ওয়াদুদ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছি। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। তখনকার সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বরণের পর চাঁদপুর থেকে একমাত্র আমাকেই গ্রেফতার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকাদেশ দেয়। তখন আমার বড় ভাই আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। তখনকার আইজিপি শাহরাস্তির সন্তান হোসেন আহমেদ আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য খুবই সহযোগিতা করেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়