প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
কবিতায় হেমন্ত আসুক বারবার
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। মিষ্টি রোদের আদর। জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাত। পাতাঝরা বৃক্ষের নৃত্য। এসব ‘ঋতুকন্যা’ হেমন্তের বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঋতুকে আমি বলি যৌবনের কাল। যেন সৃষ্টির সুখের উল্লাস। তাই তো যুগ যুগ ধরে কবিগণ হেমন্তকে তুলে এনেছেন কবিতায়। বৈষ্ণব পদকর্তা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা প্রমুখ কবিদের কবিতায় হেমন্ত এসেছে ভালোবাসার আবেশে।
প্রকৃতির নিয়মেই হেমন্ত নিয়ে আসে হিম হিম মৃদু কুয়াশা। চারিদিকে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ। সাথে শীতের আগমনী বার্তা। কৃষিনির্ভর জনজীবনে হেমন্ত সৃষ্টির আনন্দ-উল্লাসের কবিতার মতো। অভাব-অনটন শেষে সমৃদ্ধির সোনালি উদ্ভাস। আবহমানকাল থেকেই হেমন্ত মানেই কৃষকের মুখে অনাবিল হাসি। ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে পরিতৃপ্তির ব্যস্ততা। চলতে থাকে নবান্নের পিঠা-পায়েসের আয়োজন। সেসব উৎসবে ধ্বনিত হয় কবির আত্মোপলব্ধি।
হেমন্ত নিয়ে এদেশের অসংখ্য কবি সমসাময়িক কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কবিগণ এ প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ মধুর কাব্যিক উপমায় তুলে ধরেছেন। হেমন্ত লক্ষ্মী এ সময় পৃথিবীতে তার প্রসন্ন দৃষ্টির মায়ায় কৃষকের গোলা ভরে দেয় শান্তির পরশে। তাই তো সব কালের প্রায় সব কবিরই রচনায় কোন না কোনভাবে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ এসেছে। উপমা, রূপক, উৎপেক্ষা ও অলংকারে হেমন্ত ঋতু অনবদ্য ও নান্দনিকতায় বাংলা কাব্য সম্ভারে অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
বাংলার কবিরাও হেমন্তকে দেখেছেন ফসল তোলার ঋতু হিসেবে। তাই হেমন্ত হয়ে উঠেছে কবিদের ধ্যানস্থ হওয়ার সময়। যে সময়ে অনেকটা চুপিসারে, নিঃশব্দে কবির মনে, হৃদয়ে, মগজে কবিতার ছায়া এসে উপস্থিত হয়। সৃজনশীল কবি হৃদয়ে হেমন্তের উদাসীন প্রকৃতি স্নিগ্ধ মধুর কাব্যিক উপমায় মমতাময়ী নারীর সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতায় উপস্থাপিত হয়। এ পর্যন্ত যে কয়টি কবিতা রচিত হয়েছে, সে কয়টি চিত্রকল্পে-উপমায়-বিষয়ে অনন্য।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সহজিয়াগণের ‘চর্যাপদে’ বিশেষ কোনো ঋতুর উপস্থিতি নেই বলা যায়। শুধু কাউন বা চিনা পাকার মাস অর্থাৎ শীতকালের উল্লেখ রয়েছে। তবে মধ্যযুগের কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের সামান্য নমুনা পাওয়া যায়। কবি বলেন-
‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ
যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’।
কার্তিক মাসে হেমন্ত শুরু হলেও শীতের আগমনী বার্তা শোনা যায়। সবাই শীতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কবি হয়তো এ কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন।
বৈষ্ণব পদাবলীর পদকর্তা লোচনদাসের পদেও হেমন্তের আগমন লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন-
‘অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।
সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে।।’
হেমন্তের নতুন ধানে ঘরে ঘরে সুখ বিরাজ করে। ফলে এসময় সন্ন্যাস নিয়ে কী লাভ হবে?
এছাড়া বৈষ্ণব পদকর্তাগণের মধ্যে গোবিন্দদাসও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার পদে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। কবি বলেন-
‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র
নায়র মাথুরা গেল।
পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ
বৃন্দাবন বন ভেল।।’
এ সময় কূলবধূরা নায়রে যায়। হেমেন্ত রাস উৎসবের আয়োজন করা হয়। চারদিকে খুশির ঝিলিক দেখা যায়।
আধুনিক যুগে এসে বাংলা সাহিত্য বিভিন্ন শাখা বিস্তার করলেও কবিতা আগের মতোই সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। ঋতুচক্রের এ আবাহন আধুনিক কবিগণকেও নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্ত ঋতু নিয়ে অজ¯্র কবিতা লিখেছেন। কবিগুরু বলেন-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনও পিছিয়ে নেই এই যাত্রায়। তার পদবীর সঙ্গেই মিশে আছে গ্রামীণ জনজীবনের রং, রূপ ও রস। তার কবিতায়ও হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে-
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
কবিগুরু এবং পল্লীকবির মতোই হেমন্তের এসব বৈশিষ্ট্য নাড়া দিয়েছে প্রকৃতির কবি, নিসর্গের কবি, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশকে। আমার মনে হয়, অন্য কোনো কবির কাব্যে হেমন্ত এলেও জীবনানন্দের মতো কেউ আবেগতাড়িত করতে পারেনি আমাদের। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতায় হেমন্ত এলেও তার কবিতায় হেমন্তের প্রসঙ্গ এসেছে ভিন্ন আবহে এবং আদলে। কারণ হেমন্ত আপামর খেটে খাওয়া মানুষের সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতি ও আবেগকে কাব্যিক স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি ষোলোআনা হেমন্তপ্রেমী কবি। তার কবিতায় হেমন্ত, প্রকৃতি আর আত্মমগ্ন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্ত প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি নরেশ গুহ লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য-পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত।... হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কীটস-এরও প্রাণ ভুলিয়েছিলো। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন জন্মান্তর ঘটছে, হেমন্ত তখনো তাঁর উপকরণ হয়ে ছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন। হেমন্ত প্রথমত শস্যের, তৃপ্তির, বিরতির ঋতু।’
শস্যভরা ঋতুকে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছেন জীবনানন্দ দাশ। আজকের আলোচনায় সঙ্গত কারণেই জীবনানন্দকে একটু বেশি তুলে ধরতে চাই। কারণ কবি হেমন্তকে দেখেছেন প্রেমে-কামে, দেহে-দেহহীনতায়, সৃষ্টিতে, তৃপ্তিতে, বিরহে, বিরতিতে। ‘পিপাসার গান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘এদেহ অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড়ো পাখপাখালির পালে
উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ
অঘ্রাণের মাঝরাতে।’
কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী। ঋতুকন্যা হৈমন্তীর প্রেমে হাবুডুবু খায় পুরো প্রকৃতি। কবির চোখে তাই হেমন্ত কী অসাধারণ-
‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!’
হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কবির প্রাণ ভরিয়েছিল। শিশির-কুয়াশা মিশ্রিত হেমন্ত ঋতু তাকে আকৃষ্ট করত। এই ক্ষণস্থায়ী ঋতুকে জীবনানন্দ নতুন করে অবলোকন করেছিলেন। কবি হৃদয়ের গোপন ভালোবাসার আর্তি এই হেমন্ত ঋতু। তাই কেবল জীবনানন্দের কাব্যেই হেমন্ত পেয়েছে শীর্ষস্থান। তার প্রতিটি কবিতায় রূপায়িত হয়েছে হেমন্তের অপরূপ বৈশিষ্ট্য- শিশিরের শব্দ, শিশিরের জল, শিশিরের ঘ্রাণ, ধূসর কুয়াশা, মেটে জোছনা, মাঠ পাড়ের গল্প, বিষণœতার ঋতু। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়-
‘অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু।’
হেমন্ত বিষণœতার ঋতু, তারপরও হেমন্ত ধরিত্রীর অন্তরঙ্গ সহচরী। হেমন্ত ভরে তোলে গৃহভা-ার।
কবির চোখে হেমন্ত শস্যের ঋতু, তৃপ্তির ঋতু। কবির ভাষায়-
‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে
দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।’
এমনকি জীবনানন্দ ছাড়া আর কে উচ্চারণ করতে পারেন এমন কথা? যখন তিনি বলেন-
‘যখন ঝরিয়া-যাবো হেমন্তের ঝড়ে
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?’
এমন কথা যেন জীবনানন্দকেই মানায়। ব্যক্তিজীবনে মোহহীন এক মানুষ বিষণœতা, রিক্ততা ছাড়া আর কী-ই বা পেয়েছেন।
বাংলা কবিতার বিপুল ভা-ার থেকে তুলে আনা পঙ্ক্তিমালা পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, হেমন্তকে কবিতার ঋতু করে তুলেছেন একান্তভাবে জীবনানন্দ। তার কবিতায় ‘ধান কাটা’, ‘নবান্ন’, ‘ইঁদুর’, ‘শালিক’, ‘লক্ষ্মীপেঁচা’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ প্রভৃতি শব্দ ও শব্দবন্ধ হেমন্তের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরে যে, জীবনানন্দ পাঠ করলে যেন পুরো হেমন্তের চিত্রই ফুটে ওঠে। সেখানে দেখতে পাই- হেমন্তে বাংলার ঘরে ঘরে আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আশ্বিনের শেষদিন রান্না করা ভাত রাতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয় কার্তিকের প্রথম দিন খাওয়ার জন্য। এটা গ্রামবাংলার এক ধরনের সংস্কৃতি। একটি প্রবাদ আছে, ‘আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খায়, যেই বর মাঙ্গে সেই বর পায়।’ এই চিরাচরিত নিয়মের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হয় হেমন্তকে। কবি স্বাগত জানান তার কাব্যসম্ভার সহযোগে।
শরতের মন্দমধুর হাওয়া, কাশের গুচ্ছ, সাদা জোছনার পালে ভাসতে ভাসতে আসে হেমন্ত। তবে অনেকেই হেমন্তকে রিক্ততার ঋতু বলে থাকেন। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস ঋতুকন্যার দুঃখঝরা দিন। কারণ হেমন্তের শুরু কার্তিক মাস ফসল তোলার পূর্ব মাস। যার কারণে কৃষকের ঘরে খানিকটা অভাব থাকে বৈকি? আর তাই এই কার্তিককে ‘মঙ্গার মাস’ বলেও অনেকে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু কার্তিকের শেষক্ষণে হরিৎ শস্যক্ষেত্র ধীরে ধীরে হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করে। চাষির চোখের স্বপ্ন একেকটি ধানের গোছা পাকা ধানের ভারে যেন নুয়ে পড়ে। তখন প্রকৃতির শোভা অপরূপ সুন্দর দেখায়। কবি বলেন- ‘হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে:
কোথাও বা সৃষ্টির অন্ধকার রহস্যের সঙ্গে বিজড়িত করেছেন তাকে :
আজকে মানুষ আমি তবুও তো-সৃষ্টির হৃদয়ে
হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল।’
অগ্রহায়ণের প্রথম দিন থেকে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়। গ্রামের ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ। নতুন ধানের গন্ধে অন্যরকম আবহাওয়া বইতে থাকে। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নবান্ন আর পিঠেপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই।
ঋতুকন্যা হেমন্তে গ্রীষ্ম ও শরতের প্রকৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কঠিন সূর্য বনভূমি ও জলাধারে তাপ বিকিরণ প্রত্যাহার করে নেয়। মধুর বাতাস ও সবুজ বনানী ক্রমেই ভিন্ন রূপ ধারণ করে। যৌবনের জলতরঙ্গ নৃত্যময় হয়ে ওঠে হেমন্ত সমীরণে। হেমন্ত আসে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। প্রকৃতি ঝরাপাতার গান শোনাতে থাকে। ফসলের মৃত্যু ঘোষিত হলেও প্রকৃতির গালিচায় বাদামি, লাল, সোনালি পাতার রাশি। ঝরাপাতার শব্দ ও হেমন্তের রং প্রাণিত করে কবিদের। শুষ্ক কঠিন প্রকৃতির পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি নিয়ে নিঃশব্দ চরণে হেমন্তের যেমন আগমন ঘটে তেমনি বাঙালির ঘরে ঘরে সোনার ফসল দান করে রিক্ততার মধ্য দিয়ে শিশিরের মত নিঃশব্দ চরণে বিদায়ও গ্রহণ করে এই ঋতু। জীবনানন্দের ভাষায়-
‘আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই-নুয়ে আছে নদীর এ পাড়ে
বিয়োবার দেরী নাই-রূপ ঝড়ে পড়ে তার
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে।’
হেমন্তের পরিণতি শীতের আগমনী গান। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বাংলার আরেক ঋতু শীতের দরজা খুলে দিয়ে আসে হেমন্তের বিদায়ের পালা। আর হেমন্তের দুঃখঝরা দিনে কেবলি মনে পড়ে জীবনানন্দকে। জীবনানন্দ হয়তো গভীরভাবে অবলোকন করেছেন হেমন্তকে। কবিমন যেহেতু সংবেদনশীল; সেহেতু অপরাপর কবিদেরও আগ্রহের কারণ হয়েছে হেমন্ত।
গ্রামবাংলার অনবদ্য রূপ বিমুগ্ধ করেছে কবি সুফিয়া কামালকে। তাই তো গ্রামীণ প্রকৃতির সহজ-সরল ও স্বাভাবিক রূপ তার কাব্যেও উপজীব্য হয়ে উঠেছে। গভীর মমতায় ও ভালোবাসায় প্রকৃতি তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে-
‘হেমন্তের কবি আমি, হিমাচ্ছন্ন ধূসর সন্ধ্যায়
গৈরিক উত্তরীয় টানি মিশাইয়া রহি কুয়াশায়।’
আবার কখনো তিনি হেমন্তকে চিঠি লিখেছেন। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে আবির্ভূত হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন-
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
প্রায় সবার কবিতাতেই হেমন্তের পাতা ঝরার গান শুনতে পাওয়া যায়। প্রকৃতির অপার বিস্ময় ধরা পড়ে তাতে। তাই তো সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আমরা হেমন্তকে দেখতে পাই এভাবে-
‘ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্ত লোহিত
তরুণ তরুণী শূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ, নিশাক্রান্ত বিষণœ বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর অকস্মাৎ করেছে মোহিত।।’
গ্রামবাংলার জীবন ও শ্যামল রূপ আল মাহমুদের কবিতায় ফুটে ওঠে। তবে তার প্রকৃতি কখনো কখনো দেহজ কামনা-বাসনায় অপূর্ব নারীমূর্তি রূপে আকর্ষণ করে। তার কাব্যে প্রেম, প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও নারী অভিন্ন সত্তায় একাকার হয়ে আছে। কবি বলেন-
‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে
আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে
রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে
আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর
বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো
কট ও কষায়।’
একই পথে হেঁটেছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি গ্রামীণ প্রকৃতির চিরাচরিত স্বাভাবিক রূপ উন্মোচিত করেছেন হেমন্তের কবিতায়-
‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক।
তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন
কতকালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে
তাই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি
আমি দেখেছি কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে
বকের মতো নিভৃত মাছ।’
কবি মহাদেব সাহা হেমন্ত নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় এসেছে জীবনানন্দের কথাও। এতে মনে হয়, জীবনানন্দ যেন হেমন্তের পরিপূরক। তিনি বলেন-
‘আজো আমি মনে প্রাণে শিশিরের কাছে সমর্পিত
সেই শেফালিকা ফুল, সেই গন্ধ, ভোরের কুয়াশা,
কাল পাই জীবনানন্দের হেমন্তের চিঠি
এই যে হলুদ পাতা, এই যে বিষণœ পা-ুলিপি।’
কবি মহাদেব সাহার মতোই সমসাময়িক কবিতায়ও হেমন্তের দেখা মেলে। ঋতুবৈচিত্র্যের আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে আগের মতো নিয়মমাফিক ধারা অব্যাহত না থাকলে সমকালীন কবিতায় হেমন্ত আসে আগের মতোই। কবি মোহাম্মদ নূরুল হক তার কবিতায় বলেন-
‘যখন লেগেছে মাঠে কামরাঙা বিকেলের হাওয়ার পরশ-
বয়স্ক নদীরা কেন তবে ফিরে পেতে চায় হারানো যৌবন?
এমন প্রশ্নের ভয়ে চুপচাপ শুয়ে-শুয়ে দেখি
মগজে জেগেছে চাঁদ-হেমন্তের সোনামুখী কামুক সন্ধ্যায়!’
সাধারণ দৃষ্টিতে হেমন্তকে শীতের মতোই মনে হলেও কবিদের চোখে তা ধরা পড়ে অন্য মহিমায়। সামগ্রিক আলোচনায় যা মনে হয়, তাতে জীবনানন্দকে অগ্রগামী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ তাঁর কবিতায় যতবার হেমন্তের প্রসঙ্গ এসেছে, তাতে এ যাবতকালের সবার কবিতায়ও এতোবার হেমন্তের প্রসঙ্গ আসেনি। সে হিসেব না হয় তোলা রইল। যেহেতু কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে হেমন্ত বিরাজ করবে। সেহেতু কবিদের কবিতায় ভেসে উঠবে তার প্রতিচ্ছবি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু বিপর্যয়েও হেমন্ত টিকে থাকবে কবিতার চরণে চরণে। হেমন্ত বয়ে আনুক শীতের বার্তা। বয়ে আনুক শীতের আগমনী গান। কবিরা বাঁচুক হেমন্তের অপার সৌন্দর্য হৃদয়ে মেখে। কবিতায় হেমন্ত আসুক বারবার।