প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ১৯:৩৯
জিয়ার ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী: স্মৃতির মিনার থেকে সংগ্রামের শপথ!

|আরো খবর
শহীদ জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির ৮ দিনের কর্মসূচি: স্মৃতি, শ্রদ্ধা ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতা
"রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, বরং তিনি ছিলেন স্বাধীনতার এক জীবন্ত ইতিহাস, একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।" – এই মূল্যায়ন কেবল কিছু শব্দের সমষ্টি নয়, এটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র প্রতিটি আয়োজন ও কর্মসূচির গভীরে প্রোথিত এক অমোঘ সত্য। জিয়ার ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আট দিনের কর্মসূচি নিছকই শোক পালনের আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে, যা দেশের ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা পুরুষের অবদান, দেশপ্রেম এবং জনমুখী দর্শনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের এক নিরন্তর বহিঃপ্রকাশ। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি কেবল তার প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছে না, বরং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার প্রাসঙ্গিকতা, তার আদর্শের অবিরাম প্রয়োজনীয়তা এবং তার দর্শনের পুনরুত্থানকে তুলে ধরছে। এ যেন এক ঐতিহাসিক স্মৃতির পুনরুজ্জীবন, যা জাতিকে আবারও জিয়ার স্বপ্নের সোনালী দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
এক বিভীষিকাময় প্রয়াণ ও এক অপূরণীয় ক্ষতি: সময়ের সাক্ষী এক ৩০শে মে
১৯৮১ সালের ৩০ মে, এক বিভীষিকাময় ভোরে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে একদল বিপদগামী সেনা সদস্যের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার অকালপ্রয়াণ কেবল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র জন্য নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি, যা আজও দেশের ইতিহাস ও মানুষের মনে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। যে ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতির দিশারী হয়েছিলেন, যিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিচল ছিলেন, যিনি জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তার আকস্মিক চলে যাওয়া যেন জাতিকে এক ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল। এই প্রয়াণ শুধু একজন রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যু ছিল না, ছিল একটি স্বপ্ন, একটি সম্ভাবনা এবং একটি জাতির অগ্রযাত্রার আকস্মিক থমকে যাওয়া। প্রতি বছর এই দিনটি 'শাহাদাৎ দিবস' হিসেবে পালন করে বিএনপি, যা কেবল একটি তারিখের স্মৃতিচারণ নয়, বরং শহীদ জিয়ার প্রতি দেশের আপামর জনসাধারণের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রতিচ্ছবি। এই দিনটি জিয়ার বহুমাত্রিক অবদানকে স্মরণ করার এবং তার আদর্শকে নতুন করে ধারণ করার এক অনন্য সুযোগ।
চলতি বছর ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেছে সময়সীমা—ঈদুল আজহার আগমনী ব্যস্ততার মধ্যেও দলটি আট দিনের নিবিড় কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে কর্মসূচির গভীরতা, বিস্তৃতি এবং এর অন্তর্নিহিত বার্তা আগের মতোই বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। এটি প্রমাণ করে, সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকলেও, জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তার আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারে কোনো কমতি নেই। বরং, এই সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি যেন জিয়ার জীবন্ত উপস্থিতি এবং তার দর্শনের অবিরাম প্রাসঙ্গিকতাকে আরও বেশি করে তুলে ধরে। এটি যেন এক নিবেদন, এক অঙ্গীকার, জিয়ার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের।
ঘোষণার ভাষ্যে ইতিহাস ও উপলব্ধি: ভার্চুয়াল উপস্থিতি, বাস্তব সংকল্প
২০ মে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত যৌথ সভায় ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার শারীরিক অনুপস্থিতিতেও দলীয় কার্যক্রমে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করে দলীয় ঐক্য, সংহতি এবং জিয়ার আদর্শের প্রতি তাদের অবিচল অঙ্গীকার। এই সভায় দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত আট দিনের বিস্তারিত কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তার কণ্ঠস্বরে ছিল জিয়ার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক সুদূরপ্রসারী উপলব্ধি।
“চলতি বছর ঈদুল আজহা ৭ জুন। তাই আমাদের কর্মসূচি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে আট দিনে সীমাবদ্ধ করেছি। কিন্তু মূল চেতনা, শ্রদ্ধা এবং জনসম্পৃক্ততা বজায় রেখেছি।”
তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কর্মসূচির সময়সীমা সংক্ষিপ্ত হলেও, তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অটুট রয়েছে। বিএনপি চায়, এই কর্মসূচির মাধ্যমে জিয়ার আদর্শকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে এবং তার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে। এটি কেবল একটি বার্ষিকী পালন নয়, এটি একটি আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, একটি জাতির পুনর্গঠনের স্বপ্ন। এই কর্মসূচি জিয়ার সেই সকল নীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, যা দেশকে স্বাবলম্বী করতে এবং মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
বিস্তারিত কর্মসূচির পর্যালোচনা: স্মৃতি, শ্রদ্ধা ও জনসম্পৃক্ততার এক নিবিড় মেলবন্ধন
বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি দলের আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি জনগণের ভালোবাসার এক শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি কর্মসূচিতেই শহীদ জিয়ার কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক এবং তার জনকল্যাণমূলক দর্শনের গভীর প্রতিফলন দেখা যায়। এই কর্মসূচিগুলো যেন এক নিবিড় চিত্র, যা জিয়ার বহুমাত্রিক সত্তাকে উন্মোচন করে।
- ২৫-২৬ মে: কালো পতাকা উত্তোলন ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ: কর্মসূচির প্রথম দুই দিনে কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। এটি স্মৃতির প্রথম ধাপ, যা শোকের আবহে জিয়ার প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত করবে। কালো পতাকা শোক ও বেদনার প্রতীক, যা জিয়ার শাহাদাৎকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং জাতির এক গভীর ক্ষতকে পুনরায় জাগিয়ে তোলে। দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে দল তার প্রতিষ্ঠাতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবে, যা দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীর মনে জিয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। এটি কেবল প্রতীকী অর্থে নয়, বরং জিয়ার প্রতি এক মননশীল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
- ২৭-২৮ মে: 'তারুণ্যের সমাবেশ': এই দুই দিনে যুব ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে 'তারুণ্যের সমাবেশ' অনুষ্ঠিত হবে। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো নতুন প্রজন্মকে জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন করা। জিয়াউর রহমান তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি জানতেন, যুবসমাজই দেশের ভবিষ্যৎ এবং তাদের সঠিক পথে চালিত করতে পারলেই দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। এই সমাবেশগুলো যুবসমাজকে জিয়ার স্বপ্ন, তার অর্থনৈতিক দর্শন এবং দেশ গঠনের তারুণ্যদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত করিয়ে দেবে। এটি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, জনসেবার উদ্দীপনা এবং একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলবে। তারুণ্যই দেশের ভবিষ্যৎ, আর জিয়ার আদর্শ তাদের সঠিক পথে চালিত করতে পারে—এই বার্তা দেওয়া হবে সমাবেশগুলো থেকে, যা কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং এক ভবিষ্যৎমুখী দিকনির্দেশনা।
- ২৯ মে: আলোচনা সভা: ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সমাজচিন্তকরা এই সভায় জিয়াউর রহমানের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করবেন। জিয়ার প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক সংস্কার, এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করা হবে। এটি কেবল একটি আলোচনা সভা নয়, বরং একটি জ্ঞানগর্ভ সেমিনার, যেখানে জিয়ার কর্মময় জীবনের বিভিন্ন অজানা দিক উন্মোচন করা হবে। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব, তার স্বপ্ন এবং তার নীতিগুলো কিভাবে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হবে। এই আলোচনা সভাগুলো জিয়ার আদর্শিক ভিত্তি এবং তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সহায়ক হবে।
- ৩০ মে: শহীদ রাষ্ট্রপতির কবরে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ ও দেশব্যাপী মসজিদে দোয়ার আয়োজন: শাহাদাৎ দিবসের মূল কর্মসূচি এটি। এই দিনে শহীদ রাষ্ট্রপতির কবরে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, বরং এক সম্মিলিত ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। একই সাথে দেশব্যাপী মসজিদে দোয়ার আয়োজন করা হবে। সারাদেশ একযোগে স্মরণে নত হবে, জিয়ার আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত করা হবে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে জিয়ার প্রতি জাতির অকৃত্তিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পাবে, যা তার শাহাদাৎকে এক মহিমান্বিত ত্যাগে রূপান্তরিত করে। এটি যেন এক আধ্যাত্মিক সংযোগ, যা জিয়ার আত্মাকে শান্তি প্রদান করবে এবং তার স্বপ্নকে আরও শক্তিশালী করবে।
- ২৫ মে – ২ জুন: দুঃস্থদের মাঝে চাল, ডাল, খাদ্যসামগ্রী ও বস্ত্র বিতরণ: এই আট দিনব্যাপী দুঃস্থদের মাঝে চাল, ডাল, খাদ্যসামগ্রী ও বস্ত্র বিতরণ করা হবে। এটি শুধু একটি মানবিক কর্মসূচি নয়—বরং শহীদ রাষ্ট্রপতির জনকল্যাণমূলক দর্শনের এক প্রকৃষ্ট প্রতিফলন। জিয়াউর রহমান সবসময় দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তার 'গ্রাম সরকার' ও 'খাল কাটা' কর্মসূচি ছিল জনকল্যাণমূলক কাজের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যা সরাসরি তৃণমূলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিল। এই মানবিক কর্মসূচি জিয়ার জনমুখী নীতি ও সমাজসেবার প্রতি বিএনপির অবিচল অঙ্গীকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। এটি প্রমাণ করে, বিএনপি কেবল ক্ষমতার রাজনীতি করে না, বরং মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণেও সমানভাবে আগ্রহী। এই কর্মসূচিগুলো সমাজের অসহায় মানুষের প্রতি এক গভীর সমবেদনা এবং জিয়ার মানবিক দর্শনের বাস্তব রূপায়ণ।
- সারাদেশে: জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্মরণসভা, দোয়া ও মিলাদ: কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি সারাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্মরণসভা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। এটি শহীদ জিয়ার অবদান স্মরণে এক ধরনের একাত্মতার সংস্কৃতি গড়ে তুলছে বিএনপি। এই স্থানীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে জিয়ার আদর্শের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করবে। এটি দলের সাংগঠনিক শক্তিকে বৃদ্ধি করবে এবং জিয়ার আদর্শকে দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেবে। এসব আয়োজন কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জিয়ার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যা দলের ভিত্তি আরও মজবুত করবে।
প্রচার ও জনসম্পৃক্ততা: তথ্যপ্রযুক্তির যুগে জিয়ার আদর্শের পুনরুত্থান
জিয়াউর রহমানের জীবন ও আদর্শকে তুলে ধরে পোস্টার প্রকাশ এবং জাতীয় পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এই উদ্যোগ জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস সচেতন করতে এবং জিয়ার অবদান সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল প্রচারণার গুরুত্ব অপরিসীম।
“তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পোস্টার, ক্রোড়পত্র এবং ডিজিটাল প্রচারণার সমন্বয়ই রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে।”
তার এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, বিএনপি প্রচলিত প্রচারণার পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকেও সমানভাবে কাজে লাগাতে আগ্রহী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে জিয়ার আদর্শ ও অবদানকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি কেবল দলের প্রচারণা নয়, বরং নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার এবং জাতির প্রকৃত স্থপতিদের অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। ডিজিটাল প্রচারণা জিয়ার আদর্শকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে, পৌঁছে দেবে, যারা হয়তো তার সম্পর্কে ততটা অবগত নন। এটি জিয়ার স্মৃতিকে কেবল পুরনো প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, নতুন প্রজন্মের মধ্যেও সঞ্চারিত করবে।
ঐতিহাসিক পুনর্নির্মাণ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: সংকটকালে জিয়ার আগমন ও জাতীয় পুনর্গঠন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনীতিতে চরম অনিশ্চয়তা, বিশৃঙ্খলা এবং এক গভীর সংকট বিরাজ করছিল। ক্ষমতার শূন্যতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। সেই সংকটকালে জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের কেন্দ্রে আসেন। তার নেতৃত্ব দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনে এবং জাতির মধ্যে নতুন করে আশা ও উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। তিনি ছিলেন সেই সময়ের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দেশকে এক ঘোর অমানিশা থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন।
১৯৭৮ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার নাম দেন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’। এই দল গঠন ছিল সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক শাসনে উত্তরণের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তার সময়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে, যা নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয় এবং একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। তার নেতৃত্বে শুরু হয় শিল্পোন্নয়ন ও বৈদেশিক কূটনৈতিক উদারীকরণ। তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেন। তার 'উপজেলা' ধারণা এবং 'গ্রাম সরকার' প্রবর্তন ছিল দেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
“শহীদ জিয়া ছিলেন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্থপতি। তার প্রশাসনিক দক্ষতা, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ও সংস্কারমুখী নীতিমালা আজও অনুকরণীয়।”
জিয়ার প্রশাসন ছিল অত্যন্ত দক্ষ ও সুসংগঠিত। তিনি দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থান দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং জনগণের মধ্যে এক নতুন আশার সঞ্চার করে। এসব কারণে তার শাসনামলকে দেশের উন্নয়নের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা আজও অনেক রাজনৈতিক নেতার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। জিয়া কেবল একজন সৈনিক ছিলেন না, ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, যিনি দেশকে এক নতুন পরিচয় দিয়েছিলেন।
কর্মসূচির তাৎপর্য ও গণসম্পৃক্ততা: একটি রাজনৈতিক বার্তা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
এই কর্মসূচি কেবল শোক ও স্মৃতিচারণ নয়, বরং তা এক শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা বহন করে—জনগণের প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছে শহীদ জিয়া। দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো, আদর্শিক স্মরণসভা আয়োজন ও তথ্যবহুল প্রচারণা একত্রে বিএনপির সামাজিক দায়বদ্ধতার এক সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এই কর্মসূচিগুলো প্রমাণ করে যে, বিএনপি কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং এটি একটি সামাজিক আন্দোলনও, যা মানুষের কল্যাণে নিবেদিত।
বিভিন্ন সামাজিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ‘মেমোরি পলিটিক্স’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের স্মরণ ও তাদের অবদানকে নতুন করে তুলে ধরা রাজনৈতিক দলের জন্য খুবই জরুরি, যা তাদের আদর্শিক ভিত্তিকে মজবুত করে। সেদিক থেকে শহীদ জিয়াকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই আয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় স্তরেই গভীর গুরুত্ব বহন করছে। এই কর্মসূচিগুলো দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে জিয়ার আদর্শের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার খর্ব হচ্ছে, তখন জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্রের আদর্শ এবং তার জনমুখী নীতিগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই কর্মসূচিগুলো জিয়ার সেই আদর্শকে আবারও জনগণের সামনে তুলে ধরবে, যা তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেতে সাহায্য করবে।
ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট: এক আদর্শিক শক্তি, এক অবিরাম সংগ্রাম
৪৪ বছর পরেও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু স্মৃতির বিষয় নন—তিনি একটি আদর্শিক শক্তি, যা বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তিকে প্রাণবন্ত রাখে। তার আদর্শ, দেশপ্রেম এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আজও বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীর প্রেরণা এবং তাদের সংগ্রামের মূল ভিত্তি। এই কর্মসূচি দলীয় ঐক্য, আদর্শ চর্চা ও জনসম্পৃক্ততাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে, যা আগামী দিনের রাজনৈতিক লড়াইয়ের জন্য দলকে প্রস্তুত করে।
“আমরা শহীদ রাষ্ট্রপতির আদর্শেই আগামী দিনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছি।”
তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বিএনপি জিয়াউর রহমানের দেখানো পথেই অগ্রসর হতে চায়। তারা বিশ্বাস করে, জিয়ার আদর্শকে ধারণ করেই দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই কর্মসূচিগুলো বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও প্রদান করে, যা কেবল ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, বরং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে বিএনপি কেবল বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে না, বরং একটি উন্নত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নও দেখছে। এটি এক অবিরাম সংগ্রাম, যা জিয়ার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে বদ্ধপরিকর।
ইতিহাস, মানবতা ও রাজনীতির ত্রিমাত্রিক সম্মিলন – এক অবিস্মরণীয় উত্তরাধিকার
বিএনপির এই ৮ দিনের স্মরণ কর্মসূচি কেবল এক অতীত রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়—বরং এটি এক জীবন্ত রাজনৈতিক চেতনার পুনর্জাগরণ। শহীদ জিয়াকে ঘিরে বিএনপির এ আয়োজন ইতিহাস, মানবতা ও রাজনীতির ত্রিমাত্রিক সম্মিলন, যা বাংলাদেশের বুকে জিয়ার অবিস্মরণীয় উত্তরাধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এই কর্মসূচি প্রমাণ করে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যার অবদান আজও দেশের রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তার শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির এই কর্মসূচিগুলো কেবল একটি শোক পালন নয়, বরং এটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জিয়ার আদর্শের প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ। এই আয়োজনগুলো দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এক নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে, যেখানে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জনকল্যাণই হবে মূল চালিকাশক্তি।
এই ধরনের একটি ব্যাপক এবং সুসংগঠিত কর্মসূচি কেবল একটি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি জাতীয় রাজনৈতিক চর্চায়ও একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। এটি প্রমাণ করে, শহীদ জিয়াউর রহমান এখনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য নাম, যার আদর্শ আজও লাখো মানুষের মনে প্রেরণা জোগায়। এই কর্মসূচিগুলো জিয়ার সেই অসমাপ্ত স্বপ্নকে আবারও জাগিয়ে তোলে, যেখানে একটি সুখী, সমৃদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়াই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। জিয়ার উত্তরাধিকার কেবল স্মৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক জীবন্ত শক্তি, যা দেশের প্রতিটি ধাপে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।
ডিসিকে/এমজেডএইচ