প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আজ ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বুধবার রঘুনাথপুর বাজার গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার সীমানায় অবস্থিত রঘুনাথপুর বাজারে পাক হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের অতর্কিত আক্রমণে প্রায় অর্ধশত লোক শহীদ হন। এই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে ১৯৯৬ সালে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিঞা মোঃ ওয়াহিদুল আলমকে সভাপতি এবং তারাপল্যা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল বাসারকে সাধারণ সম্পাদক করে রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়। বর্তমানে স্মৃতি সংসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল বাসার এবং সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।
আজ বাদ আসর রঘুনাথপুর বাজার জামে মসজিদে শহীদদের স্মরণে মিলাদ মাহফিল ও দোয়ার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। তারাপাল্লা গ্রামের কৃতী সন্তান শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক জাকির হোসেন প্রধানীয়ার সার্বিক সহযোগিতায় আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ বদরুন নাহার চৌধুরী কর্তৃক শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে এবং চাঁদপুর জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সভাপতি ডাঃ এম. এ. জি. ফারুক ভূঁইয়াসহ চিকিৎসকগণের নেতৃত্বে বিনা খরচে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত চলবে। সংশ্লিষ্টদের যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছেন রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল বাসার ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।
রঘুনাথপুর বাজারের অবস্থান ও প্রেক্ষাপট
মতলব, হাজীগঞ্জ ও কচুয়া এই তিন থানার সীমানায় অবস্থিত অবহেলিত জনপদ রঘুনাথপুর বাজার। মতলব উপজেলা সদর থেকে ৮ কি.মি. পূর্বে, হাজীগঞ্জ থানা সদর থেকে ৭ কি.মি. উত্তরে, কচুয়া থানা সদর থেকে ৫ কি.মি. পশ্চিমে জেলার প্রত্যন্ত নিরিবিলি স্থানে এ বাজারটির অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্ষা মৌসুমে এ বাজারে নৌপথে আসা ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিলো না। হাজীগঞ্জ, কচুয়া ও মতলব থানার লোকজন ছাড়াও বরুড়া, চান্দিনা, দাউদকান্দি, গজারিয়া থানা এলাকার লোকজনও এ বাজারটিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন নিরাপদে বেচাকেনার স্থান এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সপ্তাহে কেবলমাত্র বুধবার এ বাজারটি বসে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ বাজারে প্রতি বুধবার অনেক লোকের সমাগম হতো। মন্তা নামে এক লোক পাট ব্যবসা করতো। সে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালীন জমজমাট এ বাজারটিতে পাট ব্যবসার নামে কখনো ছদ্মবেশে এসে এই মন্তা চার সহযোগীদের দ্বারা বাজারের আশপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হয়ে হাজীগঞ্জ ক্যাম্পে গিয়ে পাকবাহিনীর সাথে আলাপ করে রাজাকার বাহিনী দ্বারা বাজারটিতে পরিকল্পিত হামলার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়।
১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বুধবার। সেদিন ছিলো রঘুনাথপুর বাজারের সাপ্তাহিক হাটবার। প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিলো এ বাজারে। ভরা বর্ষায় চতুর্দিক থেকে নৌকাযোগে ক্রেতা-বিক্রেতায় বাজারটি ছিলো পরিপূর্ণ। আনুমানিক বিকেল ৩টায় ৫০/৬০ জন রাজাকার ছইয়াওয়ালা ৬/৭টি নৌকায় করে বাজারের পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে বাজারে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধা আঃ মতিন তখন ছিলেন বাজারের দিঘির পূর্ব-উত্তর কোণে বগীরমার বাড়ি বলে পরিচিত বাড়িটির পাশের একটি নৌকাতে। তিনি রাজাকারদের আগমন টের পান এবং এলএমজি তাক করেন আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার সহযোগীরা বাজারের হাজার হাজার লোকের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় এ আক্রমণে তাকে বারণ করেন। এ সময় রাজাকারদের পূর্ব নিয়োজিত ইনফরমারদের দেয়া তথ্যানুযায়ী পরিকল্পিতভাবে প্রথমেই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনকে গুলি করে হত্যা করে তাদের অপারেশনের প্রথম বাধা দূর করা হয়। তারপর রাজাকাররা ফাঁকা গুলি চালিয়ে সমস্ত বাজারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বাজারের অপ্রস্তুত লোকজন গুলির আওয়াজে জ্ঞানশূন্য হয়ে বিভিন্ন দিকে পালাতে শুরু করে। বাজারের মধ্যবর্তী বোয়ালজুরি খালের ওপরে বর্তমান নতুন ব্রিজটির প্রায় ২০০ গজ দক্ষিণে ছিলো কাঠের পুল। কাঠের পুলের পশ্চিম পাড়ে পাটের ব্যবসায়ী রাজাকার মন্তা রাইফেল হাতে সহযোগী রাজাকারদের গাইডলাইন দিচ্ছে দেখে পাট মাপার কাজে নিয়োজিত তারাপল্যা গ্রামের সাহসী যুবক সামছুল হক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তিনি দৌড়ে এসে রাজাকার মন্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মন্তা তুই এ বাজারের লোক হয়ে কীভাবে এই বাজার আক্রমণ করতে আস্ছিস্?’ এ নিয়ে রাজাকার মন্তার সাথে সামছুল হকের বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সামছুল হক মন্তাকে ঝাপটে ধরে হাতাহাতি শুরু করে রাইফেলটি ছিনিয়ে নিয়ে মন্তাকে ফেলে রাইফেল দিয়ে পিটাতে শুরু করে। এই সময় সামছুল হককে সাহায্য করতে দ্রুত ঘটনা স্থলে এগিয়ে আসেন তার পিতা ওয়াজদ্দিন ও প্রতিবেশী জুনাব আলী। এমনটি দেখে অন্য রাজাকাররা প্রথমে সামছুল হককে এবং পর পরই ওয়াজউদ্দিন ও জুনাব আলীকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় তাদের অদূরে গুলিতে নিহত হয় ৭ম শ্রেণির ছাত্র আঃ রশিদ খন্দকার, যার লাশ কবুতরের খাঁচা জড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর রাজাকারেরা চালায় নির্বিচারে গুলি ও চালায় লুটতরাজ। বাজারের মসজিদের দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তান থেকে সদ্য এমএ পাস করে আসা মদ্দেরবাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার কয়েক গজ দূরে তখনকার কলেজ ছাত্র, কাদলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ.কে.এম. মাইনউদ্দিন মজুমদারকে গুলি করার উদ্দেশ্যে অন্যদের সাথে লাইনে দাঁড় করানো হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। রাজাকাররা রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে অস্ত্র নির্মাণাগার এবং অস্ত্রের ভাণ্ডার মনে করে বিদ্যালয়ের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে এবং বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এমনি করে রাজাকাররা কয়েক ঘণ্টা তাণ্ডবলীলা (হত্যাযজ্ঞ) ও ব্যাপক লুটতরাজ শেষ করে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনের লাশ হাজীগঞ্জে নিয়ে যায় এবং তার লাশ হাজীগঞ্জ বাজারের এক প্রান্তে থেকে অপর প্রান্ত টেনে-হেঁচড়ে উল্লাস করে টাঙ্গিয়ে প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নাসিরকোর্টে সমাধিস্থ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের এ মর্মান্তিক ঘটনা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিগত পঁচিশ বছরেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা পাননি শহীদের মর্যাদা এবং তাঁদের পরিবার পায়নি ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা। এ ব্যাপারে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্যে ডিসেম্বর ১৯৯৬-এ চাঁদপুরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা চলাকালে বিজয় মেলার দপ্তরে বসে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ বিজয় মেলার দপ্তর উপ-পরিষদের আহ্বায়ক সরদার আবুল বাসারের পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্ব ও তথ্য সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব বাসুদেব মজুমদার এবং চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জ সমিতির ঐকান্তিক আগ্রহে তৎকালীন সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী শাহাদাত, আজকের কাগজের জেলা প্রতিনিধি হাবীবুর রহমান খান, ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি আলম পলাশসহ ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ১৫ ডিসেম্বর ১৯৯৬, ৬ জানুয়ারি ১৯৯৭ ও ২২ জানুয়ারি ১৯৯৭ তিন দফা রঘুনাথপুর বাজার এলাকায় আসেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করে ক্যাসেটে ধারণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজাকাররা চলে যাওয়ার পর পরই স্থানীয় লোকজন একত্রিত হয়ে রঘুনাথপুর বাজারে পড়ে থাকা সতেরোটি লাশ দেখতে পায়। তন্মধ্যে ৫টি বাজারের মধ্যবর্তী খালের পশ্চিম পাড়ে এবং বারটি পূর্ব পাড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, এ সতেরটি ছাড়াও অনেক লাশ তাদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক লোক এ হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন। আমরা এ পর্যন্ত যে শহীদদের তালিকা পেয়েছি, তা হচ্ছে :
১) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃ মতিন, গ্রাম-রাজাপুর, থানা-শাহরাস্তি; ২) শহীদ সামছুল হক, পিতা-শহীদ ওয়াজউদ্দিন; ৩) শহীদ ওয়াজউদ্দিন, গ্রাম-তারাপল্লা, থানা-হাজীগঞ্জ; ৪) শহীদ জুনাব আলী, গ্রাম-তারাপল্লা, থানা-হাজীগঞ্জ; ৫) শহীদ আব্দুল আউয়াল চৌধুরী, পিতা-বাদশা মিয়া, গ্রাম-ধড্ডা, থানা-হাজীগঞ্জ; ৬) শহীদ মোয়াজ্জেম আলী, গ্রাম-মহাব্বতপুর, থানা-হাজীগঞ্জ; ৭) শহীদ নজরুল ইসলাম, পিতা-ছেরাজল হক ভূঁইয়া, গ্রাম-মদ্দিরবাগ, থানা-কচুয়া; ৮) শহীদ প্রাণ বল্লভ শীল, গ্রাম-রামপুর, থানা-হাজীগঞ্জ; ৯) শহীদ গিরিশ চন্দ্র সরকার, গ্রাম-পরাণপুর, থানা-কচুয়া; ১০) শহীদ মোখলেছুর রহমান, পিতা-মোঃ মনু মিয়া, গ্রাম-ওড়পুর, থানা-হাজীগঞ্জ; ১১) শহীদ জংসর আলী, পিতা-আজিম উদ্দিন, গ্রাম-ওড়পুর, থানা-হাজীগঞ্জ; ১২) শহীদ আঃ রব, পিতা-মৃত ইসহাক মুন্সি, গ্রাম-ওড়পুর, থানা-হাজীগঞ্জ; ১৩) শহীদ আঃ রশিদ খন্দকার, (সপ্তম শ্রেণির ছাত্র), পিতা-আলী আকবর, গ্রাম-সাঁড়াশিয়া, থানা-হাজীগঞ্জ ও ১৪) শহীদ জাহানারা (বয়স ৮ বছর), পিতা-মৃত আঃ মালেক, গ্রাম-দেবিপুর, থানা-কচুয়া।
মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর চলে গেছে, বঘুনাথপুর বাজারের শহীদদের স্মৃতি হারিয়ে যেতে দেখে আমরা কয়েকজন বিগত ৬ জানুয়ারি ১৯৯৬ তারিখে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক সভায় মিলিত হয়ে মিঞা মোঃ ওয়াহিদুল আলমকে সভাপতি এবং সরদার আবুল বাসারকে সাধারণ সম্পাদক করে রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ গঠন করি। এ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে এবং চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জ সমিতির সহযোগিতায় গত ১৩ জানায়ারি ১৯৯৭ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এম. এ. ওয়াদুদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে রঘুনাথপুর বাজারে মুক্তিযুদ্ধকালীন উপরোক্ত ঘটনাবলি অবহিত করি। তিনি তা শুনেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ রঘুনাথপুর বাজারে শহীদদের স্মরণে নির্মিতব্য স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সম্মতি দেন। অবশেষে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ অপরাহ্নে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এতদ্ উপলক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ খালিদ আনোয়ার প্রধান অতিথি, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার এম. এ. ওয়াদুদ, হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার আতিয়ার রহমান ও কচুয়া থানা নির্বাহী কর্মকর্তা অনন্ত কুমার চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জ সমিতির সভাপতি অধ্যাপক কবি জাকির হোসেন মজুমদার, চাঁদপুর সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হারুন অর রশিদ চৌধুরী, জেলা ডেপুটি কমান্ডার মাস্টার ওয়ারেন্ট (অবঃ) আঃ হাফেজ খান, কচুয়া থানা কমান্ডার এম. এ. মবিন, গুলবাহার কলেজের অধ্যক্ষ, ধড্ডা মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ, চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যাপক মাসুদুর রহমান, আজকের কাগজের জেলা প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান, দৈনিক মিল্লাতের জেলা প্রতিনিধি মঞ্জুর আলম মনা, নিউজ মিডিয়ার সংবাদদাতা মোঃ নেয়ামত হোসেন, দৈনিক ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি আলম পলাশ, সাপ্তাহিক চাঁদপুর সংবাদের সহকারী সম্পাদক এম. এ. রাজ্জাক, দৈনিক দিনকালের নিজস্ব সংবাদদাতা শাহ মোঃ সেলিম, চাঁদপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব বাসুদেব মজুমদার, কবি ও লেখক সংগঠন কাব্যলোকের সাধারণ সম্পাদক সামীম আহমেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্র এলাকার কৃতীসন্তান মজিবুর রহমান মজুমদার ছিলেন তৎকালীন হাজীগঞ্জের থানা কমান্ডার (হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলা), যাঁর নাম কুমিল্লা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর অনুপ্রেরণায় অত্র এলাকার শত শত লোক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাড়া অত্র এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্বজনাব সামছুল আলম (নাসিরকোর্ট), শরিফউল্যাহ পাটওয়ারী (পিরোজপুর), এরশাদ হোসেন মাস্টার (তারাপল্লা), খলিলুর রহমান (মহব্বতপুর), আঃ মন্নান মাস্টার (নিশ্চিন্তপুর), ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ মজুমদার (বানিয়াচোঁ), আঃ মতিন ভূঁইয়া (মাড়কি), আব্দুল বারী (রাজাপুর), দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া (মদ্দেরভাগ), আমির হোসেন পাঠান (আয়মা), আবুল বাসার খান, মিঞা মোঃ ওয়াহিদুল আলম, আবু তাহের রেণু (কাদলা), আব্দুল হাই তালুকদার, দেলোয়ার হোসেন (এম. এফ.), হাবীবুর রহমান (তারাপল্লা), সৈয়দ আহম্মদ মজুমদার (পিরোজপুর)সহ অনেকে।
রঘুনাথপুর বাজারের হত্যাকাণ্ড ছিলো লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক এবং মর্মস্পর্শী। গোটা চাঁদপুর জেলার মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ছিলো সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড। চাঁদপুর জেলার এ পল্লীতে এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ১৯৯৭ সালের পূর্বে তাদের কেউ স্মরণ করেননি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ খালিদ আনোয়ার ১৯৯৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ভাস্কর্য নির্মাণ করে যেতে না পারলেও একটি শহীদ মিনার নির্মাণের বরাদ্দ দিয়ে গেছেন, যা এখনও স্কুল মাঠে শোভা পাচ্ছে।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের চার বছর পর আবারও উদ্যোগ গ্রহণ করি ভাস্কর্য নির্মাণের। ২০০১ সালের ১৬ মার্চ দেশবরেণ্য ভাস্কর্যশিল্পী স্বপন আচার্যী, প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেন, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাস্কর্য নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ পরিদর্শন করেন। সফরসঙ্গী ছিলেন চাঁদপুর রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দৈনিক চাঁদপুর দর্পণের সহকারী বার্তা সম্পাদক শেখ মহিউদ্দিন রাসেল, সাংবাদিক শাহ মোঃ সেলিম, মুনাওয়ার কানন ও লেখকসহ শহীদ পরিবারের সদস্য, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও এলাকার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ। প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হবে এমন একটি ভাস্কর্য নির্মাণের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন দেশবরেণ্য ভাস্কর্যশিল্পী স্বপন আচার্যী। রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনের কারণে ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ অগ্রসর হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার পর শহীদদের স্মরণে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ আসলেও স্থান নির্ধারণ জটিলতার কারণে বিষয়টি ঝুলে আছে। বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।
রঘুনাথপুর বাজার থেকে চৌমুহনী বাজার যাওয়ার পথে বোয়ালজুরি খালের পশ্চিম পার্শ্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সামছুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ওয়াজউদ্দিন ও শহীদ জুনাব আলীর সমাধি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। চাঁদপুর জেলা পরিষদ থেকে সমাধি পাকা করার জন্যে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও সমাধিস্থানে মালিকানা জটিলতার কারণে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
রঘুনাথপুর বলতে কোনো গ্রাম নেই। কচুয়া থানার কাদলা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রঘুনাথপুর বাজার। আর এ বাজারের পশ্চিম পাশে রয়েছে বোয়ালজুরি খাল ও হাজীগঞ্জ উপজেলার তারাপল্লা গ্রাম। রঘুনাথপুরে কোনো নির্বাচনী কেন্দ্র নেই বলে অনেকেই একে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এলাকার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার সীমানায় অবস্থিত বলে উভয় উপজেলার নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অত্যধিক। বর্তমান সরকারের আমলে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও বাজারের অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাজারের ডাকঘরটি ৬ শতাংশ ভূমির উপর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। ডাকঘরের স্থানটি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নামে রয়েছে বলে জানা যায়। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, ডাকঘরটি নির্মাণ করে সাব-পোস্ট অফিসে রূপান্তর করা প্রয়োজন। যেহেতু এ ডাকঘরের অধীনে হাজীগঞ্জ উপজেলার তারাপল্লা, পিরোজপুর, মাড়কি, বানিয়াচোঁ এবং কচুয়া উপজেলার কাদলা, বরইগাঁও, দেবীপুর, চৌমুহনী বাজার, আয়মা, মুরাদপুর, তেগুরিয়া, শাসনখোলাসহ প্রায় ১২টি গ্রামের অধিবাসীগণের দেশ বিদেশের বিপুল পরিমাণে চিঠিপত্র, অর্থ ইত্যাদি লেনদেনের জন্যে পোস্ট মাস্টার, পিওন ও রানার রয়েছে। ডাকঘরটি অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকায় পোস্ট মাস্টার বিভিন্ন দোকানে বসে কার্যক্রম চালাতে হয়। তজ্জন্য দোকানদারদের অশোভন কথা শুনতে হয়। বিষয়টিতে জেলা প্রশাসক চাঁদপুর মহোদয়ের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।
রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাজারের দিঘির পূর্ব পাড়ে অবস্থিত কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অধীনে রঘুনাথপুর উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্যে মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার রয়েছে। জানা যায়, উক্ত উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন অফিস সহায়কের পদ খালি রয়েছে। চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্যে প্রচুর লোক থাকলেও উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি খুবই জরাজীর্ণ, আসবাবপত্রের ভীষণ অভাব, ঔষুধপত্র সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এক কথায় চিকিৎসা প্রদানের অনুপোযোগী। বিষয়টিতে সিভিল সার্জন চাঁদপুর মহোদয়ের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল বাসার : সভাপতি, রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ, কচুয়া-হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর। মোবাইল : ০১৮১৯-৮৩১৫১০