বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৩, ০০:০০

ফ্রী পাবার মানসিকতা ঝুঁকিপূর্ণ
অনলাইন ডেস্ক

জগতে ফ্রী বলতে কিছু নেই। ফ্রী পাওয়া মানে আরেকজনের ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করা। বিনা পরিশ্রমে কোনো কিছু অর্জন সব সময়ই একটা প্রশ্নের জন্ম দিবে। ফ্রী কোনো কিছু গ্রহণ করলে তার বিনিময়ে আপনাকে কিছু দিতে হবে। সেটা বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত হতে পারে। ফ্রী একটা লোভ! এই লোভকে কিছু মানুষ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে কাজে লাগায়। ফ্রী কোনো কিছু গ্রহণ করার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে বিনিময়ে কী দিতে হবে?

ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশের মানুষকে ফ্রী চা পানের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। মানুষ শুরুর দিকে সন্দেহ করে চা পান করতে অনাগ্রহী ছিলো। চা কোম্পানিগুলো চায়ের উপকারিতা বর্ণনা করে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। রেলস্টেশন, লঞ্চ ঘাট, বাস টার্মিনাল, হাট-বাজারে ফ্রী চা পানের হিড়িক পড়েছিলো। একশো বছর পর এখন মানুষ নিজের টাকা খরচ করে ফ্রী চা পানের মর্ম বুঝতে পারে। চা পান এখন দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।

বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধূমপায়ী করার ক্ষেত্রে বিড়ি-সিগারেট কোম্পানিগুলো বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। কোম্পানিগুলো শহর বন্দর, হাট বাজারে ফ্রী বিড়ি-সিগারেট বিতরণ করে জনসাধারণকে ধূমপানে উৎসাহিত করতো। বিড়ি কোম্পানিগুলো গ্রামের হাট-বাজারে গান বাজনা, পুতুল নাচ, যাদু, সার্কাস দেখিয়ে মানুষ জড় করে বিড়ির উপকারিতা বর্ণনা করতো। সিগারেট কোম্পানিগুলো বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে সিগারেটের প্রচারণা চালাতো। শহর-বন্দরে বড় বড় বিলবোর্ডে জনপ্রিয় নায়কের মুখে সিগারেট দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হতো। পত্রিকার পাতা জুড়ে সিগারেটের বিজ্ঞাপন থাকতো। সিনেমা-নাটকে নায়কের মুখে সিগারেট দিয়ে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা হতো। শুরুর দিকে সিগারেট কোম্পানিগুলো ফ্রী সিগারেট বিতরণ করে জনসাধারণ দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়েছে।

সিগারেট কোম্পানিগুলো উত্তর বঙ্গে বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের গরীব চাষীদের তামাক চাষে বিশেষ প্রণোদনা দিচ্ছে।

বিড়ি-সিগারেট আসার আগে আমাদের দেশের মানুষ হুক্কা দিয়ে ধূমপান করতো। আবার কেউ কেউ তামাক পাতাকে আগুনে সেঁকে পাতায় মুড়িয়ে বিড়ি বানিয়ে খেতো। এসব প্রস্তুত করতে সময় লাগতো বলে নেশা উঠলে যখন তখন দেশলাই জ্বালিয়ে ধূমপানের সুযোগ পেতো না।

ব্যবসায়ীরা মানুষের কাছে ধূমপানকে সহজলভ্য করার জন্যে কাগজে বিড়ি সিগারেট বানিয়ে প্যাকেট করে দিয়েছে, যাতে ইচ্ছে করলে দেশলাই জ্বালিয়ে ধূমপান করতে পারে। এসব বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেট সহজলভ্য বলে অনেকেই মজুত করতে পারে।

ক্ষমতাবান মানুষের বাসা বাড়িতে মিষ্টি, দই, ফলমূল, কাপড় চোপড়, মাছ নিয়ে যারা হাজির হন তাদের মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে থাকে। কখনো বদলি, প্রমোশন, চাকরি, শাস্তি মওকুফ, সুপারিশ, পদ লাভের আশায় ক্ষমতাবানদের বাসা বাড়িতে আনাগোনা করতে দেখা যায়। কাউকে সমীহ করা, সালাম দেয়া, প্রশংসা করার মধ্যেও ব্যক্তির স্বার্থ লুকিয়ে থাকে।

বিনা পরিশ্রমে কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবার টেবিলে যে পরিমাণ অস্থিরতা দেখা যায় তা থেকে অনেক কিছু বোঝার আছে। গুরুত্বপূর্ণ লোককে দেখেছি গাড়ির ড্রাইভারের জন্যে খাবারের প্যাকেট চেয়ে নিতে। তারা ইচ্ছে করলে দুই-চার-পাঁচশ’ টাকা ড্রাইভারের জন্যে দিতে পারেন। ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজকরা সবাই মিলে টাকা পয়সা জোগাড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেখানে হয়তো ড্রাইভারের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা রাখা যায় নি। সেটা নিয়ে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করেন।

একবার কমদামে মুরগির ডিম দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হলো। প্রতি ডজন বাজার মূল্যের চাইতে ত্রিশ /চল্লিশ টাকা কমে। সেটা নিয়ে ঢাকা শহরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। মানুষের দীর্ঘ লাইন, হুড়াহুড়ি, মারামারি টেলিভিশন ও পত্রিকার মাধ্যমে সারাদেশের মানুষ দেখতে পেয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে লাঠি চার্জ করতে হয়েছিল। আয়োজকরা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বিক্রি বন্ধ করে চলে যায়।

গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, বাঙালি আলকাতরা ফ্রী পেলে শার্ট পেতে নেয়।

ব্যবসায়ীরা মানুষের এই ফ্রী পাবার মানসিকতা খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তারা পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য নানান রকমের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। একটা কিনলে আরেকটা ফ্রী, এক কেজি কিনলে একশ’ গ্রাম ফ্রী, চিনি কিনলে সেমাই ফ্রী, চিংড়ি কিনলে লাউ ফ্রী, বিস্কুটে ৩০℅ ফ্রী, চাল কিনলে ডাল ফ্রী ইত্যাদি অফার আমাদের চোখের সামনে পড়ে। প্রয়োজন থাকুক কিংবা না থাকুক অমনি কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে কেনার জন্য।

একশ্রেণির মানুষ সবকিছু ফ্রী পাবার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তারা সরকারি সেবা সমূহ ফ্রীতে আশা করে। চিকিৎসা, ওষুধ, পরিবহন, সেবা সহ সকল খাতে ছাড় পাবার জন্যে আগ্রহী লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব দাবি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। প্রবীণদের একটা বড় অংশ চিকিৎসা, সেবা, ওষুধ ফ্রীতে, পেনশন-ভাতা বৃদ্ধি, সকল যানবাহনে বিশেষ ছাড়ে চলাচলের সুযোগ সুবিধা চায়। তাদের অনেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবীণদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার উদাহরণ দেন। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের দেশগুলো প্রবীণদের কী কী সুবিধা দেয় সেসব কথা আমাদের পণ্ডিত ব্যক্তিদের মুখে প্রায়ই শুনতে পাই। বাংলাদেশে এসব সুযোগ-সুবিধা নেই বলে আক্ষেপ-অনুশোচনার অন্ত নেই। পশ্চিমা বিশ্বের প্রবীণরা সরকার থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ফ্রী পান না। তারা যখন যৌবনে ছিলেন তখন সরকারকে আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ ট্যাক্স হিসেবে প্রদান করেছিলেন। বার্ধক্যে এসে তারা সরকারের নিকট থেকে ফেরত পাচ্ছেন। বাংলাদেশে মাত্র ২৮ লাখ মানুষ রিটার্ন জমা দেন। এরমধ্যে একটি অংশ সর্বনিম্ন করদাতা হিসেবে রিটার্ন জমা দেন। আমাদের দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে জর্দার কোম্পানির মালিক যেখানে সর্বোচ্চ করদাতা, সেখানে রাষ্ট্রীয় সেবা সকল নাগরিকের ফ্রী করা অনেক কঠিন কাজ।

দুর্দশাগ্রস্ত অসহায় নারী-পুরুষ যারা শ্রম বিক্রি করে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ-সুবিধা দেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য।

একদল মানুষ আছেন তারা কর্মজীবনে নানান রকমের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এখন বার্ধক্যে এসেও নানান রকমের সুযোগ-সুবিধা পাবার জন্যে দেন দরবার করছেন।

কর্মজীবনে যাঁরা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরব থেকেছেন বেশি, তারাই এখন ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র্র বানানোর জন্যে যাদের ওপর জনগণ দায়িত্ব দিয়েছিল তারা নিজেদের কল্যাণের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী ছিলেন।

বাংলাদেশকে যেসব দেশ খয়রাতি সাহায্য দেয় সেখানে অন্তর্নিহিত স্বার্থ বিরাজমান থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা যখন দান করি, তখন আমাদের বালা মসিবত, বিপদ আপদ দূর করতে স্রষ্টার আনুকূল্য লাভের আশা থাকে।

মানুষ ভালো বলবে, প্রশংসা করবে এইটুকু শোনার জন্য কেউ কেউ দান করে থাকেন। দান করলে পরকালে পুরস্কার পাবেন এই আশা অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস। সকল ফ্রী জিনিসের পেছনে একটা স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। যিনি ফ্রী গ্রহণ করবেন তিনি প্রকারান্তরে ফ্রী দাতার স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকেন। যিনি কোনো কারণে ফ্রী কিছু গ্রহণ করেছেন, তিনি সচেতন ভাবেই সমপরিমাণ বা ততধিক ফেরত দিয়ে নিজের কাছে দায়মুক্ত থাকতে হবে।

পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছু পাওয়া সম্মানের। বিনা পরিশ্রমে কিছু পাওয়া অসম্মানজনক। ফ্রী পাবার মানসিকতা আমাদের আত্মমর্যাদা তৈরির পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে আছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়