প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৩, ০০:০০
আকাশ ভালোবাসে মাটিকে, পাহাড় ভালোবাসে ঝর্ণাকে, নদী ভালোবাসে দুই কূল ভরা জলরাশিকে, সাগর ভালোবাসে আছড়ে পড়া ঢেউকে, ফুল ভালোবাসে গন্ধ ও সৌন্দর্য বিলাতে, সূর্য ভালোবাসে রোদকে, চাঁদ ভালোবাসে জোসনাকে, পাখি ভালোবাসে মুক্ত আকাশকে, মাছ ভালোবাসে পানিকে। এর চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেন বা শান্তি পান মা তার সন্তানকে। তাইতো মা মাকড়সা সন্তান জন্ম দিয়েই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেয়।
আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার, আন্তর্জাতিক মা দিবস। ১৯০৭ সাল থেকে মার্কিন স্কুল শিক্ষিকা আন্না জারভিসের প্রাণ প্রিয়তমা মা অ্যান মারিয়া বিভেশ জারভিস-এর মৃত্যু বার্ষিকীর দিনটি মা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯১৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এই দিনটিকে জাতীয় মা দিবস হিসেবে মর্যাদা দেন এবং ১৯৬২ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগেও কোনো মা তাঁর সন্তানকে হত্যা করাতো দূরের কথা, এ নির্মম, নির্দয়, নিষ্ঠুর কাজে সহযোগিতাও করেননি। ইউরোপ বিজয়ী বীর সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তাঁর মা লেটিসিয়াকে দেখেছেন বুদ্ধি, আত্মমর্যাদা বোধ, ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে ১৩ সন্তানকে লালন পালন করতে। তাইতো তিনি বলেছিলেন ‘আমাকে একজন ভাল মা দাও, আমি তোমাকে একটি ভাল জাতি উপহার দিব’। খ্রিস্টপূর্ব থেকে খ্রিস্টাব্দ (রাণী থেকে শ্রমিক) পর্যন্ত মায়ের ভালবাসা সন্তানের প্রতি কোনো কমতি বা ঘাটতি আজও নেই। জৈন ধর্মের অনুসারী মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। তাঁর পিতা ছেলে বিন্দুসার-এর (মহামতি সম্রাট অশোকের বাবা) জন্মদিন কখনো পালন করেন নি। একদিন পিতা চন্দ্রগুপ্ত রাজপ্রাসাদের বিশ্রাম কক্ষে পুত্র বিন্দুসারকে বললেন ‘তুমি তোমার মাকে কোনো দিন দেখনি। তিনি ছিলেন গ্রিক রাজকন্যা। তোমাকে জন্ম দিতে গিয়ে তোমার মা ওই দিনই স্বর্গে চলে গেছেন। তাই এই কাহিনি তোমার জানা আবশ্যক। ভবিষ্যতে তুমি ভারতবর্ষের রাজা হবে। চানক্যচানক্য আমার শরীরটাই বিষ প্রতিরোধী করে গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিদিন তাই খাবারে বিষ দেয়া হতো এবং দিনে দিনে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতো। তোমার মাকে কেউ বুঝিয়েছিলেন যে, আমার ভুক্তাবশেষ (Leaving of food) খেলেই তোমার জন্মগ্রহণ সহজ ও নিরাপদ হবে এবং তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। ভুক্তাবশেষের পদেই থাকত বিষ। একদিন হঠাৎ তোমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি বিষক্রিয়ায় টলছেন। গুরচদেব বুঝলেন তোমার মাকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। তাই তোমার নিরাপত্তার জন্য তোমার মায়ের শিরচ্ছেদ করা হয়। উদ্দেশ্য ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা। প্রখ্যাত রাজ শল্য চিকিৎসক সে মুহূর্তে মাতৃগর্ভ থেকে তোমাকে উদ্ধার করেন। তুমি বিষক্রিয়ায় রক্ষা পেলে-বাবা বড়ো দুঃসময়ে তোমার জন্ম। তোমার মুখের দিকে তাকালেই তোমার গর্ভধারিণী মহীয়সী মার কথা আমার বেশি মনে পড়ে। এই কারণে তোমার জন্মদিন কোনো দিন পালন করিনি। বাবা তোমার মায়ের জীবনের বিনিময়েই আজ তোমার জীবন।
২০১২ সালে সাহিত্যে চীনের নোবেল বিজয়ী মো ইয়ান দেখতে ছিলেন ছোট বেলায় কিছুটা কুৎসিত। তাই গ্রামের লোকেরা প্রায়ই তার সামনে হাসাহাসি করতেন। এমনকি স্কুলের ছেলেরা তাকে মারতেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাসায় চলে গেলে তাঁর মা বলতেন ‘তুমি কুৎসিত নও বাবা। তোমার একটি নাক, দুটি চোখ আছে, আর তোমার হাত ও পায়ে কোনো সমস্যা নেই। তুমি কীভাবে কুৎসিত? যদি তোমার একটি সুন্দর হৃদয় থাকে, আর সব সময় সঠিক কাজটি করো, যা আজ কুৎসিত বলে বিবেচিত তা একদিন সুন্দর হয়ে যাবে। তাঁর মা আজ পৃথিবীর অংশে পরিণত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী আজ সত্যিই পরিণত হয়েছে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, মাকে নিয়ে কিছু কাহিনি আছে। এক প্রেমিকা ভালোবাসার পরীক্ষা হিসাবে তাঁর প্রেমিকের মায়ের হৃৎপিণ্ড চাইলে প্রেমিক বাসায় এসে তাঁর মাকে বুক পেতে দিতে বললে মা তা-ই করেন। অবশেষে প্রেমিকার বাড়ির কাছাকাছি দৌড়ে হৃৎপিণ্ড নিয়ে পৌঁছার পূর্বে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে মা বলে উঠেন, ব্যথা পেলি বাবা?
অন্য একটি হৃদয় স্পর্শ করা ‘আমার মা’ নামক বিদেশি গল্প আজ না লিখে পারছি না। আমার মায়ের চোখ মাত্র একটি। অন্যটি গোলাকার ফাঁকা, গর্তটা দেখতে ভয়ঙ্কর। তাই মাকে বীভৎস দেখায়। আমি আমার মাকে খুব ঘেন্না করতাম। আমার মাকে যে কেউ দেখলে ভয় পেতো। সংসার তিনি চালাতেন। স্কুলের বন্ধুরা মাকে দেখলে আমি বিব্রত বোধ করতাম এবং ঝামেলায় পড়ে যেতাম। আমার সহপাঠীরা আমাকে বলত, কিরে তোর মায়ের এক চোখ কানা। ছি! ছি! আমি রাগ করে বলতাম, মা তুমি মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই। আমার বেহায়া মা এ উক্তির কোনো দিন প্রতিবাদ করতো না। আমি বড় হয়ে শহরে অন্যত্র চলে গেলাম। অনেক বছর পর আমাকে না দেখার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন আমার শহরের বাসায় মা চলে এলেন। নাতি. নাতনি, ছেলেমেয়েরা দরজায় তাঁকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো এবং ঠাট্টা করতে লাগলো। হৈ চৈ শুনে আমি তাঁকে দেখে এ অবস্থায় চলে যেতে বললাম। বিনা দাওয়াতে তুমি কেন এখানে এসেছ? তোমার কত বড় দুঃসাহস আমার বাচ্চাদের ভয় দেখাতে এসেছ? কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, আমি দুঃখিত একটা ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি, বাবা। তারপর আমার মা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। ছোট বেলায় গ্রামের স্কুলে পুনর্মিলন অনুষ্ঠান শেষে আমি ভাবলাম গ্রামের বাড়িটি দেখে যাই, তাছাড়া কানা বুড়িটাতো ওখানে থাকে। আমি গিয়ে শুনলাম আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। শুনে আমার কান্নাও পেলো না। প্রতিবেশীরা বললেন, মরার আগে তোমার মা একটা চিঠি লিখে দিয়ে গেছে। তারা আমাকে সেই চিঠি খানা পড়তে দিলেন। কী লিখা আছে সেই মহীয়সী মা-এর চিঠিতে ? চিঠিখানা নিম্নরূপ--প্রিয়তম সোনা লক্ষ্মী আমার, আমি সব সময় তোমার কথা ভাবি। বাছা ধন, আমি খুব দুঃখিত যে তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার আদরের সন্তানদের ভয় দেখিয়েছি। গ্রামের লোকদের কাছে শুনেছি, তুমি স্কুলের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে আসবে। শুনে আমার খুব আনন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার শরীরটা এতো খারাপ ছিল যে, বিছানা থেকে নেমে তোমাকে যে দেখে আসবো আমার সে শক্তিও নেই। তুমি যখন বড় হয়ে উঠেছিলে আমি বার বার তোমাকে বিব্রত করেছি বলে সত্যিই খুব দুঃখিত। তুমি যখন খুবই ছোট ছিলে এক দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল। তুমি বাঁচবে মাত্র একটা চোখ নিয়ে আর আমার থাকবে দুটো চোখ, তা কি হয়? আমি তোমাকে আমার একটা চোখ দিয়ে দিলাম। আমি তোমাকে নিয়ে খুবই গর্বিত। আমার একটা চোখ দিয়ে তুমি নতুন পৃথিবীটাকে আমার হয়ে দেখতে পাচ্ছ। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে। তোমার জন্যে সকল ভালবাসা। ইতি-তোমার মা।
আর একটি ছোট্ট সোনালি গৌরবোজ্জ্বল বিজয় গাথা নিকট অতীত ইতিহাস না লিখলে এই দিবসের তাৎপর্য ও সার্থকতা এই মুহূর্তে আসবে না। সেই অনন্য নারী শ্রমিক রানা প্লাজায় মিশে একাকার হয়ে গেছেন। সেই মহীয়সী মা শাহীনার কাহিনি দেশে বিদেশে জানেন না এমন লোকের সংখ্যা নেই বললেই চলে। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার আগে শাহীনা সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীদের বার বার অনুরোধ করছিলেন আর বলছিলেন ‘অনেককে বের করেন। আমাকে না বের করলে আমার দুধের বাচ্চাকে বাঁচাতে পারব না। সে কয়েক দিন ধরে আমার দুধ খেতে পারছে না।’ মৃত্যু-দরজায় দাঁড়িয়েও চোখের জলে বাচ্চার জন্যে নিজের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন শাহীনা। সকলের মহৎ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। অবশেষে তাকে উদ্ধার করা হয়, তবে প্রাণহীন অবস্থায়। তাকে জীবিত উদ্ধার করতে না পেরে উদ্ধারকর্মী ও সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে কেঁদে ফেলেন। শুধু তারাই কাঁদেন নি, সাথে সাথে দেশের সকল মানুষকেও তারা কাঁদিয়েছেন। সেনা সদস্য কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার বোনকে আর বাঁচাতে পারলাম না। ছোট্ট দেড় বছরের অবুঝ শিশু রবিন জানে না তার মা আর জীবনেও তার কাছে কখনো ফিরে আসবে না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে আর বুকে জড়িয়ে কোলে নিবে না। কারো নজর বা কুদৃষ্টি যেন না লাগে এই জন্য কপালে আর বড় করে টিপ দিবে না। কাজে যাবার আগে ও পরে দুধ খাওয়াবে না। প্রিয় সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে কখনো তাঁকে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। তিনি দুর্ঘটনায় মরে প্রমাণ করেছেন সন্তানের প্রতি চির অমলিন ভালবাসা মরে নি, মরতে পারে না, কখনও মরবে না।
আন্তর্জাতিক মা দিবসে সকল জীবিত ও প্রয়াত মা-দের শ্রদ্ধা ও যথাসাধ্য সেবা করার শতভাগ অনুরোধ জানিয়ে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতার কালজয়ী কয়েকটি মহত্ত্ব গাঁথা লাইন দিয়ে শেষ করছি--‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত্যু আর ধ্বংস স্তূপ পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণ পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল। এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অবশেষে সব কাজ সেরে, আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাবো আশীর্বাদ, তার পর হব ইতিহাস।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। ০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, [email protected]