প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৩, ০০:০০
ওয়াদুদ সাহেব আমার চেয়ে পুরো দশ বছরের বড়। বিয়ের আগে পরিচয়ের কোনো প্রশ্নই উঠে না। আমি তখন চাঁদপুর শহরের মাতৃপীঠ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। আমার বয়স তখন ২৬। আর ওয়াদুদ সাহেবের ৩৬। দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা চললো বিয়ের ব্যাপারে। ওয়াদুদ সাহেব সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবনেতা, আওয়ামী লীগের সংগঠক এবং সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও জেনারেল ম্যানেজার। পরে ১৯৫৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও জেনারেল ম্যানেজার, কার্যত মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ডে প্রধানতম সঙ্গী-সহযোগী ছিলেন এম এ ওয়াদুদ। আমি বিয়ের সময় জানতাম একজন প্রতিবাদী, প্রগতিপন্থি সংগ্রামী রাজনীতিক ও ইত্তেফাকের মতো প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার ওয়াদুদ সাহেবের সহধর্মিণী হতে যাচ্ছি। কিছুটা উৎসুক, সামান্য ভীতি তাঁর সম্পর্কে ছিল আমার মনে। পরে দেখলাম ভিন্ন মানুষ তিনি, একেবারেই নিরহঙ্কার, শিশুর মতো সরল।
যথারীতি পারিবারিকভাবে আলাপ-আলোচনার পরে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি হলো। ১৯৬০ সালের ৬ জানুয়ারি চাঁদপুর শহরে আমার বাবার বাড়িতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। উভয় পরিবারের আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিলেন। আচার-আনুষ্ঠানিকতা, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি পর্ব সম্পন্ন হয় ঐদিন দুপুরবেলা। আমার সাথে ওয়াদুদ সাহেবের সাক্ষাৎও ঘটেনি তখন পর্যন্ত। আমিও তখন বেশ উদার পারিবারিক পরিবেশে দিনযাপন করছি। বিয়ের প্রাথমিক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই সন্ধ্যার সিনেমা শো-তে আমি আমার কয়েকজন আত্মীর-স্বজনের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাই। ওয়াদুদ সাহেব সদ্যবিবাহিত জীবনসঙ্গী আমার; আমিও তাঁর অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি, তিনিও স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারে কোনো চিন্তা মাথায় ঢোকাননি। আজকালের দিনেও কিন্তু এতোটা উদারতা বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিত স্বামীর মধ্যেই দেখা যায় না।
আরও মজার ঘটনা আছে। আমি সিনেমা দেখে বাড়িতে ফিরে দেখি নতুন জামাই ওয়াদুদ সাহেব রান্নাঘরে তাঁর শাশুড়ির সঙ্গে রান্নায় সহযোগিতা করে চলছেন অত্যন্ত সক্রিয়তার সঙ্গে, যেন বাড়ির ছেলে, এখানে যে তিনি নতুন জামাই সেটা কে বলবে। অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক পন্থায় তিনি বাড়ির একজন ‘যুগযুগান্তরের সদস্য’ হয়ে গেলেন অকাতরে। ওয়াদুদ সাহেবের মধ্যে সব ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, সবকিছুকে দ্রুত আপন করে নেওয়ার যে ক্ষমতা ছিল তা অনেকটা নজিরবিহীন। আর এই বিশেষ গুণই তাঁকে একজন সফল জননেতা ও দক্ষ প্রশাসকে পরিণত করেছিল।
আর একটা ঘটনা বলছি, সেই বিয়ের সময়কার। আমাদের অঞ্চলের এবং সম্ভবত এই দেশের আরো অনেক মফস্বল শহরের বা গ্রামের বিশেষ কালচার-এর কারণে একটি শিশু যথারীতি আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের বৈঠকি ভোজে ঐ বিশেষ কাজটি করতে গেল, ওয়াদুদ সাহেব সেই শিশুটিকে টেনে কোলে নিয়ে বসিয়ে রাখলেন পুরো খাওয়ার সময়টা। শিশুদের প্রতি ওয়াদুদ সাহেবের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে নিউ মার্কেটে গিয়েছি কেনাকাটা করতে, উনি যত শিশু পাচ্ছেন সবাইকে আদর করছেন (বলা বাহুল্য, সবাই অপরিচিত)। শিশুদের জন্য তাঁর বিশেষ হৃদয়ের টান ছিল, আলাদা দরদ ছিল। তাঁর এই গুণটিও একটি দুর্লভ বিষয়। তিনি কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, সেটা হয়তো অনেক সময়ই আমরা ভুলে যাই। শিশু-কিশোরদের প্রতি তাঁর প্রাণকাড়া দরদ ছিল। সবসময়ই, সেই বার্ধক্যে ও মৃত্যুর সময়ও।
আমার বাবা চাঁদপুরের প্রথম মুসলিম আইনজীবী আবদুল হাকিম উকিল। আমাদের পরিবারটি নারীশিক্ষার পক্ষে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিল। আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই মাতৃপীঠ হাই স্কুলে শিক্ষিকার কাজ নিয়েছিলাম। বিয়ের পরেও আমি চাঁদপুরে বাবার বাড়িতে ছিলাম এবং ঐ স্কুলের শিক্ষিকার কাজও করে যাচ্ছিলাম। আমার স্বামী ওয়াদুদ সাহেব ইত্তেফাকের জেনারেল ম্যানেজারের গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বৈরশাসন বিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
১৯৬০ সালেই ওয়াদুদ সাহেব এবং আমার প্রথম সন্তান জন্মলাভ করে। টিপু তার ডাকনাম, জন্ম হয়েছিল ষাটের ২৮ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে তিনি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক, রাশিয়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। তাঁর পুরো নাম ডাঃ জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ, তিনি আমাদের একমাত্র পুত্র। একমাত্র কন্যা দীপু (পুরো নাম দীপু মনি) জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ৮ ডিসেম্বর। তিনিও চিকিৎসক। ডাঃ দীপু মনি ১৯৯১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৯৯ সালে বিশ্বসেরা বিদ্যাপীঠ জনস্ হপকিনস্ বিশ্ববিদ্যালয় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এম.পি.এইচ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এলএলবি এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ডিগ্রিও অর্জন করেন পরে। ডাঃ দীপু মনি জন্স্ হপকিনস্ বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার, বিরোধ নিরসন ও আপস-মীমাংসা প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যবান প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দুই ভাই-বোনের উভয়ই বিবাহিত এবং তাদের সন্তান রয়েছে। ডাঃ দীপু মনির স্বামী তৌফিক নাওয়াজ একজন স্বনামধন্য আইনবিদ। ডাঃ দীপু মনি সফল রাজনীতিবিদ।
আমি মা হিসেবে গর্বিত। ওয়াদুদ সাহেব ও আমার দুই সন্তান অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত, প্রত্যেকে স্বনামধন্য। ওয়াদুদ সাহেব এই দুই সন্তানকে একই সাথে বাবা এবং অনেকটা মা-এর আদর দিয়ে মানুষ করেছেন। আমি অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতাম। আমার স্বামী ওয়াদুদ সাহেব আমাদের দুই ছেলেমেয়েকে যেভাবে বাবা-মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করেছেন তা অনেকটা নজিরবিহীন, না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। সেই যে ওয়াদুদ সাহেবের মধ্যে শিশুদের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধ কাজ করতো, সেটার পরিণতিতেই হয়তো নিজের সন্তানের প্রতি অতুলনীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কোনো সময়েই দুই সন্তানের লালন-পালনের ক্লান্তি ও ঝামেলা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইতেন না। আজকাল অনেক স্বামীকে কিন্তু তেমন স্বভাবের বলে মনে হয় না। কিন্তু আমার স্বামী এতো আগেরকার সময়ের মানুষ হয়েও জীবনযাপনে শিশুদের প্রতি মমত্ব প্রকাশে এতোটা আধুনিক ছিলেন। আমি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চাঁদপুরের মাতৃপীঠ বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা ছিলাম। বিয়ের পর মাঝে মাঝে স্বামী ওয়াদুদ সাহেবের ঢাকার বাসায় আসতাম; তখন তিনি পুরোনো ঢাকায় থাকতেন, প্রধানত সূত্রাপুর এলাকায়। ১৯৬২ সালে ওয়াদুদ সাহেবের বিরুদ্ধে সামরিক সরকারের ওয়ারেন্ট (হুলিয়া) ইস্যু করা ছিল। ঐ বছরটা তাঁকে বেশিরভাগ সময়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য। ওই বছর ঢাকায়, চাঁদপুরের শ্বশুরবাড়িতে এবং বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সময় কাটাতে হয়। আমি ১৯৬৩ সালের ২১ মে স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসি স্বামী ওয়াদুদ সাহেবের সঙ্গে বসবাসের জন্য। এর আগে চাঁদপুরের স্কুল ছুটি হলে স্বামী ওয়াদুদ সাহেব আমাকে মাঝে মাঝে ঢাকার বাসায় নিয়ে আসতেন। আবার স্কুল খুললে চাঁদপুর চলে যেতাম।
আমাদের বাসায় সব রাজনৈতিক নেতারা আসতেন, ছাত্রনেতা ও যুব সংগঠনের নেতারা আসতেন। ওয়াদুদ সাহেব তাঁদেরকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। জননেতা তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাগণ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সবাই নিয়মিত আসতেন ওয়াদুদ সাহেবের কাছে। একবার তো (সম্ভবত ১৯৬৩ সালে) জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু), তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আতাউর রহমান খানসহ সব প্রধান নেতা এলেন ওয়াদুদ সাহেবের স্ত্রী হিসেবে আমাকে আশীর্বাদ করতে। আমার সঙ্গে তাঁরা অনেকক্ষণ কথা বললেন, আশীর্বাদ করলেন এবং শেষে একটি গ্রুপ ফটো তুললেন। আমার জীবনে সেটা একটা স্মরণীয় ঘটনা।
আমি তাঁকে পেয়েছিলাম ২৩ বছর। আমার জীবনে বিশাল পাওয়া। তাঁর মতো মনের মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া নিঃসন্দেহে ভাগ্যের ব্যাপার। তাঁর মধ্যে সব অসাধারণ গুণাবলি ছিল। তাঁর আদর্শ ছিল রাজনৈতিক সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য- এই দেশের হতদরিদ্র মানুষের সার্বিক শোষণমুক্তি; দেশের মানুষ ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচবে সেটা তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন। তিনি মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ পাকিস্তানি শাসক-শোষকগোষ্ঠীর নির্মম শোষণ-নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হবে।
তিনি সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রশাসন চালিয়ে গেছেন, পত্রিকাটিকে প্রতিষ্ঠার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের পরিচালক হিসেবে এবং এমনকি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়ও তাঁর শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং সুদক্ষ প্রশাসন চালানোর নজির রেখে গেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, তাঁর বিরুদ্ধে একটি সামরিক সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে হেনস্তা করেছে রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু এই দেশের মানুষ ঠিকই তাঁকে সংগ্রামী জননেতা ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে হৃদয়ে সম্মান দিয়েছে।
বেগম রহিমা ওয়াদুদ : ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদের সহধর্মিণী, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা।
সূত্র : এম এ ওয়াদুদ স্মারকগ্রন্থ, ডাঃ দীপু মনি ও এম আর মাহবুব সম্পাদিত, অনিন্দ্য প্রকাশনী।