বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩, ০০:০০

গান্ধী আশ্রম ও হেমন্ত কুমার ঘোষ
অনলাইন ডেস্ক

ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে নানা রকমের তর্ক বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু তাঁর অহিংস ৭টি নীতি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তিনি বলেছেন, নীতিহীন রাজনীতি, নৈতিকতাহীন বাণিজ্য, পরিশ্রমহীন সম্পদ, চরিত্রহীন শিক্ষা, মানবতাহীন বিজ্ঞান, বিবেক বর্জিত আনন্দ, ত্যাগহীন অর্চনা কোনো কাজে আসে না। আমাদের সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গান্ধীর এই উপলব্ধি বিবেচনার দাবি রাখে।

সমাজের নানান রকমের অসংগতি, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, অবহেলা আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম জারি রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরিরা সমস্ত রকমের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লড়াই-সংগ্রাম করার জন্যে একটা দার্শনিক উপলব্ধি প্রয়োজন হয়। গান্ধীর অহিংস নীতি আমাদের লড়াই-সংগ্রাম করার দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

সেজন্যে মহাত্মা গান্ধীর সাতটি অহিংস নীতি আজো আমাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে গান্ধীর বিশেষ একটি ভাবমূর্তি গড়ে উঠে। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ কাজ করছিল। তারা প্রতিনিয়ত গুজব ছড়িয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। একজন হিন্দু নারীকে কিছু সংখ্যক মুসলিম নিয়ে গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গুজবকে কেন্দ্র করে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। হিন্দু-মুসলিমদের রক্তে দাঙ্গা সৃষ্টিকারীদের হাত রঞ্জিত হয়। ভারত জুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সারা ভারতে ৩১৭৬টি দাঙ্গা হয়। এতে নিহত হয় বিশ লাখ মানুষ, বাস্তুভিটা হারায় প্রায় এক কোটি মানুষ। সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় কলকাতা শহরে। কলকাতার দাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে দুমাসের মধ্যেই ১০ অক্টোবর ১৯৪৬ সালে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন নোয়াখালীতে দাঙ্গা শুরু হয়। ৪ সপ্তাহ জুড়ে ভয়ানক এই দাঙ্গায় গণহত্যার শিকার হয় ৫ হাজার মানুষ। বাস্তুভিটা হারায় প্রায় এক লাখ মানুষ। শত শত মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করা হয়। দাঙ্গা বন্ধ করার জন্যে ৭৭ বছর বয়সী মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে ছুটে আসেন।

সাত নভেম্বর চৌমুহনী রেল স্টেশনে গান্ধী এসে নামেন। তিনি প্রথম জনসভা করেন দত্তপাড়া গ্রামে। এই জনসভার আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন এমএলএ হারান ঘোষ চৌধুরী। গান্ধী ১জানুয়ারি ১৯৪৭ থেকে মার্চণ্ড১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ৪৭ টি গ্রামে ৪৭ শান্তি ক্যাম্প স্থাপন করেন। গান্ধীজি ২৯ জানুয়ারি জয়াগ নামক স্থানে আসেন। ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ গান্ধীজির আগমনকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্য বসতবাটি সহ মোট ২৬৭১ একরের সম্পত্তি গান্ধীজির জন্যে উৎসর্গ করেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৭ সালে গান্ধীজি জয়াগে একটি ভোকেশনাল স্কুলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। বর্তমানে এটি গান্ধী মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিত।

২ মার্চ ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার রাজ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে গান্ধীজি দাঙ্গা থামাতে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শ্রীমতী সরা বাঈ, শ্রীমতী মানু গান্ধী ও শ্রী চারু চৌধুরী। হাওড়া স্টেশনে চারু চৌধুরী গান্ধীজির কাছে বিদায় চাইলে তিনি তাঁকে নোয়াখালীতে শান্তি মিশনে কাজ করতে নির্দেশ দেন। গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নোয়াখালীতে যারা থাকার সিদ্ধান্ত নেন তারা হলেন সর্বশ্রী দেবেন্দ্র নারায়ণ সরকার, মদন মোহন চট্টোপাধ্যায়, সাধনেন্দ্র নাথ মিত্র, বিশ্বরঞ্জন সেন, রঞ্জন কুমার দত্ত, অজিত কুমার দে, জীবন কৃষ্ণ সাহা, শ্রীনিবাস সিংহ, রেড্ডি পল্লী সত্য নারায়ণ, নারী সহকর্মী আমাতুস সালাম প্রমুখ। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে তাঁদের সাথে যোগ দেন শ্রীনিবাস সিংহ।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নোয়াখালীতে শান্তি মিশনের অন্যতম সদস্য চিরকুমার চারু চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে জেল খাটেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি কারামুক্ত হন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মহাত্মা গান্ধীর সহযোগী শ্রী মদন মোহন চট্টোপাধ্যায় ও দেবেন্দ্র নারায়ণ সরকারকে প্রার্থনারত অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।

শ্রী অজিত কুমার দে ও শ্রী জীবন কৃষ্ণ সাহা অন্যত্র হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। গান্ধীর আগমন ও শান্তি মিশন স্মরণীয় করে রাখতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য ও শ্রী চারু চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’ আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫সালে অধ্যাদেশ (৫১নং অধ্যাদেশ) বলে অম্বিকাণ্ডকালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট পুনর্গঠন করে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট গঠন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৩ সালে এই অধ্যাদেশ রেটিফায়েড হয় এবং ২০২১ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ আইনে রূপান্তরিত করা হয়।

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট বর্তমানে ১২লাখ পরিবারের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে। নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুর জেলায় বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র অসহায় জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করছে।

পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, মানবাধিকার ও সুশাসন, বিরোধ নিষ্পত্তি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, শান্তি ও সম্প্রীতির জন্যে কাজ অব্যাহত রেখেছে। গড়ে উঠেছে গান্ধী মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। এখানে প্রতিদিন বহুসংখ্যক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ মৌজার ২৬.১২একর জমিতে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট গড়ে উঠেছে। লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলায় সৈয়দপুর মৌজায় ২.৩৭ একর জমি গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের দখলে রয়েছে। পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, যা ১৯৫১সালের ১৬মে পার্লামেন্টে অনুমোদন হওয়ায় ২৬৭১ একর জমির বেশিরভাগই প্রজাদের মালিকানায় চলে যায়। ২০১৩ সালে ভারত সরকার গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সম্পাদক শ্রীমতী ঝর্ণাধারা চৌধুরীকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মশ্রী পদকে’ ভূষিত করে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক ও রোকেয়া পদকে ভূষিত করে।

কে এই হেমন্ত কুমার ঘোষ?

হেমন্ত কুমার ঘোষ জয়াগের জমিদার নব কৃষ্ণ সরকারের একমাত্র কন্যা কালীগঙ্গা চৌধুরানীর পুত্র। তাঁর পিতার নাম অম্বিকা চরণ ঘোষ। মাতামহ নবকৃষ্ণ সরকার অপুত্রক বিধায় তাঁর একমাত্র কন্যার পুত্র প্রিয় দৌহিত্র ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষকে সমুদয় সম্পত্তি দান করে যান। হেমন্ত কুমার ঘোষ পিতা অম্বিকা চরণ ঘোষ ও মাতা কালীগঙ্গা চৌধুরানীর নামে 'অম্বিকা -কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট'-এর নামে ২৬৭১ একর জমি দান করেন।

হেমন্ত কুমার ঘোষ জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার। ১৯১০ সালে তিনি বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। বিলেতে থাকার সময় তিনি সবসময়ই মনে করতেন তাঁর জন্মভূমির কথা। কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে কৃষির উন্নয়ন, দুগ্ধ খামার, দুগ্ধজাত খাবার তৈরির বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন। বিলাত থেকে ফিরে আসার পর তাঁকে ধর্মীয় বিধি বিধান অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত করার কথা বললে তিনি রাজি হননি।

হেমন্ত কুমার ঘোষ কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। বিলেতে প্রভি কাউন্সিলে মামলা পরিচালনা করেছেন। লখনৌ হাইকোর্টে আইনজীবীদের নেতা ছিলেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভায় কৃষ্ণ মেনন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই কৃষ্ণ মেনন হেমন্ত কুমার ঘোষের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন।

খ্যাতিমান গীতিকার ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেন, বিখ্যাত শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্পী উদয় শংকর, বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের সাথে হেমন্ত কুমার ঘোষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

হেমন্ত কুমার ঘোষ জীবনাচরণে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। যুক্ত ছিলেন ব্রাহ্ম্য সমাজের সাথে।

হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এসব ভেদাভেদ মানতেন না। তাঁর চেম্বারে বেশির ভাগ ক্লার্ক ছিলেন মুসলমান। রান্না ঘরের নিয়ন্ত্রণ করতো মুসলমান পাচক। মুসলমানের হাতে খেতেন আনন্দের সাথে। অসময়ে পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু তাঁকে ভীষণ কষ্টে ফেলেছিল। পারিবারিক প্রয়োজনেব ৭২ বছর বয়সে তিনি আইন পেশায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ২৮ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রবীণ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার কাছে গান্ধী ও হেমন্ত কুমারকে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।

আমাদের দেশে মানুষ প্রবীণ হবার পর মনে করতে থাকেন, এখন দায়দায়িত্ব কম, ছেলেমেয়েদের আলাদা সংসার। কর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন, নিজের মনমতো করে ঘুরে বেড়াবেন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিবেন এসব ভাবনা মাথায় থাকে। অথবা কেউ ধর্মীয় কাজে নিজকে যুক্ত করে রাখেন। প্রবীণদের মধ্যে কেউ আবার টাকা পয়সা রোজগার করতে পেরেশান হয়ে যান। খুব কম মানুষই আর্ত মানবতার সেবায় নিজের সহায় সম্পদ দিয়ে এগিয়ে আসেন। প্রবীণ বয়সে নিজের অর্জিত টাকা পয়সা পরিবারের সদস্যদের বাইরে কাউকে দিতে পারা অনেক কঠিন ব্যাপার। প্রবীণদের একটি অংশ নিজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে ক্ষান্ত হতে চান না বরং নাতি নাতনিদের ভবিষ্যতের চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েন।

অন্য দিকে গান্ধী ৭৭ বছর বয়সে ভগ্ন শরীরে নোয়াখালীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে চলে আসেন। গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দীর্ঘ চারমাস ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শান্তি ক্যাম্প স্থাপন করেন। ষাটোর্ধ্ব হেমন্ত কুমার ঘোষ মহাত্মা গান্ধীর আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে জনসাধারণের কল্যাণে তাঁর সমুদয় সম্পত্তি দান করে দেন।

আমাদের সামর্থ্যবান দরদী প্রবীণদের সংখ্যা এখন অনেকটাই বেড়েছে। তাদের মধ্য থেকে হেমন্ত কুমার ঘোষ বা গান্ধীর মতো দরদী একদল মানুষ বেরিয়ে আসবে এটা প্রত্যাশা করি।

সামর্থ্যবান দরদী প্রবীণরা মানব কল্যাণে দাতার ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়