প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৩, ০০:০০
শৈশব মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাল। শৈশবের ভালো লাগা মন্দ লাগা মানুষকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। শৈশবে প্রাপ্ত অবহেলা, অসম্মান, অমর্যাদা, শাস্তি, নির্যাতন, অপমান মানুষ এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। আনন্দ উচ্ছ্বাস সম্মান মর্যাদা প্রাপ্তিতে ভরা শৈশব মানুষের সোনালী অতীত। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সময় প্রায়শই শৈশবের সোনালী দিনগুলোর কাছে আশ্রয় নিয়ে শক্তি-সাহস জোগাড় করে। যাদের শৈশব দুঃখণ্ডকষ্টের তারাও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সময় শৈশবের কাছে আশ্রয় নিয়ে সান্ত¡না খোঁজে, আফসোস করে, বিলাপ করে, তারপর নিয়তিকে মেনে নিয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নামে।
শৈশবে যাকে প্রতারণা, চালাকি, বাটপারি, চুরি, বুলিং করতে দেখা যায়, বার্ধক্যেও তাকে ওই একই ধরনের কাজ করতে দেখা যায়। হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে ধরণ পাল্টে নেয়। শৈশবে যে স্কুলের প্রোগ্রামে চাঁদা তুলেছে, যৌবনে বিভিন্ন সংগঠন করে চাঁদা তুলেছেন, তিনি বার্ধক্যে সংগঠন করে চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত হন।
শৈশবে প্রতারণা, মিথ্যা, চুরির সাথে যিনি অধিক সক্রিয় ছিলেন, তিনি যৌবনে এসে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, দখল, জালিয়াতির কাজে হাত পাকিয়ে দেন এবং পরের ধন সম্পদ, সহায় সম্পত্তিতে মনোযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। নারীর শারীরিক সুখ লাভের সুযোগ নিতে বেহায়া, বেপরোয়া হয়ে উঠেন। আবার ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থেকে সবার আনুগত্য লাভের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেন। এসব খাসলত প্রবীণ বয়সে এসে অনেকেই বদলাতে পারেন না। কেউ কেউ ধার্মিক হবার ভান করে সকল অপকর্ম দৃষ্টির আড়ালে রাখার চেষ্টা করেন। দান খয়রাত করে মানুষের চোখে মহান হবার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
দার্শনিকভাবে দেখলে বোঝা যায়, ব্যক্তির প্রেষণা হলো মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা, দণ্ড মু-ের মালিক হওয়া, সকল প্রশংসার হকদার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া; সমালোচনাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা, যাকে খুশি তাকে ক্ষমতার ভাগ দেয়া কিংবা প্রদত্ত ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা। এই চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছানোর জন্য কাকে গুরুত্ব দিতে হবে, কাকে প্রশংসা করতে হবে সেটা নির্ধারণ করতে হয়। কাকে দণ্ড দিতে হবে বা কার দণ্ড মওকুফ করতে হবে এটাও বিবেচনা করতে হবে। এই লড়াই কবে কখন শুরু হয়েছে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাবার প্রতিযোগিতা সবসময় স্বস্তিদায়ক ও শান্তিপূর্ণ হয় না। আবার সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে একই সময় একই সাথে পৌঁছাতে পারে না। কেউ কেউ ক্ষমতার আশপাশে থেকে উত্তাপ সংগ্রহের চেষ্টা করে যায়। আশপাশে থাকা নিয়ে চলে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, কাটাকাটি, মনোমালিন্য। যে যেখানেই থাকুক না কেন তিনি প্রায়োরিটি আশা করেন। এসব যৌবনে পাওয়া যতটা সহজ বার্ধক্যে এসে ততটাই কঠিন। বার্ধক্যে এসে অনেকের মধ্যে অভ্যাসগত ক্ষমতার মোহ চাঙ্গা হয়ে উঠে। ভুলে যান তিনি আর ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতেও নেই, আশপাশেও নেই। এরা অনেকেই জানেন কোন্ ধরনের কাজ করলে সমাজের মনোযোগ, প্রশংসা পাওয়া যাবে। কোন্ ধরনের মানুষদের সংগঠিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ। কেউ কেউ গড়ে তোলেন সংগঠন, সংঘ, ক্লাব, সমিতি ইত্যাদি। এরা এসবের নেতৃত্বে থাকেন অথবা থাকবার চেষ্টা করেন।
পুরাতন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত জনদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ, উপহার গ্রহণ, পদক গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সামাজিক কাজের মধ্যে লেগে থাকেন। নেতৃত্বে থাকা বা গা ভাসিয়ে থাকা লোকজন ভাবতে থাকেন আমার ছিলাম এবং আছি।
আবার প্রবীণদের একটি অংশ লেখালেখি করে, টেলিভিশনে কথা বলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। আরো কয়েকটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রবীণদের অধিকার আদায়ের জন্যে একটা চেষ্টা জারি রেখেছেন। তাদের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো জনসাধারণের কাছে তেমন দৃশ্যমান নয়।
ব্যক্তিগত সকল অর্জন সামাজিক কাজে ব্যবহার না হলে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা খুবই কঠিন। শুধু দান খয়রাত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে মনোযোগ পাওয়া কঠিন। মানুষের মনোযোগ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান, সমর্থন পেতে হলে ব্যক্তিগত সকল অর্জনকে সামাজিক কাজের সাথে একত্রিত করে সামাজিক অর্জন ত্বরান্বিত করতে হবে। সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত থাকা মানে সমাজের অন্যায় অবিচারকে চ্যালেঞ্জ করা।
শুধু কথা বলে, পত্রিকায় লিখে, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে এবং সভা-সমাবেশে সেমিনারে দুটো ভালো ভালো কথা বলতে পারলেই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারা কঠিন।