বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

বার্ধক্য মোকাবিলায় ব্যক্তির ভূমিকা
অনলাইন ডেস্ক

বার্ধক্য নিয়ে কোনো কথা উঠলেই একদল মানুষ বলতে শুরু করেন, ‘আমাদের দেশে প্রবীণদের কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। বিদেশে প্রবীণরা অনেক সুযোগ সুবিধা পায়। তারা সম্মান-মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সুযোগ সুবিধা আছে।’

আরেক দল বলেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ হারিয়েছে। তারা এখন বাবা-মা’র খোঁজ খবর রাখে না। সেবা-যত্ন তো দূরের কথা, পারলে সহায় সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে যায়।’

উপরের কথাগুলোর সত্যতা রয়েছে। বার্ধক্য মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সরকারের অবশ্যই ভূমিকা থাকবে। সন্তান সন্তুতিরাও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের ভূমিকা নিয়ে আমরা মোটামুটি সোচ্চার। রাষ্ট্র কী দিল, কী দিলো না, কী দিতে পারতো, কবে আর দিবে-এমন কথা হরহামেশাই শুনতে পাই। বার্ধক্য মোকাবিলায় ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচনা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে এই আলোচনা তোলাই যায় না। বার্ধক্যে প্রবেশ করে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সময় ব্যক্তির যাপিত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সব প্রশ্ন ওঠার সাথে সাথে বার্ধক্যকে স্বস্তিদায়ক শান্তিপূর্ণ করার জন্যে ব্যক্তির দায়বদ্ধতা সামনে চলে আসবে। আপনি যখন আঙ্গুল তুলে অন্যের দায় দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন, তখনই কেউ না কেউ আপনার দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আপনি যৌবনে বার্ধক্যকে গুরুত্বহীন বিষয় হিসেবে দেখেছেন, নির্ভর করেছেন নিয়তির ওপর। এখন সরকার কী করলো না করলো তা নিয়ে শোরগোল তুলে কী লাভ? সরকার প্রবীণদের জন্যে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা সহ ৮টি প্রবীণ নিবাস তৈরি করেছিল। সেখানে থাকার লোকজন না পাওয়ার কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

একদল মানুষ মনে করেন, প্রবীণের শুধু ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা থাকলেই চলবে। সংকট নিরসনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমগুলো প্রায় খালি পড়ে আছে। বৃদ্ধাশ্রম বানানোর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বার্থ লুকিয়ে থাকে, যা বাইরে থেকে একজন সাধারণ মানুষের নজরে আসবে না।

আমাদের প্রবীণরা মূলতঃ চেনাজানা পরিচিত পরিবেশে, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে জীবনের শেষ দিনগুলোতে থাকতে চান। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে বৃদ্ধাশ্রমকেন্দ্রিক ভাবনা অসার-সেটা প্রমাণিত হয়েছে।

সব সরকার করে দিবে, ভাতা বেশি দিবে, যানবাহনে যাতায়াত ভাড়া অর্ধেক হবে, চিকিৎসা সেবা, ওষুধ ফ্রী পাবে-তবেই আমাদের মন ভরবে। এমন প্রত্যাশা করলে পাল্টা প্রশ্ন উঠবে, আপনারা কতো মানুষ ভ্যাট, ট্যাক্স দেন? কতজন অফিস আদালতে স্পীড মানি ছাড়া কাজ করেন? দাপ্তরিক কাজ ঠিক মতো করেন? সঠিক দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছেন?

উন্নত দেশগুলো জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত ভ্যাট, ট্যাক্স থেকে বার্ধক্য ভাতা, চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। যৌবনে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন না নিলে, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ না পেলে, ছেলেমেয়েদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে, সহায় সম্পদ না থাকলে বার্ধক্য সামাল দেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। বার্ধক্যে উপনীত হয়ে প্রবীণদের জন্যে সুযোগ সুবিধার দাবি জানানোর আগে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে একবার ভেবে নিন প্লিজ!

এদেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষরা সবসময় চোখে আঙ্গুল দিয়ে ন্যায়-অন্যায় দেখিয়ে দেন। আবার কেউ পয়সা পেলে, সুবিধা পেলে সকল ধরনের অন্যায় অবিচার নিরবে সয়ে যেতে পারেন। বার্ধক্যে সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত অসহায় অক্ষম প্রবীণদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়।

রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কৃষক, শ্রমিক, সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কথা আগে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা সবার জন্যে সমান হবে নাকি সুবিধা বঞ্চিত অসহায় অক্ষম প্রবীণদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে সেটা আইন প্রণেতা ঠিক করে দিবেন।

গ্রামে প্রবাদ আছে, খায় মানুষের ক্ষুধা বেশি, পিন্ধে মানুষের শোক বেশি। সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষদের চাওয়া পাওয়া খানিকটা বেশি হয়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা চাওয়া পাওয়া নিয়ে বলতে তেমন একটা সুযোগ পান না। তাদের পক্ষ হয়ে যারা কথা বলেন, তারাও শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারেন না। মানুষের জীবনে প্রধান তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপ শিক্ষা, দ্বিতীয় ধাপ কর্ম, তৃতীয় ধাপ অবসর। মানুষ শিক্ষা এবং কর্ম নিয়ে যতখানি চিন্তা করে, গুরুত্ব দেয়, অবসর নিয়ে ততখানি গুরুত্ব দেয় না। অবসর জীবন কেমন করে কাটাবেন সেই পরিকল্পনা করার মতো মন মানসিকতা আমাদের অনেকেরই নেই। অথচ জীবনের শেষ ধাপ অবসরে থাকে নানান রকমের চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রস্তুতি খুবই সামান্য। শরীরকে সক্ষম/ফিট রাখতে হবে। মাদকমুক্ত জীবনের চর্চা করতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আয়ের শতকরা দশ ভাগ নিজের জন্যে সঞ্চয় করতে হবে। সহায় সম্পদ আবেগের বশবর্তী হয়ে দান, হেবা, উইল করে কাউকে দেয়া যাবে না। কাউকে মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। নিজেকে ভালো বাসুন, নিজের সাথে থাকুন। নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করুন। একা থাকার অভ্যাস গড়ে তুলুন। নিজেকে রোগমুক্ত রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সন্তানকে শিক্ষিত এবং নিজের দায়িত্ব নেবার মতো যোগ্য করে তুলুন। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় কাতর হলে লাভ হবে না। নিজেকে ঝুঁকিতে রেখে কারো ঝুঁকি নিবেন না। প্রত্যেকের লড়াই-সংগ্রামে সহায়তা করুন সতর্কতা অবলম্বন করে।

***

প্রবীণের দাম্পত্য সংকট

দাম্পত্য সংকট কবে থেকে শুরু হয়েছে তা হয়তো অনুমান করে বলা যাবে, কিন্তু কবে শেষ হবে সেটা বলা সম্ভব নয়। দাম্পত্য সংকট একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সংকট দেখে অনুমান করে কথা বলা মোটেও সংগত হবে না। দাম্পত্য শুরু হয় পরস্পর বিপরীত চিন্তা-চেতনা, রুচি সংস্কৃতি সম্পন্ন দুজন মানুষকে কেন্দ্র করে। দাম্পত্য শুরু করার আগে দুজনের জানাশোনা, প্রেমণ্ডভালোবাসার মানে হলো একে অপরকে জানা-বোঝা। ভবিষ্যতে এই মানুষটির সাথে বিছানা, টয়লেট, সাবান, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, স্যাম্পু, বডি লোশান ভাগাভাগি করা যাবে কিনা তার পূর্ব প্রস্তুতি। শপিং করার মধ্য দিয়ে অনুমান করা যায়, বৌয়ের জন্যে কতখানি খরচ করার মন আছে। রেস্টুরেন্টে খাবার, বেড়াতে যাবার মধ্য দিয়ে সঙ্গী আঁচ করতে পারে ভবিষ্যতকে কতটা দিল দরিয়া হবে। এসব মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনুত্তীর্ণরা নিচু স্বরে বিরহের গান শুনে অথবা কবিতা লিখতে বসে।

দাম্পত্য জীবন শুরুর আগে দুপক্ষই জেতার জন্য চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে। নিজে জিতে যাচ্ছে মনে হলে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে যিনি ঠকে গেছেন মনে করেন, তিনি সময়ে অসময়ে রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।

দাম্পত্য জীবনে মানুষ পেতে চায় নিরাপত্তা, বিশ্বস্ত সঙ্গী, সন্তান ও যৌনতা। সমাজ গড়ে উঠেছে পুরুষের নেতৃত্বে। ফলে সহায় সম্পদের অধিকাংশই পুরুষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দিন দিন নারীরা এগিয়ে আসছে। পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীরা সমান তালে চলছে। একদা দাম্পত্যে পুরুষের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। এখন নারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে চূড়ান্ত কিনা সেই বিতর্ক চলছে। সমাজের পরিবর্তন বোঝার জন্যে এটা একটা টুলস্ হতে পারে।

সমাজ বিকাশের একটা সময়ে দাম্পত্য জীবনে নারী সন্তান পালন, রান্নাবান্না, গৃহস্থালি কাজ, হাঁস-মুরগি পালন, ফসল উৎপাদন, কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে। এখন নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, কলকারখানা, বিচার, বাণিজ্য, চিকিৎসা, প্রশাসন, পুলিশ সহ প্রায় সবক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নারীর আর্থিক সামর্থ্য অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি।

প্রবীণের দাম্পত্য জীবনে পাঁচটা সংকট আমরা সাধারণত দেখতে পাই। যথা-- মন, শরীর, পরিবার, পরকীয়া ও পরিবেশ।

দাম্পত্য জীবনে মন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন থেকে কেউ কাউকে পছন্দ না করলে, ভালো না বাসলে তার সাথে দাম্পত্য কঠিন হয়ে পড়ে। মনে তিক্ততা বাড়লে ঝগড়াঝাটি থামতে চায় না। আচরণগত ত্রুটি, বিরক্ত করা, গালি দেয়া, খোঁটা দেয়া, সন্দেহের তালিকায় রাখা, বিশ্বাস না করার মধ্য দিয়ে মন বিষিয়ে উঠে।

দাম্পত্য জীবনে শরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শরীর সুস্থ না থাকলে মন খারাপ হয়ে যায়। শরীর সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে সুষম খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম জরুরি। সময়মত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। নিয়মিত যৌন সম্পর্ক স্থাপনে শরীর-মন ভালো থাকে। যে কোনো ধরনের যৌন বিকৃতি সংকট বাড়িয়ে তোলে।

দাম্পত্য জীবনে কোনো একজন বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবা, যত্ন, চিকিৎসায় বিরক্তি চলে আসে। পরিবারের সদস্যদের আচার আচরণ, স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা, প্রতারণা, অকৃতজ্ঞতা দাম্পত্য জীবনে নানান রকমের সংকট তৈরি করে। সমস্যা সরাসরি স্বামী-স্ত্রীর না হলেও দুজনেই ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে যান।

পরকীয়া মানে নিজের স্বামী-স্ত্রীর বাইরে অন্য কোনো নর নারীর সাথে শারীরিক বা মানসিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া। এতে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অনেক সময় এসব অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার সত্যতা পাওয়া গেলে সারাজীবন ধরে এর জের টানতে টানতে জীবন কাহিল হয়ে যায়।

একজন মানুষের বিশের অধিক চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে। সঙ্গীর কাছ থেকে বড় জোর চার-পাঁচটা চাহিদা পূরণ হওয়া সম্ভব। বাকি চাহিদা যৌথ জীবন, আড্ডা বা অন্য কোনো উপায়ে মেটানোর চেষ্টা করে। কারো গান শুনতে, গান গাইতে, ছবি আঁকতে, বেড়াতে, বই পড়তে, সিনেমা- নাটক দেখতে, আড্ডা দিতে, গল্প করতে পছন্দ। আবার কেউ মাছ ধরতে, বড়শি বাইতে, ঘুড়ি উড়াতে, সাইকেল চালাতে, ফুটবল খেলতে, তাস-দাবা খেলতে পছন্দ করতে পারেন। অন্যজন এসব বিষয়ে অনাগ্রহী হতে পারেন।

কোনো একজন মানুষের বিশেষ কোনো গুণ অন্য কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। এমনকি সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতে পারে। কোনো কোনো সময় সেটা সীমা লঙ্ঘন করতে পারে। আমাদের সমাজে নরনারীর সম্পর্ককে সহজ স্বাভাবিক ভাবে দেখার মনোভাব তৈরি হয়নি। নরনারীর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত শারীরিক স্তরে নিয়ে যায়। এই বিশ্বাসই প্রধান। সম্পর্ক মানেই শারীরিক এমন চিন্তা ভাবনা মানব মর্যাদাবিরুদ্ধ।

দাম্পত্য জীবনে পরিবেশ বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। পরিবেশ মানে থাকার জায়গা পছন্দ মতো। বাসা খোলা মেলা, আলো বাতাস চলাচল করতে পারে, বাড়ি ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, প্রতিবেশীরা ভালো, পরিবারের সদস্যরা আন্তরিক হওয়া মানে ভালো পরিবেশ।

চিৎকার, চেঁচামেচি, হট্টগোল, ঝগড়াঝাটি, মাইকের আওয়াজ, গ-গোল, মারপিট, চাঁদাবাজি, রাস্তাঘাট ভাঙ্গাচুরা, জলাবদ্ধতায় কোনো একজন বসবাস করতে না চাইলে অন্যজন এতে সমর্থন না করলে সংকট বাড়ে।

প্রবীণ বয়সে অনেকেরই দাম্পত্য থাকে না, থাকে দায়বদ্ধতা। সেই দায়বদ্ধতাকে গভীর প্রেম বলে চালিয়ে দেয়া আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। দাম্পত্য মানে শারীরিক ও মানসিক সম্পর্ক। এই দুটির একটি অনুপস্থিত থাকলে দাম্পত্য থাকে না। উপায়হীন প্রবীণ নরনারীর একত্রে একঘরে বসবাস করাকে মহিমান্বিত করে কেউ কেউ আত্মতুষ্টি লাভ করতে পারেন। একসাথে বসবাস করলে একজনের আরেকজনের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যবোধ জন্মায়--সেটা অনেকে দাম্পত্য বলে ভুল করে।

প্রবীণের দাম্পত্য সংকট শুরু হলে দেখা যায়, আলাদা বিছানা, আলাদা ঘর, আলাদা বাড়িতে বসবাস। কথা বন্ধ থাকে বছরের পর বছর। একে অপরকে শারীরিকভাবে আঘাত করে। অন্য কোথাও চলে যায়। নারীরা মেয়ের বাড়ি বেশি সময় ধরে থাকে কিংবা বিদেশে বেবি সিটিং করতে চলে যায়।

দাম্পত্য সংকট কাটাতে চাইলে সম্পর্কের যত্ন নিতে হবে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। প্রবীণ বয়সে এসব করা কঠিন।

***

প্রবীণের বাকি খাতা

আমাদের দেশের অনেক মানুষই শৈশব কৈশোরে সীমাহীন অভাব অনটন মোকাবিলা করে যৌবনে পদার্পণ করেছে। ভাত কাপড়ের অভাবে থাকা মানুষের পক্ষে শখের জিনিসপত্র কেনা কিংবা একটু আরাম আয়েশে থাকা স্বপ্নের মতো। শৈশব কৈশোরে শখ আহ্লাদ পূরণ না হবার কষ্ট সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়।

কেউ কেউ ভবিষ্যতে ভয়ংকর বিপদে পড়তে পারে এই আশংকায় ভোগ সীমিত করে সঞ্চয়ে উৎসাহিত হয়। অতি লোভ বা অতি মুনাফার আশায় অন্যের হাতে সঞ্চয় তুলে দিয়ে নিঃস্ব হতে দেখা যায়। কিছু মানুষ আছেন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বর্তমানকে সংকুচিত করে ফেলেন। ভালো জামা জুতা, চশমা, ঘড়ি, মোবাইল ফোন ল্যাপটপ কিনতে চান না। ভবিষ্যতের ভয় সারাক্ষণ অস্থির করে রাখে। আরেক দল মানুষ আছেন যারা জন্মসূত্রে কৃপণ। তারা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতে রাজি হয় না। বুদ্ধি খাটিয়ে কৌশলে অন্যের ওপর দিয়ে চালিয়ে যান। যেসব সামাজিক কাজে টাকা পয়সা খরচ হবে সেসব কাজে অংশগ্রহণে অনীহা দেখা দেয়। চাঁদা, অনুদান দিতে হলে চুপ করে যাবার একদল মানুষ রয়েছেন। বন্ধু বান্ধবদের সাথে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলে খরচ বহন করার ক্ষেত্রে উদাসীন হয়ে পড়েন। কিছু মানুষ আছেন কোনো কিছু উপহার পেলে তা ব্যবহার না করে তুলে রাখেন। ঈদে, বৈশাখে, পূজায় প্রাপ্ত উপহার বছরের পর বছর আলমারিতে তোলা থাকে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব খাবার পাঠালে পরে খাবে কিংবা অল্প খাবে, বাকি খাবার ফ্রিজে তুলে রাখেন। অনেক সময় ফ্রিজের খাবার নষ্ট হয়ে যায়, তবু কাউকে দিতে চান না। মাঝে মধ্যে এসব পুরানো খাবার অতিথিদের ভাগ্যে জোটে। যৌবনে কেউ কেউ নিজেকে, পরিবার পরিজনকে বঞ্চিত করে টাকা পয়সা সঞ্চয় করে দালান কোঠা, জমিজমা, বিষয় আশয়, সহায় সম্পদ করেছেন। নিজের এবং পরিবারের চাওয়া পাওয়াগুলোকে গুরুত্বহীন করে রেখেছেন। কোথাও বেড়াতে যাননি, ভালো কাপড় চোপড় কিনেন নি, অলংকার কিনেন নি, ভালো খাবার খাননি। সবকিছু ভবিষ্যতে করবেন বলে জমা রেখেছেন।

সাধের যৌবনকে কষ্ট দিয়ে, বঞ্চিত করে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে ভাবছেন এখন আর এসব করে কী লাভ।

মানুষের আশংকার শতকরা পাঁচ ভাগ বাস্তবে ঘটতে দেখা যায় না। তবু আমরা অজানা আশংকায় ভীত হয়ে থাকি। কোন্ সময়ে যে বিপদ আসে সেই আতংকে সময় কাটে।

জীবনে লড়াই সংগ্রাম, সুখ দুঃখ, উত্থান পতন খুব স্বাভাবিক বিষয়। এসব মোকাবিলা করেই জীবনকে উপভোগ করতে হবে। যে বয়সে যে চাহিদা সেটা সেই বয়সে পূরণ করতে হবে। ছোট বয়সে রঙিন বেলুন, খেলনা, গাড়ি, পুতুল , মেলা, নাগরদোলা, সার্কাস, বিনোদন কেন্দ্র যত আকর্ষণীয় হয়, বড় বয়সে সেটার আবেদন তেমন একটা থাকে না। শিক্ষা জীবনে কাপড় চোপড়, জামা জুতা, চশমা, ঘড়ি, আংটি, চেইন, মোবাইল ফোনের যে পরিমাণ চাহিদা থাকে কর্মজীবনে সে পরিমাণ চাহিদা থাকে না। আবার কর্মজীবনে পোশাক আাশাকের যে পরিমাণ চাহিদা থাকে প্রবীণ বয়সে এসে চাহিদা তেমন থাকে না। কম বয়সে নানান রকমের খাবারের প্রতি আকর্ষণ থাকে, তখন তাকে সেসব খাবার খেতে দেয়া ভালো, যদি সামর্থ্য থাকে। শিশুর বেড়ে ওঠার সময় মানসম্পন্ন খাবার দাবার প্রয়োজন। তখন কৃপণতা করে কম মানসম্পন্ন খাবার দাবার দেয়া হয়। এতে শিশু মেধাবী ও সুস্থ্ ওঠার সম্ভাবনা কমে যাবে। যৌবনে দেশ বিদেশ ঘোরার শক্তি-সাহস-সামর্থ্য থাকে। সেই বয়সে না ঘুরে বার্ধক্যের জন্য জমা রাখা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় না। বার্ধক্যে টাকা পয়সা থাকলেও ঘুরে বেড়াবার মানসিক ও শারীরিক শক্তি কমে যায়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শারীরিক চাহিদা পূরণে বিয়ে একমাত্র বৈধ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। কিশোর কিশোরীরা যৌবনে পদার্পণ করে শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য আকুল হয়ে উঠে। তখন তাদের বলা হয়, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে শাদী করতে। কেউ এই অনুশাসন অমান্য করে বিয়ে করলে তার দুর্ভোগ-দুর্গতির সীমা থাকে না। যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করেন, তারা প্রায়ই ত্রিশের আশেপাশে বয়স নিয়ে যান। নারীর চল্লিশ বছর বয়সে এসে মেনোপজের আভাস পাওয়া যায়। মূলত ২০ থেকে ৩০বছর বয়সই সন্তান জন্মদানের উপযুক্ত সময়। সেই বয়সে আমাদের তরুণ তরুণীরা লেখাপড়া ক্যারিয়ার নিয়ে থাকে ভীষণ ব্যস্ত। যৌবনের দাবি উপেক্ষা করে আমাদের অর্জন খুবই সামান্য।

চানক্য প্রবাদ আছে, ঋণ করে হলেও ঘি খাও! জীবনকে সীমানা দিয়ে, আরোপিত নিয়ম কানুন পালনে বাধ্য করে, জীবনের চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্বহীন করে জীবনকে মহিমান্বিত করা যায় না। বাকির খাতা শূন্য রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

***

নিম্নবিত্ত প্রবীণ পুরুষের চ্যালেঞ্জ

নিম্নবিত্ত প্রবীণ পুরুষ মানে যাদের ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসার জন্যে লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়। বাংলাদেশে ২০২২ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী এক কোটি ছাপ্পান্ন লাখ ব্যক্তি প্রবীণ। এদের বড় একটি অংশ দরিদ্র। সরকার প্রায় ৫৭ লাখ প্রবীণকে বয়স্ক ভাতা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রবীণকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা হবে।

নিম্নবিত্ত প্রবীণ পুরুষ জন্মের শুরুতেই পুষ্টিহীনতার শিকার হয়ে মায়ের গর্ভে আশ্রয় পেয়েছিলেন। জন্মের পর থেকে অপুষ্টিতে ভুগতে ভুগতে যৌবনে পা দিয়েছেন। যৌবনে পা দেয়ার আগেই কেউ কেউ আয় রোজগারের পথে নেমেছে। যৌবনে উপস্থিত হয়ে কৃষিতে, কলকারখানায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসা বাণিজ্যে, গার্মেন্টসে, প্রবাসে শ্রম বিক্রি করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করেছেন। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বাবা-মার দেখাশোনা, ভাই-বোনদের বিয়ে-শাদী, ছেলেমেয়েদের চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্যে সহায়তা করতে করতে যৌবনে টান পড়ে যায়। যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে উপস্থিত হয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। শরীরে নানা ধরনের রোগব্যাধি বাসা বাঁধতে থাকে। চলাফেরায়, কাজে কর্মে গতি কমে যায়। উপায়হীন নিম্নবিত্ত প্রবীণ পুরুষকে জীবন ধারণের জন্যে কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত হতে হয়।

রিকশাচালক, ভ্যান চালক, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, ধোপা, নাপিত, পরিবহন শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, দর্জি, রং মিস্ত্রি, গাড়ির চালক, নৌকার মাঝি, কেয়ারটেকার, মাছ-তরকারি বিক্রেতা, হোটেল শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দারোয়ান, পিয়ন হিসেবে কাজ করতে দেখা যায়। ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা না পেয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। যারা কায়িক পরিশ্রম করতে পারেন না, তারা ভিক্ষা করে, চেয়ে চিন্তে, দান অনুদান গ্রহণ করে, কৃপায় দয়ায় জীবনধারণ করেন। প্রকৃত পক্ষে তাদের ছেলেমেয়েদের আর্থিক সংকট হয় তীব্র, ফলে বাবা-মার খরচ চালানো খুব মুশকিল। বরং কোনো কোনো প্রবীণ ভিক্ষা করে, চেয়ে চিন্তে ছেলেমেয়ের সংসারে দেন।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক প্রবীণ পুরুষের আয়-রোজগার তুলনামূলকভাবে বেশি। তারা সহজেই সাহায্য প্রার্থী হিসেবে দাতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন। তাদের আয়-রোজগারের একটা অংশ পরিবারের সদস্যদের জন্যে পাঠাতে হয়। নিজের চিকিৎসা সেবা ও ভালো লাগার জন্যে খরচ করতে পারেন না। শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ পুরুষরা একসাথে ভিক্ষা করতে নামেন। একসাথে সুর করে গান গেয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে একজন সহকারী নিয়োগ দেন। তার কাজ হলো হুইল চেয়ার ঠেলা, লাঠি ধরে হাঁটা, ভিক্ষা সংগ্রহ, পথ চলতে সহায়তা করা, গোসল গা ধুয়ে দেয়া, খাবার খাইয়ে দেয়া, হাত মুখ ধুয়ে দেয়া, টয়লেটে যেতে সাহায্য করা। আবার কেউ কেউ বিয়ে করে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যান। বড় বিল্ডিংয়ের নিচে, ফুটপাতে, বাস-লঞ্চ টার্মিনালে বসবাস করেন।

নিম্নবিত্ত প্রবীণ পুরুষের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রবীণ নিবাস কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করেন। বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত কেউ কেউ পরিবার পরিজনের সাথে রাগ করে আসেন, আবার কখনো ছেলেমেয়েরা দিয়ে যান। রাগ কমলে ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যান। আবার কেউ সরকারের দেয়া ঘর-বাড়িতে বসবাস করেন। সেখানে থেকে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে জীবনযাপন করছেন।

শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম প্রবীণদের দুর্দশার শেষ নেই। সরকার অহায় প্রবীণদের জন্যে ৮৫টি শিশু পরিবারে ১০জন করে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ভবিষ্যতে সার্বজনীন পেনশন চালু হলে আর্থিক সংকট কাটিয়ে স্বস্তিময় শান্তিপূর্ণ বার্ধক্য পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

নিম্নবিত্ত প্রবীণের রক্ত ঘামে আমাদের রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট, দালানকোঠা, অফিস আদালত, কলকারখানা, কৃষি মৎস্য সচল ছিল। দেশের উন্নয়নে তাদের অবদান আছে। তাদের বার্ধক্য সম্মান, মর্যাদার সাথে উপভোগ করার সুযোগ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরি করতে হবে। নিম্নবিত্ত প্রবীণের প্রতি অবহেলা হবে আত্মঘাতী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়