প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
নানা কারণে মানুষ ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘরবন্দী জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। ঘরবন্দী জীবন কতটা কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরা সবচাইতে বেশি জানে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাবার ফলে দীর্ঘ জীবন লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ জীবনে মানুষ নানান রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পূর্ব প্রস্তুতি গুটিকয়েক মানুষের আছে। বাকিরা নিয়তি কিংবা সহায় সম্পদ, টাকা পয়সার ওপর নির্ভর করে। কেউ কেউ ছেলেমেয়ে পরিবার পরিজনের আশায় থাকে। দিন দিন পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে যে, বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ ব্যক্তির একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হবে না।
পরিবারের সদস্যরা কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকায় প্রবীণের সেবা-যত্ন, দেখাশোনা ঠিক মতো হচ্ছে না। সন্তানের ভরসায় প্রবীণ জীবনযাপনের স্বপ্ন বাস্তবে অনেক কঠিন। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৮ থেকে ৫০ লাখ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধিতার ধরণ গুলো হলো : শারীরিক, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতা, অটিজম, দৃষ্টি, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম ইত্যাদি। এই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দিতে হয়। প্রতিবন্ধী মানুষরা বেঁচে থাকলে একদিন প্রবীণ হবেন, কিন্তু তাঁদের পরিবার পরিজন ভীষণভাবে চিন্তিত। সরকার প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করছে। যাতে করে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হয়। দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রতিবন্ধীর সেবা-যত্ন ঠিকঠাক ভাবে করতে না পারার অনুশোচনায় ভোগে। কিছু কিছু মানুষ প্রতিবন্ধী মানুষকে অভিশপ্ত বলে মনে করেন। তাঁদের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কেউ কেউ উপহাস, হাসিঠাট্টা পর্যন্ত করতে দেখা যায়। দীর্ঘ জীবনের একটি অংশ প্রবীণ জীবন। সেই জীবনের ভাবনা প্রস্তুতি খুব কম মানুষের মধ্যেই আছে। জীবনের যে কোনো সময়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে গেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রস্তুতি ছাড়া প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অসভ্যতা। প্রকৃতি আমাদের শিখিয়েছে প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হয়। প্রবীণ জীবনে নানান ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জীবন অর্থবহ করা, সুখী করা অতীব জরুরি।
প্রবীণ বয়সে মানুষের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ কমে যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্বল অংশগ্রহণের ফলে পরিবারে, সমাজে গুরুত্ব অনেকখানি কমে যায়। ঘরের বাইরে বেরুনোর প্রয়োজনীয়তা তেমন একটা থাকে না। ধর্মীয় বিধি বিধান পালনে মনোযোগী হয়ে উঠেন। কারো কারো ঘুমের সমস্যা শুরু হয়। সারা রাতে একটুও ঘুম হবে না, আবার দিনের বেলায় হয়তো একটু ঘুমিয়ে নিবে। কেউ সকালের দিকে আবার কেউ দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। অসুস্থতার জন্যে কেউ টুল, টেবিল, চেয়ার, সোফায় বসে ঝিমিয়ে সময় পার করে। অবহেলা, অসম্মান, অমর্যাদা প্রবীণকে বাইরে বেরুতে নিরুৎসাহিত করে।
শারীরিক সীমাবদ্ধতা বাড়তে থাকলে বাইরে যাবার আগ্রহ কমতে থাকে। পুরুষদের বাইরে যাবার কিছুটা সুযোগ থাকলেও নারীর বাইরে যাবার সুযোগ নেই বললেই চলে। পায়ে, হাঁটুতে কোমরে ব্যথা থাকায় বাইরে চলাচল সীমিত হয়ে যায়। কেউ কেউ পায়খানা প্রস্রাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না, ফলে বাইরে যাবার আগ্রহ থাকে না। যারা হুইল চেয়ারে আছেন তারা সহকারীর অভাবে ইচ্ছে অনুযায়ী বাইরে যেতে পারেন না। যেসব প্রবীণ আলঝাইমার্স , ডিমেনশিয়া, পারকিনসন্স রোগে ভোগেন তাদের পরিবারের সদস্যরা বাইরে একা যেতে দেন না।
ঘরবন্দী প্রবীণের কষ্ট লাঘবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা সাহায্য সহযোগিতা সমর্থন পেলে ঘর থেকে বেরুতে পারবেন, তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে আসতে হবে। এতে সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে প্রবীণের মনোবল চাঙ্গা করা যাবে। সম্ভব হলে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বাসা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসলে প্রবীণ শান্তি পাবেন। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, বিয়ে, মেজবান, গায়ে হলুদ, বৌভাত, কুলখানি ইত্যাদিতে পরিবারের লোকজনের সঙ্গ উপভোগ করার সুযোগ পান। বিশেষ করে নিকটতম আত্মীয় স্বজনের সান্নিধ্যে প্রবীণরা বেশি খুশি হন।
প্রবীণদের পছন্দের লোকজনকে অসম্মান অপমান করা যাবে না। প্রবীণ তার পছন্দের লোকজনের সাথে গল্প করতে, আড্ডা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। প্রবীণ তার পছন্দের লোকজনকে টাকা পয়সা সাহায্য করতে পারেন কিংবা অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা দিতে পারেন। সেটা নিয়ে বিরক্তি কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করে পরিবেশ ঘোলাটে করা ঠিক হবে না। যতটা সম্ভব মেনে নিতে হবে কিংবা শান্ত ভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে। মোট কথা, প্রবীণ যাতে সন্তুষ্ট থাকে, হাসি খুশি থাকে সেই ব্যবস্থা নিলে সবচেয়ে ভালো।
উপরের এই সুযোগগুলো অনেক সময়ই পরিবারের সদস্যরা তৈরি করে দিতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভার বা সেবাকর্মীরা পারবে। বেতনভুক্ত কেয়ারগিভার প্রবীণের চাহিদাগুলো বিবেচনায় নিয়ে কাজ করবে। ঘরবন্দী প্রবীণের শান্তিপূর্ণ, স্বস্তিদায়ক জীবনের জন্যে প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভারের বিকল্প নেই। পরিবারের সদস্যদের ব্যস্ততা,ঝগড়া বিবাদ, মনোমালিন্য, সেবা প্রদানে অনীহা ইত্যাদি কারণে প্রবীণ মানসম্পন্ন সেবা সংকটে পড়েন। সামর্থ্যবান পরিবারের সদস্যরা প্রবীণকে বিশেষায়িত প্রবীণ নিবাসে রাখেন, যেখানে বিশ হাজার টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হবে। চলাচলে অক্ষম ঘরবন্দী প্রবীণদের নিঃখরচায় কোনো প্রবীণ নিবাসে থাকা খাওয়ার সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। বেশির ভাগই কম পয়সায় কাজের লোকের হেফাজতে রেখে ফোনে খোঁজখবর নেন।
এখন প্রশ্ন উঠবে, সব ঘরবন্দী প্রবীণকে প্রশিক্ষিত সেবা কর্মী দিয়ে সেবা প্রদান করা সম্ভব? সবার তো সেবা মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব নয়। উত্তর হলো, অবশ্যই না।
ঘরবন্দী প্রবীণের সেবা-যত্ন, চিকিৎসা পাওয়া অধিকার রয়েছে। সেবা কর্মীর সেবা মূল্য পরিবারের সদস্যরা বহন করতে না পারলে সামাজিক সংগঠন, ক্লাব, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার, বিত্তবানরা বহন করতে পারে। বার্ধক্যের সকল দায় অসহায় ব্যক্তির ওপর কিংবা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক একটি বিষয়।
ঘরবন্দী প্রবীণদের কাছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরদের পাঠানো যায়। তারা প্রবীণের অভিজ্ঞতা শুনবে, গল্প-কবিতা-ছড়া শোনাবে। ঘরবন্দী প্রবীণ জীবনের চ্যালঞ্জগুলো সরাসরি দেখবে। শিশু-কিশোররা উপলব্ধি করতে পারবে একটি সচল শান্তিপূর্ণ বার্ধক্য কত জরুরি বিষয়।