বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

রমজানের শেষ দশক নাজাতের
অনলাইন ডেস্ক

মাহে রমজানের শেষ দশক চলছে। হাদিসের ভাষ্যমতে, আল্লাহ তায়ালা রমজানের তৃতীয় দশক দিয়েছেন বান্দার নাজাতস্বরূপ। নাজাত অর্থ মুক্তি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সাওয়াবের আশায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দীর্ঘ একমাসের সিয়াম সাধনা সম্পন্ন করবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। একইভাবে তাকে জাগতিক কষ্ট-ক্লেশ অভাব অনটন থেকেও মুক্তি দেওয়া হয়।

রমজানের তিন দশকের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার কাছে শেষাংশের সর্বাধিক মর্যাদা বলে হাদিসের উদ্ধৃতিতে উপলব্ধি করা যায়। কারণ, সমগ্র মাসের যত গুরুত্ব রয়েছে, তা মূলত শেষাংশকে কেন্দ্র করেই। পবিত্র কোরআনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে- রমজান মাস। যাতে নাজিল হয়েছে মানুষের পথপ্রদর্শক, সুস্পষ্ট প্রকাশ ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী কোরআন। মূলত পবিত্র কোরআন অবতীর্ণের কারণেই রমজান মাসের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য এত বেশি। আর তা নাজিল হয়েছে রমজানের শেষ দশকেই। শেষাংশের সপ্তম দিবসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে বলে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ রয়েছে এভাবে- আমি এ কোরআন নাজিল করেছি কদর রজনীতে। আপনি জানেন কি কদর রজনী কী? কদর রজনী হলো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ আর এ কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা চলে যে, কদর রজনীর অবস্থান রমজানের শেষ দিকে। এজন্যই রমজানের তিন দশকের মধ্যে শেষাংশের গুরুত্ব সর্বাধিক।

পৃথিবীতে একটি নিয়ম প্রচলিত আছে যে, গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় ধরনের কোনো নেয়ামত অর্জিত হলে স্মৃতিস্বরূপ সংশ্লিষ্ট তারিখে প্রতি বছর উৎসব পালন করা হয়, আনন্দ উৎসব করা হয়। আমাদের ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, শোক দিবস, নববর্ষবরণ দিবস প্রভৃতির দিকে দৃষ্টি দিলেই তা সঠিকভাবে আঁচ করা যায়। তেমনিভাবে মুসলমানদের পথপ্রদর্শক আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার এ আনন্দোৎসব পালন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মাহে রমজানকে নির্ধারণ করেছেন। এ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের কারণে মাহে রমজানের শেষ দশকের এত সুউচ্চ মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত। যা অন্য কোনো মাসের নেই।

কথা হলো, কোরআন অবতীর্ণের এ মাসে আনন্দোৎসবের জন্যে সিয়াম সাধনাকে কেন নির্দিষ্ট করা হলো? এর সহজ জবাব হলো, পৃথিবীবাসীর মঙ্গলামঙ্গলের জন্য যে ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে, ইমাম ইবনে কাসির র.-এর মতে তার প্রত্যেকটি রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। আর সকল আসমানি কিতাব অবতীর্ণ দিবসের উৎসব অতীতের উম্মতদের ওপর রোজা পালনের নির্দেশ এসেছে। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে হজরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলে করিম সা. ইরশাদ করেছেন, হজরত ইবরাহিম আ.-এর সহিফা রমজান মাসের প্রথম তারিখে নাজিল হয়েছে। ৬ রমজান তাওরাত, ১৮ রমজান ইনজিল, ১৩ রমজান যাবুর কিতাব নাজিল করা হয়েছে। আর কোরআন নাজিল হয়েছে কদর রজনীতে। আর এ জন্যেই সকল আসমানি কিতাব নাজিল দিবসে সংশ্লিষ্ট পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।’

মাহে রমজানের শেষ দশকের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল সা. বলেছেন, রমজানের একবিংশ রাতের হর্ষপ্রদ খবর হলো, রোজাদারের জন্য জান্নাতুল ফেরদাউসে একটি আলোকিত প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে।

দ্বাবিংশ রজনীর খুশির সংবাদ হলো, কেয়ামতের দিন সমস্ত চিন্তা ও বেদনা থেকে রোজাদারকে মুক্তি দেওয়া হবে।

ত্রয়োবিংশ রজনীর সুসংবাদ হলো, রোজাদারের জন্য জান্নাতে উন্নতমানের একটি শহর নির্মাণ করা হবে।

চতুর্বিংশ রাতের খোশ খবর হলো, রোজাদারের ২৪টি দোয়া কবুল করা হবে।

পঞ্চবিংশ রাতের সন্তুষ্টিকর সংবাদ হলো, রোজাদারের কবরের শাস্তি চিরদিনের জন্য মাফ করে দেওয়া হবে।

ষষ্ঠবিংশ রজনীর তৃপ্তিদায়ক সংবাদ হলো, অতিরিক্ত ৪০ বছরের ইবাদতের সমতুল্য সাওয়াব রোজাদারকে প্রদান করা হবে।

সপ্তবিংশ রাতের আনন্দজনক সংবাদ হলো, রোজাদারকে পুলসিরাত বিজলীর ন্যায় পার করিয়ে দেওয়া হবে।

অষ্টবিংশ রাতের চিত্তাকর্ষক বার্তা হলো, জান্নাতে রোজাদারের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করা হবে।

ঊনত্রিংশ রজনীর সন্তোষজনক বার্তা হলো, রোজাদারের আমলনামায় ১ হাজার মকবুল হজের সাওয়াব লেখা হবে।

ত্রিংশ রাতের বিস্ময়কর সুসংবাদ হলো, পূর্ববর্তী সমস্ত রাতের চেয়ে অধিকতর পুরস্কার ও মর্যাদা রোজাদারকে প্রদান করা হবে।

রমজান মাসের শেষ দশকের অন্যতম আমল হলো ইতিকাফ। নবি করিম সা. প্রত্যেক রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফ যে কোনো মসজিদেই হতে পারে। তবে যে সব মসজিদে নিয়মিত নামাজের জামাত হয়, সেসব মসজিদেই ইতিকাফ করা বৈধ। যেসব মসজিদে নিয়মিত জামাতে নামাজ হয় না, সেখানে ইতিকাফ জরুরি নয়। ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়াহ। প্রতিটি মসজিদে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি হিসেবে একজনও যদি ইতিকাফে বসে, তাহলে প্রত্যেকের পক্ষ হতেই তা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি আদায় না করে, তবে প্রত্যেকেই সমপর্যায়ের গুনাহগার হবে। নারীদের জন্যও ইতিকাফ করা জায়েজ। তবে সহিহ বুখারির প্রথম খণ্ড ২২নং হাদিসের আলোকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের পর নামাজের জন্যও নারীদের মসজিদে উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঘরে নামাজের নির্দিষ্ট স্থান থাকলে সেখানে তারা ইতিকাফ করবে।

দেখতে দেখতে আমরা রমজান মাসের শেষ পর্যায় চলে এসেছি। আর কয়েক দিনের মধ্যেই রোজা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে। কথা হলো, এ যে তাৎপর্য ও ফজিলতপূর্ণ রোজা আমাদের কাছে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে এসেছিল, সত্যিকারার্থেই আমরা কি রমজানের সেই ফজিলত অর্জন করতে পেরেছি? যে তাকওয়া অর্জন তথা আত্মশুদ্ধ হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা রমজান মাস উপঢৌকন হিসেবে দান করেছেন, তা কি আমরা লাভ করতে পেরেছি? আমাদের এ অসতর্কতার প্রতি ইঙ্গিত করে সজাগ করার জন্যই প্রিয়নবি সা. ইরশাদ করেছেন, যে রোজা রেখেছে, অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি, তার এ রূপক পানাহার বর্জনে আল্লাহ তায়ালার কোনো প্রয়োজন নেই। সহিহ বুখারির অন্য এক হাদিসে নবি করিম সা. ইরশাদ করেছেন, অনেক রোজাদার এমন, যাদের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকাই সার হয়েছে (অন্য কিছু তারা লাভ করতে পারেনি)। মহানবি সা. অন্যত্র বলেছেন, রোজা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ- যদি না সে নিজেই তা ছিদ্র করে দেয়। (নাসায়ী)

রমজানের শেষাংশে একদা রাসুলুল্লাহ সা. মসজিদে নববিতে খুতবাদানের উদ্দেশ্যে মিম্বরে আরোহন করছিলেন। মিম্বরের প্রথম ধাপে পা রাখতেই তিনি বলে ওঠলেন ‘আমিন’। এমনিভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে পা রেখেও তিনি ‘আমিন’ শব্দ উচ্চারণ করলেন। খুতবাশেষে যথারীতি নবি করিম সা. মিম্বর থেকে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম তাকে ঘিরে ধরে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনাকে অসংখ্যবার খুতবা দিতে দেখেছি। কিন্তু মিম্বরের ধাপে পা রেখে তো কখনও আমিন শব্দ উচ্চারণ করতে দেখিনি। আজ এ ব্যতিক্রমী ঘটনার কারণ কী? প্রিয়নবি সা. সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি খুতবাদানের উদ্দেশ্যে মিম্বরে আরোহনকালে আমার কাছে হজরত জিবরাঈল আ. এসে ভূমিকাতেই জানিয়ে দিলেন যে, ৩ ব্যক্তির ধ্বংস আল্লাহতায়ালা নিজেই কামনা করেন এবং ফেরেশতাগণও কামনা করে। আমিও যেন তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে নেই। আমি প্রথম ধাপে পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতামাতা কিংবা উভয়ের মধ্য হতে কোনো একজনকে জীবিত পেল, অথচ তাদের সেবাযত্ন করে বেহেশত অর্জন করতে পারল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। আমি আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সাথে সুর মিলিয়ে বলেছি ‘আমিন’। অর্থাৎ তাই হোক। দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি, যে রমজানের মতো একটি মাস পাওয়া সত্ত্বেও তার সকল ফজিলত অর্জন করে গুনাহরাশি মাফ করে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হয়ে যাক। আমি তাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে বলেছি ‘আমিন’। তৃতীয় ধাপে পা রাখতে জিবরাঈল জানালেন, যে ব্যক্তির সম্মুখে আমার নাম (মুহাম্মদ) উচ্চারিত হয়, অথচ সে আমার সম্মানার্থে দরূদ পাঠ করে না সেও ধ্বংস হোক। আমি বলেছি, ‘আমিন’ অর্থাৎ তাই হোক।

মূলত, যেভাবে সিয়াম সাধনার প্রয়োজন, আমরা সেভাবে পালন করছি না। আর এজন্যই আমাদের রোজাও ক্রিয়াশীল হয় না। হাদিসের উদ্ধৃতি মতে, রমজানের শেষাংশে রোজাদার ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ করে দেওয়া হয়। তাই সে ক্ষমা ও নাজাত গ্রহণের জন্য প্রতিটি রোজাদারকে আত্মপ্রত্যয়ী হতে সিয়াম সওগাত গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়