শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

তথাকথিত ভ্যালেন্টাইনস ডে, বাংলাদেশ, ইসলাম ও আমার ভাবনা

মোঃ নূর ইসলাম খান অসি

তথাকথিত ভ্যালেন্টাইনস ডে, বাংলাদেশ, ইসলাম ও আমার ভাবনা
অনলাইন ডেস্ক

প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের অগণিত দেশে ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়। আগে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস পালন করা হতো। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারির দিনে এই দিবস পালন করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্বে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ‘যায়যায়দিন’ সম্পাদক শফিক রেহমানের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও প্রচারণায় ৯০-এর দশক হতে বাংলাদেশেও ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে, যা এখন বিষফোঁড়ার মতো ভাইরাল।

ইতালির রোম শহরে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন খ্রিস্টান চিকিৎসক এবং পাদ্রি ছিলেন। তখন ইতালিতে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার নিষেধ ছিলো। কিন্তু সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ইতালির রোমান সম্রাটের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণে তৎকালীন রোমান দ্বিতীয় ক্রাডিয়াসেটের নির্দেশে তিনি বন্দি হন।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন বন্দি অবস্থায় জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেন। এর ফলে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি রাজা খুব বেশি ঈর্ষান্বিত হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে রাজা মৃত্যুদণ্ড দেন। এর অনেক দিন পর ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ‘পোপ সেন্ট জেলাসিউও’ নামে রোম রাজা প্রথম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইনস্ স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস্ ডে বা ভালোবাসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।

এর পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ভ্যালেন্টাইনস্ ডে বা ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ভালোবাসা দিবসে যে প্রেমের অভিনয় মঞ্চস্থ হয়, বাস্তবে সেটা হচ্ছে স্রেফ মোহ। ভালোবাসা কখনোই প্রথম দৃষ্টিতে হয়ে যায় না। যুগ যুগ ধরে যে মিথ্যা আপনি শিখে এসেছেন যে, ‘Love at First Sight’, সেটা কখনোই ঘটে না। কিন্তু কিছু একটা তো ঘটে! সেটা তাহলে কী? হ্যাঁ, অনেক সময়ই প্রথম দেখাতেই মন তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে কিংবা তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। এটাকে বলে, ‘Infatuation’ বা মোহ। এটা ভালোবাসা নয়।

ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে পশ্চিমা বিশ্ব ফুল, কার্ড, চকলেটসহ অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয়ের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি পাউন্ড/ডলারেরও বেশি ব্যয় করে । বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের সময় কয়েকশ’ কোটি টাকার শুধু মদ বিক্রি হয়ে থাকে। অন্যদিকে এই দিবসে খ্রিস্ট, ইহুদী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অতিরিক্ত মদপান করার প্রচলন রয়েছে। যার ফলে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে এখন এই দিবস পালন করা আইনত নিষিদ্ধ।

কিন্তু বাংলাদেশে অনেকেই এ দিনটি পালন করেন স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগঠনগুলোর ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অবৈধ সরকারের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার পূর্বঘোষিত একটি কর্মসূচি ছিলো। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ ডাকে। সেখান হতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিল সহকারে সচিবালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলটি শিক্ষা ভবনের কাছাকাছি যেতেই পুলিশ অতর্কিত গুলি করলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৩-৪ জন শিক্ষার্থী বাদে বাকি মৃতদেহগুলো গুম করে ফেলে। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নিহত শিক্ষার্থীদের আর কোনো খোঁজ পাননি। সেদিন থেকে এ দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’।

এছাড়াও বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবসের দিনে পশ্চিমা ভালোবাসা দিবসের পালনের পরিবর্তে ‘সুন্দরবন দিবস’ উপলক্ষে আপনি বৃক্ষরোপণ করতে পারেন।

পশ্চিমা অপসংস্কৃতি সারা বিশ্বে এমনভাবে প্রভাব ফেলেছে যে, তাদের উৎসবগুলো এখন আমাদের নিজের উৎসব বলে মনে হয়। ভালোবাসা প্রকাশ পাওয়া উচিত পরিবার, বন্ধু, ভাই-বোনের প্রতি। কিন্তু আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবস মানেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের একটি দিবস। ১৪ ফেব্রুয়ারি কী দিবস বলতেই মনে হয়, প্রেমিক-প্রেমিকা শুধু ঘুরবে, খাবে আর অবৈধ মেলামেশা করবে। আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবস বলতে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসারই যেন বহিঃপ্রকাশ। যা দেখা যায়, ভালোবাসা দিবসে পার্ক-হোটেল থেকে শুরু করে দেশের সকল বিনোদন কেন্দ্রে চলে প্রেমিক-প্রেমিকার অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড। এই মহোৎসবের দিনের রেশ রয়ে যায় বাকি পুরোটা বছর; চলতে থাকে বিবাহ-বিচ্ছেদ, গর্ভপাত, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুন আর শিশুহত্যার রোমহর্ষক সব কাজ-কারবার।

আমাদের বাংলাদেশে যেভাবে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়, তাতে এটি সমাজ এবং ইসলাম পরিপন্থী একটি দিবস। নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসবের দিনগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে এখন অপসংস্কৃতি নিয়ে মুসলমানরা বেজায় উৎসাহী। ভালোবাসা দিবস পালন হওয়া উচিত পরিবার এবং বৈধ সম্পর্কের মধ্যে থাকা প্রিয় মানুষদের সাথে। ইসলাম পরিপন্থী অবাধ মেলামেশার ফলে নষ্টের পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আমাদের আগামীর প্রজন্মের। ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা মানেই চারিপাশে অসামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করা নয়।

আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম মুগ্ধ হয়েছিলেন মা হাওয়া আলাইহাস সালামকে দেখে। তারপর তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। এভাবেই তো পৃথিবীর প্রথম প্রেমের সূচনা ঘটেছিল। এরই মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল পবিত্র প্রেমের। সত্যিকারের প্রেমের। যে প্রেমে নেই কোনো ক্লেদ, নেই কোনো নোংরামি। যে প্রেমের সাথে মিশে আছে আমাদের মহান রবের ভালোবাসা, তাঁর পক্ষ থেকে অবারিত রহমত। মহান আল্লাহভক্ত মুসলিমদের সত্যিকারের প্রেমেতো কোনো বারণ নেই। বরং স্ত্রীকে মন উজাড় করে ভালোবাসতেই তো শেখায় আমাদের ইসলাম। স্বামীর জন্য স্ত্রীকে উজাড় করে দিতেইতো উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম। দুজনের ভালোবাসায় সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেইতো নির্দেশনা দেয় ইসলাম। এই ভালোবাসার সম্পর্ক আর প্রেমকে বাদ দিয়ে কিসের পেছনে তবে দৌড়াচ্ছে মুসলিম যুবক-যুবতীরা ? যার পেছনে প্রাণপণ ছুটে যাচ্ছে তারা, সেটাকে কি আসলেই প্রেম বলে? সে তো চোরাবালি !

পুরুষদের উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন : ‘(হে রাসুল! আপনি) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহতাআলা সে ব্যাপারে খবর রাখেন।’- সুরা নুর : আয়াত ৩০ । আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই ছোট্ট হাদিসটির ওপর আমল করা জরুরি। যার বাস্তবায়নে তিনি মুসলিম উম্মাহকে দিয়েছেন জান্নাতের গ্যারান্টি। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের জিহ্বা ও লজ্জাস্থান হেফাজত করবে, আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’ কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা হলো, মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ে অবৈধ সংস্পর্শ, কথা-বার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ, আসক্তি ও সাজ-সজ্জা থেকে বেঁচে থাকা। নিজেদের দ্বীন ও আত্মসম্মান রক্ষা করা।

পশ্চিমা বিধর্মী গোষ্ঠী মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যেই এই ধরনের উৎসবের আয়োজন করে থাকে। যেখানে উঠতি বয়েসী ছেলে-মেয়েরা নির্দ্বিধায় বেহায়াপনায় লিপ্ত হয়, তাই ইসলাম কোনভাবেই এমন উৎসবকে প্রশ্রয় দেয় না। ‘ভালোবাসা’ শব্দটি অনেক পুতঃ-পবিত্র একটি শব্দ। তাই আমাদের উচিত শালীনতা বজায় রেখে জীবনযাপন করা। একই সাথে কোন্ দেশে কোন্ বিষয়টি অনুসরণ বা পালন করলে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য কেমন ফলাফল বয়ে আনবে সেটা অগ্রে বিবেচনা করা।

১৪ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আপনারা আরো সচেতন হন। আপনার উঠতি বয়সী সন্তানেরা ঐদিন কোথায় কার সাথে যায়, তার প্রতি নজর রাখুন। এই দিনটিতে আপনার উঠতি বয়সী সন্তানদের ঘরে রাখুন। নিজে বাঁচুন, অন্যকেও বাঁচান। মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে নোংরা ব্যবসায় মেতে আছে, আপনারা তাতে পানি ঢেলে দিন।

ভালোবাসা হোক পবিত্র, সম্পর্কগুলো গড়ে উঠুক মহান স্রষ্টা রাহমানের রহমতের ছায়াতলে। বিশুদ্ধ ভালোবাসার ঝিরঝিরে শীতলতায় জুড়িয়ে যাক আমাদের প্রাণগুলো। সত্যিকারের ভালোবাসার সুধায় মিটে যাক সব তৃষিত হৃদয়ের তৃষ্ণা। আসুন, বেলেল্লাপনাকে দূরে ঠেলি, আর মহান আল্লাহকে ভালোবাসি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সাহায্য করুন, আমাদের গুণাহতপ্ত অন্তরগুলোকে শীতলতা দান করুন। আমীন।

পাঠকগণ! বিভিন্ন উৎস হতে সাহায্য নিয়ে আমার লেখা প্রবন্ধের বক্তব্যের সাথে আপনি একমত নাও হতে পারেন। তাতো আমার কোনো দুঃখবোধ বা অভিযোগ নেই। তবে বিরূপ মন্তব্য বা গালমন্দ করে পরিবেশদূষণে সহায়তা না করার জন্য বিনীত অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ।

লেখক পরিচিতি : মোঃ নূর ইসলাম খান অসি, পরিচালক (অপারেশন), ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ঢাকা । মোবাইল ফোন : ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়