প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
![দেশে তীব্র ভূমিকম্প হলে নেমে আসবে বড় মানবিক বিপর্যয়](/assets/news_photos/2023/02/09/image-29393.jpg)
আজ থেকে ২০ বছর আগে মফস্বল শহরগুলোতে এতো দালানকোঠা ছিল না। এখন প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। রডের দামসহ দালান নির্মাণের অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলেও বহুতল ভবন নির্মাণের হার কমছে না বরং বেড়েই চলছে। শুধু মফস্বল শহরগুলোতে নয়, চাঁদপুরের সব উপজেলার গ্রামাঞ্চলে গেলে দেখা যায় কোনো না কোনো গ্রামে কেউ না কেউ বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ করছেন। বাসস্থান হিসেবে মানুষ এখন যে উন্নত চিন্তা করছে এটা নিঃসন্দেহে ভালো ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্মাণের ভিত কতোটা শক্তিশালী? নাকি খরচ কমিয়ে কোনো রকম বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ করা হচ্ছে। যদি এমন হয় তাহলে এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার স্থানীয় সময় ৪টা ১৭ মিনিটে যখন প্রায় সব মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল ঠিক তখনই এক ভয়াবহ ভূকম্পন অনুভূত হয়। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বলছে, তুরস্ক, সিরিয়া, সাইপ্রাস ও লেবানন, ইসরায়েল ও মিশরেও অনুভূত হয় ভূমিকম্প। ৭ দশমিক ৫ মাত্রার কম্পনসহ শত শত আফটারশক তুরস্কে আঘাত হানে। এই ধাক্কার ধারাবাহিকতা ২০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল দেশটিতে। আমি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এটা এক ভয়াবহ বিপর্যয়। গোটা বিশ্ব যখন যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট ও গভীর অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত তখন আরও একটি মানবিক বিপর্যয় আঘাত হানলো পৃথিবীতে। জানা যায়, ১৯৩৯ সালের পর তুরস্কে এই প্রথম এ ধরনের শক্তিশালী ভূ-কম্পন অনুভূত হলো। ইউএসজিএস আরও জানিয়েছে, সে বছরও তুরস্কে ভূ-কম্পনের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৮। তাহলে সে হিসেবে ৮৫ বছর পর তুরস্কে এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো। যার ফলাফল হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু।
বিবিসির এক সংবাদ থেকে জানা যায়, অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার এক গবেষণায় বলেছেন, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। তিনি জানান, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার।
তিনি আরো জানান, “একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা হচ্ছে আমাদের পূর্বে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি অঞ্চলে। এখানে আসলে দুইটা বড় ধরনের ভূমিকম্প আমাদের বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। উত্তর প্রান্তে যেটা ডাউকি ফল্ট এখানে সংকোচনের হার হচ্ছে প্রতি একশ বছরে এক মিটার। গত ৫শ থেকে ৬শ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো রেকর্ড নেই। তার মানে ৫-৬ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। এটা যদি আমি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করি তাহলে এটা ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। এখান থেকে ঢাকা শহর হচ্ছে দেড়শ কিলোমিটার।
আখতার সাহেব বলেন, ঢাকার মধ্যে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো ভূতাত্ত্বিক অবস্থা না থাকলেও সিলেট এবং চট্টগ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা। তাহলে ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে নিরাপদ নই আমরা। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ওইদিন সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫২ সেকেন্ডে এই কম্পন অনুভূত হয়। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে, একেবারে ভারতের কাছাকাছি। ঢাকা থেকে ৫২০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ১। এই স্কেলেই রাজধানী সহ দেশের অনেক জায়গায় মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়।
২০২২ সালে বাংলাদেশে বহুবার মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। যদিও এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃদু ভূকম্পন বড় ভূকম্পনের ইঙ্গিত বহন করে। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে হয় ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। জানা যায়, ১৯৬০ সাল থেকে দেশে ভূকম্পনের হার বেড়ে গেছে। ওই সময়ের পর থেকে বড় ধরনের ভূকম্পন না হলেও যে শক্তি জমা হচ্ছে তাতে যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা যেখানে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রেখেছেন, সেখানে আমরা কী করছি। শহরাঞ্চলে কর্মক্ষেত্র বেড়ে যাওয়ায়, ভাল মানের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গ্রাম থেকে শহরে মানুষের আধিক্য বাড়ছে। ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আবাসস্থলের। আর তাতে পুঁজি করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এই ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প কতটা সহনীয় তা হয়তো কেউ বলতে পারবে না। কোনো রকমে বিল্ডিং নির্মাণ করে রং ঢং করে ভাড়া দিয়ে টাকা গুণছে বহু মালিক পক্ষ। তবে সবাই যে এমনটা করছে তা নয়। বেশি সংখ্যকই নির্মাণের ব্যয়ভার কমিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। আবার ডেভেলপাররাও বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। কিন্তু এই বিল্ডিংগুলো কতটা ভূমিকম্প সহনীয় সেটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে না। ফলে যদি কোনো সময় দেশে তীব্র ভূকম্পন অনুভূত হয় তাহলে হয়তো বড় মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে আমাদের জন্য।
তাই ভূমিকম্প সহনীয় নিরাপদ অবকাঠামো তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন থেকে স্থানীয় সরকারের উচিত, যারা নতুন ভবন নির্মাণ করবেন সে ভবনগুলো যেন রিখটার স্কেল ৮-এর কম্পনেও টিকে থাকতে পারে তার ভিত স্থাপনে তদারকি করা। সে সাথে যে ভবনগুলো ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে তা পরীক্ষা করে দুর্বল দালানগুলো ভেঙ্গে ফেলার মতো কঠোর আইন করার দাবি জানাচ্ছি। মানুষ তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য এমন কঠোর হওয়া উচিত বলে মনে করছি। সর্বশেষ যে কোন বিপর্যয় ঠেকাতে সদা প্রস্তুত থাকার পরামর্শও জানাচ্ছি।
মু. আ. হোসাইন পাটোয়ারী (রিটন), প্রিজম কম্পিউটার সেন্টার, জোড় পুকুরপাড়, চাঁদপুর। ০১৮১৩০৩০৩০৯