প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে প্রতিনিয়ত প্রভাতে সূর্য উদিত হচ্ছে। পূর্বাকাশে আপন কিরণ বিলিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করছে। আলোর মেলায় ভেসে যাওয়া প্রতিটি দিবস শেষেই সন্ধ্যা আসছে। এভাবে জীবন সায়াহ্ন থেকে একেকটি বর্ষ বিয়োগ হয়ে তা কালের গর্ভেবিলীন হয়ে যায় এবং একটি নববর্ষের সূচনা হয়। নতুন বছর মানেই নতুন ভাবনা, নতুন পরিকল্পনা এবং নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখা। একটি বছরের পরিবর্তন মানে ক্যালেন্ডারে এক বছরের যোগ এবং আমাদের জাতীয় জীবন ও মানুষের ইহজগত থেকে একটি বছরের বিয়োগ। কালের বিবর্তনে সময়ের এই যোগ-বিয়োগ, পালা-বদল, চির-শাশ্বত, চির-বাস্তব।
সব জরাজীর্ণতাকে পিছনে ফেলে একটি নতুন বছরের সূচনা ঘটে। আর নতুন বছরের রাঙা-প্রভাতে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ২০২৩ সালকে স্বাগত জানাচ্ছে। নতুন দিনের নতুন সূর্যালোকে স্নান করে জাতি-ধর্মণ্ডবর্ণ-দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণী পেশার মানুষ সিক্ত হচ্ছে। বিগত বছরের সব গ্লানি ধুয়ে-মুছে সময়, সভ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতি এগিয়ে যাবে। আর বিগত সব ভূল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে। সময় ও কাল¯্রােতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে মানুষের পথ চলা। ইতিহাস হলো অতীতের ফেলে আসা জাগতিক চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আদর্শ ও মননশীলতার সঠিক চিত্ররূপ। অতীতের কৃতিমান ইতিহাস মানুষের জাতি-সত্তার ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণ করে। এরই চূড়ান্ত বাস্তবতা আজকের বিশ্বে চির-বাস্তবায়িত।
ইংরেজি বর্ষ গণনার রীতি আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। সেই রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের যুগে আধুনিক বর্ষ গণনার পদ্ধতি নির্ধারণ হয়। সেই যুগে যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল আজও তা সারাবিশ্বে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। এই বর্ষ গণনা পদ্ধতি মেনে নেয়া হয়েছে বলেই আজ আমাদের উদযাপন করতে হচ্ছে ইংরেজি নববর্ষ। আর তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও বেড়ে চলছে সাংস্কৃতিক ব্যাধির প্রাদূর্ভাব এবং আমাদের জাতিসত্তা ও চেতনার বিপর্যয়। আর এই ব্যাধি দু’এক বছরে ছড়িয়ে পড়েনি, বরং এর সূচনা হয়েছে বহুযুগ আগেই। উপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আনা ক্যালেন্ডার যা এদেশে এসে ইংরেজি ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত হয়।
ইংরেজরা ১৭৫৭ সারের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার শত্রু বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তিমিত করে এবং বাংলার মানুষের উপর পরাধীনতার জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দেয়। আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপরও তারা হামলা করে। এদেশে তাদের আনা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার (যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এর সংস্কার)টিও চাপিয়ে দেয়। ব্রিটিশ যেখানেই গেছে সেখানেই এটি নিয়ে গেছে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ আছে যেসব দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এর চল আভ্যন্তরীণভাবে নেই, শুধুমাত্র বৈদেশিক ক্ষেত্রে এই ক্যালেন্ডারের তারিখ ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে শহরে নাগরিক জীবনে এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার থাকলেও বৃহত্তর গ্রামীণ জীবনে এর ব্যবহার তেমন নেই বললেই চলে, আবার বাংলা সনের ব্যবহার গ্রামীণ জীবনে যেমন রয়েছে অথচ শহুরে জীবনে তেমন নেই। যদিও ১৯৮৬ সালে সরকারি ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রে ইংরেজি-বাংলা উভয় তারিখ লেখার নির্দেশ তদানীন্তন সরকার দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ব্যাপক হারে নেই। ব্যতিক্রম হিজরি সন যার ব্যবহার সারা বাংলাদেশে সমানভাবে রয়েছে, এজন্য জাতীয় পর্যায়ে চাঁদ দেখা কমিটিও রয়েছে।
ইংরেজি নববর্ষ পৃথিবীর সকল দেশেই দেশীয় সংস্কৃতি, জনগণের অনুভূতি ও আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। সকলেরই প্রত্যাশা থাকে নতুন বছরে অতীতের সব ব্যর্থতার গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে শুরু হোক জীবন, সৌভাগ্যের রাজটিকা শোভিত হোক। আর এই নববর্ষ নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে নানান সংস্কার প্রচলিত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আতশবাজি ও নাচণ্ডগানের মাঝে নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে নববর্ষকে স্বাগত জানায় উৎফুল্ল জনতা। গাড়িতে হর্ন বাজায়, বন্দরে জাহাজের সাইরেন বাজে মহাসমুদ্রে নাবিকদের যাত্রা হবে বলে। দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে মধ্যরাতে নববর্ষের প্রথম প্রহরে বাড়ির জানালা দিয়ে ঘরের নোংরা পানি বাইরে ছুঁড়ে মারে, যেন গত বছরের সকল অশুভ শক্তি বহিস্কৃত হয়। পর্তুগীজেরা রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২টি আঙ্গুর খায়। তাদের আশা আগামী ১২ মাস যে খেয়ে-পরে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারে। ইংল্যান্ডের ছেলে-মেয়েরা নববর্ষে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পাড়া-প্রতিবেশিদের বাড়িতে গান গাইতে গাইতে যায়। প্রতিবেশীরা তাদের হাতে দেয় আপেল, মুখে দেয় মিষ্টি, পকেটে ভরে দেয় পাউন্ডের চকচকে মুদ্রা। লন্ডনবাসীরা ট্রাফালগার স্কয়ারে অথবা পিকাডেলী সার্কাসে জড়ো হয়ে বিগবেনের ঘন্টা ধ্বনি শুনে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। জাপানিরাও জানুয়ারির প্রথম দিনকেই সববর্ষ হিসেবে উদযাপন করে। সবাই দোকান-পাট, কল-কারখানা ও অফিস বন্ধ রাখে এবং পরিবারের সব লোককে নিয়ে দিনটি উদযাপন করে। অপরদিকে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং চীনে নববর্ষে একে অন্যের গায়ে পানি ছুঁড়ে মারে। এই পানিতে ভিজে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আত্মশুদ্ধির অভিযান। চীন দেশের জনগণ নববর্ষে ড্রাগন ও সিংহের প্রতীক নিয়ে নাচ-গান করে। বাংলাদেশে যেমন বৈশাখের প্রথম দিনকে নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করা হয়, নানান অনুষ্ঠান, সঙ্গীত, মেলা ও মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে থাকে এবং এর মাঝে সংস্কার এর সাথে কুসংস্কারও প্রচলিত আছে। তবে ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের স্থান নেই। আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো এই নববর্ষ বা এই দিনের, এই উৎসবের আলাদা কোন মূল্য বা গুরুত্ব নেই। অন্যান্য দিন ও রাতের মতোই এর অবস্থান।
পাশ্চাত্য আজ বর্তমান বিশ্বে উৎকর্ষের চূড়ান্ত সীমানায় এবং বিশ্ব মানবতার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উন্নয়নের পথ নির্দেশনা পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রভাবিত। এই প্রভাবকে এড়িয়ে কারও পক্ষে চলা সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই তাদের এই মতাদর্শকে মেনে নিয়ে আমাদের সম্মুখপানে অগ্রসর হওয়ার চূড়ান্ত বাস্তবতা ঘটাতে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পরই নববর্ষ পালনের বাঁধভাঙা উৎসবে মেতে উঠে উৎসবকারীরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পাড়া-মহল্লায় মহাসমারোহে আনন্দ উৎসব ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিজলি বর্ষণ ও বাদ্যবাদকের শোরগোলের মধ্য দিয়েই কেটে যায় রাতের অমাবস্যা। নতুন বার্তা নিয়ে শুভ নববর্ষের সূর্য উঁকি দেয় পৃথিবীর আকাশে।
নববর্ষ উদযাপন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ইংরেজি বর্ষপঞ্জিকা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত হওয়ায় তা সকলকে প্রভাবিত করে। এই জন্য নববর্ষ আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলে প্রত্যাশা করি। বাঙালি জাতির জীবনে নববর্ষ বছরে দু’বার আসে। পহেলা বৈশাখে আসে আবহমান কাল ধরে বাংলার প্রিয় অতিথি বাংলা নববর্ষ। সেটি চতুর্দিক, শহর ও গ্রাম আন্দোলিত করে। আর গ্রেগরিয়ান তথা ইংরেজি বছর বলে পরিচিত যে নববর্ষ, সেটিও জীবন জুড়ে আসে। বাংলা মাস ও বছরের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় ও আবেগের। পক্ষান্তরে ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ন্যায় আমাদেরও সম্পর্কটি আন্তর্জাতিক এবং সব মিলিয়ে বৈষয়িক। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, যোগাযোগ প্রায় সবকিছু এখানে সম্পন্ন হয়ে থাকে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে। সেকারণেই ইংরেজি নববর্ষ বা নিউ ইয়ার আমাদের জীবনেও নানানকিছুর সূচনা, নানা আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনায় ভরপুর। আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষ যে আনন্দ বৈভব মেখে গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ কিন্তু শহুরে জীবনের কিছু মুষ্টিমেয় বিশেষ মহলে ছাড়া অন্য কোথাও আলোড়ন সৃষ্টি করে না। তবুও ইংরেজি নববর্ষ আসে গোলামীর জিঞ্জিরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। ইংরেজি ক্যালেন্ডার যেহেতু আমাদের নিত্যদিনের তারিখ নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাই এতে যতোই উপনিবেশিক গন্ধ থাকুক না কেনো, আমরা এর থেকে মুক্ত হতে পারছিনা। আর পারছিনা বলেই স্বকীয়-সত্তা সজাগ হওয়ার কথা বললেও, নিজস্ব সংস্কৃতি সমুন্নত করার কথা বললেও, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও তা যেনো কথার কথা হয়ে থাকছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডার আমাদের স্কন্ধে সিন্দাবাদের সেই দৈত্যটির মতো, সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো এমনভাবে চেপে বসে আছে, আমরা একে ছেড়ে দিতে পারছিনা। আর পারছিনা বলেইতো আমরা বলতে বাধ্য হই, ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’।
আমাদের জাতীয় জীবনে ২০২৩ সাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরকে ঘিরে দেশের প্রায় সবক’টি মহলেই বিপুল আগ্রহ ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নতুন বছরকে ঘিরে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মাঠ শোরগাল যাতে দেশে একটি কাঙ্খিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অতীতের ব্যর্থতাগুলোকে পশ্চাতে, ফেলে নতুন বছরে আমরা যেন অপূর্ণতাগুলো পূর্ণ করে নিতে পারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল পর্যায়ে সাফল্যের পথ যেন আরো প্রশস্ত হয়-এটাই কামনা। নববর্ষ প্রতিটি নাগরিকের জীবনে অনাবিল সুখ, অপার শান্তি, সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসুক। ২০২৩ সালকে জানাই স্বাগতম।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।