প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
ভোরের সূর্যোদয়ে বর্ষপরিক্রমায় শুরু হলো নতুন বছর। সময়ের পালাবদলে জীবনের সময়-সম্পদ থেকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দোলাচলে কালের আবর্তে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরো একটি বছর। স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো নতুন বছরের। ২০২৩ এর প্রথম সূর্যোদয় যাদের উপর হয়েছে, বছর শেষ হতে হতে তাদের অনেকের সময় ফুরিয়ে যাবে! ২০২৪ এর সূর্যোদয় হয়তো অনেকের দেখার সুযোগ হবে না। সত্য কী অমোঘ! ভুলে থাকা যায়, কিন্তু অতিক্রম করা যায় না। যাহোক, আজ নতুন এ বর্ষে সংক্ষেপে জেনে নেই ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস, একজন চিন্তাশীল-ভাবুক মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে।
ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস : পুরানোকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুনকে স্বাগত জানানোর যে রীতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তা-ই নববর্ষ। আমাদের দেশে সাধারণত ইংরেজি, বাংলা ও হিজরি এ তিনটি বর্ষের প্রচলন রয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানুষ প্রথমে চাঁদের হিসেবেই বর্ষ গণনা শুরু করে। কিন্তু চাঁদের হিসাবে ঋতুর সাথে কোন মিল না থাকাতে সৌর গণনার প্রয়োজন দেখা দেয়। ইংরেজি সাল সৌর গণনার সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমান পৃথিবীতে যে ইংরেজি বা খ্রিস্টীয় সাল প্রচলিত তা মূলত ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। আজ থেকে মাত্র ৪৪০ বছর পূর্বে যীশু খ্রিস্টের প্রায় ১৬০০ বৎসর পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ অষ্টম গ্রেগরী তৎকালে প্রচলিত প্রাচীন রোমান জুলিয়ান ক্যালেন্ডার (Julian calendar) সংশোধন করে যীশু খ্রিস্টের জন্মকে সাল গণনার শুরু ধরে এ পঞ্জিকা প্রচলন করেন, যা গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার (Gregorian calendar) ও খ্রিস্টীয়ান ক্যালেন্ডার (Christian calendar) নামে পরিচিত। যীশুখ্রিস্টকে প্রভু ও উপাস্য এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে এ বৎসরকে বলা হয় আন্নো ডোমিনি (anno domini) বা এ.ডি. (AD); এর অর্থ আমাদের প্রভূর বৎসরে (in the year of our Lord)।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০ অব্দের প্রথম রোমান ক্যালেন্ডারটি ছিলো চন্দ্রকেন্দ্রিক এবং এতে মাস ছিলো দশটি। তখন মেসোপটেমীয়ার (বর্তমান ইরাক) ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মার্চের ১ তারিখে নববর্ষ পালন হতো। বসন্তকালে প্রকৃতির নতুন করে জেগে ওঠাকেই তারা নতুন বছরের শুরু বলে ধরে নিত। তারা বসন্তের প্রথম চাঁদ দেখেই বছর গণনা শুরু করত, শুরু করত তাদের বর্ষবরণ উৎসব, চলত টানা ১১ দিন। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৭০০ অব্দে রোমের রাজা নুমা পন্টিলাস এই ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি নামে দু’টি মাস যুক্ত করেন। তবে এসব ক্যালেন্ডারে তারিখ না থাকায় সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে তারিখ বসিয়ে দেন। চাঁদের হিসাবে প্রতিমাসে সাড়ে ২৯ দিনে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রথমে বছরে ৩৫৫ দিন ধরা হয়। কিন্তু চাঁদের হিসাবে বছরে ১০ দিন কম হওয়াতে চাষীরা সমস্যায় পড়ে বিধায় সম্রাট জুলিয়াস সিজার নিজেই চাঁদের হিসাবের পরিবর্তে সূর্যের হিসাব করে বছরকে ৩৬৫ দিনে এনে সমস্যার সমাধান করেন।
রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা। ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিন বছর হিসাব করলে হিসাবের আর কোন গরমিল হয় না। তাই মোসাজিনিস প্রতি চতুর্থ বছরে অতিরিক্ত একদিন যুক্ত করে এ বছরটির নাম দেন ‘লিপিইয়ার’। রোমে তৎকালীন বছরের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। জানুস ছিলো তাদের সূচনার দেবতা। তার নাম অনুসারেই জানুয়ারিকে তারা বছরের প্রথম মাস হিসাবে ধরত এবং ১ জানয়ারি নববর্ষ উদযাপন করত। পরে ১৫৮২ সালে পোপ অষ্টম গ্রেগরী এই ক্যালেন্ডারকে সংস্কার করে যীশুখ্রিস্টের জন্মকে সাল গণনার শুরু ধরে পঞ্জিকার প্রচলন করেন, যা আজকের গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার (Gregorian calendar) ও খ্রিস্টিয়ান ক্যালেন্ডার (Christian calendar) তথা ইংরেজি সাল হিসাবে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসাবে এ ক্যালেন্ডারের অনুসরণ করা হয়। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে আজ আমরা উপনীত ইংরেজি ২০২৩ সালে। বিদায়ী বছরের হতাশা ও বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে ভালো কিছু প্রাপ্তির প্রত্যয় নিয়ে আমরা বরণ করে নেব নতুন এ বছরকে।
নতুন বছরে ভাবুক মনের অতীত মূল্যায়ন ও আগামীর সংকল্প : সময়ের পালাবদলে পুরানো একটি বছরকে বিদায় জানিয়ে আগমন করেছে নতুন আরেকটি বছর। নতুন বছর ঘিরে নানা জনের নানা ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে একজন চিন্তাশীল ভাবুক মানুষের ভাবনা হলো, চলে যাওয়া বছরটি শুধু একাই যায়নি, সাথে করে নিয়ে গেছে অনেক কিছুই। যা আর কখনো এ পৃথিবীর আলো-বাতাসে ফিরে আসবে না। ২০২২ এর প্রথম সূর্যোদয় যাদের উপর হয়েছে, তাদের অনেকেই আজকের সূর্যোদয় উপভোগের সুযোগ পায়নি । আবার আজকের সূর্যোদয় উপভোগকারী অনেকেই হয়তো আগামীর সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পাবে না। তাই রাত-দিনের গমনাগমন, সকাল-দুপুর-বিকেলের পরিবর্তন, সপ্তাহ-মাস-বছরের এই চক্রাকার আবর্তন; এসব কিছুই একজন মানুষকে বারবার বলে যাচ্ছে তার বেলা ফুরোবার কথা। আমাদের দেহ-মনের পরিবর্তন, আমাদের প্রিয়জনদের চলে যাওয়াও আমাদেরকে বার্তা দিচ্ছে নিজেদের বেলা ফুরোবার কথা।
তাই একটি বছরের উপসংহারে দাঁড়িয়ে একজন চিন্তাশীল ভাবুক মু’মিনের মানসপটে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, একটি বছর তো আমি শেষ করেছি; কিন্তু যে মহান উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা আমাকে এ পৃথিবীতে পাঠালেন যেমনটি তিনি কুরআনে বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার-ই ইবাদত করবে।’ (সূরা জারিয়াত-৫৬) সে পথে আমি কতটুকু অগ্রসর হয়েছি? জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য জান্নাতের দিকে কতটা এগিয়ে যেতে পেরেছি? এর জন্য কতটুকু পাথেয় সংগ্রহ করেছি? নাকি এখনো উদাসীনতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি? এজন্যে একজন ভাবুক মু’মিনের নতুন বছর আগমনের এ মুহূর্তটি উৎসবের নয়; ভাবনা ও হিসাব মেলানোর সময়। সময়-সম্পদের যে অংশ ব্যয় হয়ে গেল তা কি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে না অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর খাতে? জীবনের মূলধন (সময়) খরচ করে জীবনকে আমরা কতটুকু সমৃদ্ধ করেছি?
বস্তুত একটি বছরের বিদায় ও আগমনে প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য হলো, নিজের অতীত জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা তথা আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনার মাধ্যমে জীবনের হিসাব-নিকাশ পর্যালোচনা করা। জীবনের হালখাতা করা। যে নির্দেশ আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, সে আগামীকালের (পরকালের) জন্য কি সঞ্চয় করল। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ অবহিত। (সূরা হাশর-১৮) তাই দিবস ও রাত্রির আগমন ও নির্গমনে জীবনের হিসাব মিলানোই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বিচক্ষণ ওই ব্যক্তি যে নিজের হিসাব গ্রহণ করে এবং মৃত্যুর পরের জন্য কর্মব্যস্ত থাকে। আর অক্ষম ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে আর আল্লাহর নিকট অমূলক বাসনা পোষণ করে।’ হযরত ওমর (রাঃ) একবার মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দানের সময় শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, হে বিবেকবান মানুষ! আমি তোমাদের বিবেককে বলতে চাই-‘হিসাব চাওয়ার পূর্বেই নিজের হিসাব করে নাও, তোমার কাজ পরিমাপ করার পূর্বেই নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও।’ (সুনানে তিরমিযি)
তাই একটি বছরের বিদায় ও আরেকটি নতুন বছরের আগমনে মধ্যে মু’মিনের জন্য রয়েছে চিন্তার খোরাক। মু’মিন ভাববে, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একদিন নিভে যাবে আমার জীবনপ্রদীপ। আমি যদি সময় নামক সবচেয়ে দামি, মূল্যবান ও সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদকে উদাসীনতায়, মনোবৃত্তিপূরণ বা মিথ্যা কামনায় কেটে ফেলি, তাহলে আমি হবো ক্ষতিগ্রস্ততায় নিমজ্জিত। এজন্য নতুন বছরে একজন মু’মিনের কর্তব্য হলো, গত বছরের ভুলত্রুটি সংশোধন করে, সেগুলোর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন বছরে নির্ভুল ও পাপমুক্ত জীবনযাপনের জন্য প্রত্যয়ী হওয়া। মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া, তাঁর দিকে সমর্পিত হওয়া এবং তাকওয়ার নতুন লেবাসে নিজেকে সুসজ্জিত করা। আসুন নতুন বছরের জন্য জীবনকে নতুন করে সাজাই। হৃদয়ের বাগানে যত পাপ-পঙ্কিলতা, হিংসা, অহঙ্কার, স্বার্থপরতা, লোভ ইত্যাদির যে আগাছা জন্মেছে তা বিদায় দিয়ে হৃদয়ের বাগানকে পরিষ্কার করি। একমাত্র আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পণ করি, আল্লাহর ভালোবাসা, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ভালোবাসা, সকল মু’মিনের ভালোবাসা, সকল মানুষের ভালোবাসা এবং সকল সৃষ্টির ভালোবাসা দিয়ে হৃদয়কে সুশোভিত করি। শহীদ হাসান আল-বান্না (রহঃ)-এর দৃষ্টিতে নতুন বছর ও আগামীর সংকল্প এরূপই- ‘নতুন বছরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে বললাম, সামনের অদেখা-অস্পষ্ট দিনগুলোকে আলেকিত করার জন্য আমার বাতির প্রয়োজন। সে উত্তর দিল, তোমার হাতটি আল্লাহর কুদরতি হাতে সঁপে দাও; তিনিই তোমাকে পরম গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন।’
লেখক : প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।