প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
ইসলামে বিজয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ‘নাসর’ ও ‘ফাতহ’ নামে বিজয় শিরোনামে দুটি সুরাও রয়েছে পবিত্র কোরআনে। হাদিসেও বিজয় উদযাপনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। অসংখ্য ত্যাগ-তিতিক্ষার মহাসাগর পেরিয়েই আসে বিজয় নামক সোনার হরিণ। আর তা যদি কিনতে হয় লাখো শহিদের তাজা রক্তের বিনিময়ে, তাহলে তো সেই বিজয় অমূল্য রতন। তাই তো এ মহামূল্যবান বিজয় উদযাপনে করণীয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে নির্দেশনা এসেছে।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তখন মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করো। আর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল।’ (সুরা নাসর, আয়াত ১-৩)।
এ সুরায় বিজয় উদযাপনের দুই দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
এক. আল্লাহর প্রশংসাগাঁথায় তার পবিত্রতা বর্ণনা করা।
দুই. যুদ্ধ চলাকালে অজান্তে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
বিজয়ের আরেক রূপের ব্যাপারে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা (বিজয়) দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দান করবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।’ (সুরা হজ, আয়াত ২২)
হাদিসে বিজয় উদযাপনে তিন দফা কর্মসূচির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এক. আট রাকাত শোকরিয়ার সালাত আদায় করা। কেননা নবি করিম (সাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন শোকরিয়া স্বরূপ আট রাকাত সালাত আদায় করেছিলেন। (জাদুল মায়াদ, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওজি)
নবিজির দেখাদেখি অনেক সাহাবিও তার অনুকরণে আট রাকাত নফল সালাত আদায় করেন।
দশম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর মহানবি (সাঃ) আনন্দ উদযাপন করেছেন। বিজয়ের প্রথম আনন্দে তিনি আদায় করেছেন আট রাকাত সালাত। প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় তিনি এত বেশি খুশি হয়েছিলেন, যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা কাবাঘরে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ। এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নেবে, তারা যত অত্যাচার-নির্যাতনকারীই হোক তারাও নিরাপদ। এ ছিলো প্রিয়নবির মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা।
দুই. দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসা। স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস। বিশেষত মুসলমানদের প্রতিটি রক্তকণিকায়ই দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা।
নবি করিম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে, তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফেতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম, ১৯১৩) মহানবি (সাঃ) কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে তার চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তিনি বলতেন, ‘এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ (সহিহ বুখারি, ১০২৮)
তিন. সৎকাজে আদেশ দেয়া ও অসৎকাজে নিষেধ করা। কেননা মহানবী (সাঃ) মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাইকে সত্য ও সুন্দরের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান। এছাড়া বিজয় উদযাপনে কোরআন পাঠ, ফাতিহা পাঠ, দোয়ার মাহফিলসহ বিভিন্নভাবে ইসালে সাওয়াব করা যেতে পারে।
মহান আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন সত্তা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর তার স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বিশাল-বিস্তৃৃত পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। পরাধীনতা মানবজীবনে সবচেয়ে বড় বঞ্চনার নাম।
পৃথিবীর প্রথম মানব ও মানবী আদম (আঃ) ও হাওয়ার আবাসভূমি ছিল পৃথিবীজুড়ে। পৃথিবীর বিশাল বক্ষে তখন কোনো সীমানা চিহ্ন আঁকতে পারেনি কেউ। তারপর তাঁদের সন্তানরা পারস্পরিক স্বার্থপরতার পথ ধরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সীমানা চিহ্ন দিয়ে বিভক্ত করে ফেলেছে নিজেদের আবাসভূমি। সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্র। জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন জাতি। আর যখনই কোনো জাতির এক অংশ অন্য অংশের দ্বারা নিজেদের স্বাধীন অধিকার খর্ব হতে দেখেছে, একে অন্যের দ্বারা শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে, তখনই শোষিত জনগোষ্ঠী শোষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের মুক্ত করতে সংগ্রাম করেছে। একই ধারায় পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে সাড়ে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির অভ্যুদয় হয়েছিল ১৯৭১ সালে।
স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস। বিশেষত মুসলমানদের প্রতিটি রক্তকণিকায়ই দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা মহানবি (সাঃ) ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। মহানবি (সাঃ) কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে তাঁর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তিনি বলতেন, ‘এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ (সহিহ বুখারি, ১০২৮)
দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। মুসলমানদের উচিত, ইসলামি সংস্কৃতি অনুসরণ করে মৃতব্যক্তিদের স্মরণ করা ও বিজয় উদযাপন করা।
আমাদের স্বাধীনতার বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর, বাঙালি জাতির বিশেষ আনন্দের দিন। বিজয় এবং স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত।
রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো সত্যিকার ঈমানদার গাদ্দারি করতে পারে না। সুতরাং এ দেশের বিজয় দিবস আমাদের গৌরব, অহংকার। স্বাধীনতার ইসলামি স্বরূপ হচ্ছে, মানুষ মানুষের গোলামি করবে না। মানুষ একমাত্র সৃষ্টিকর্তার গোলামি করবে। আল্লাহ তায়ালার জমিনে তিনি পরাধীনতা পছন্দ করেন না। যেখানে স্বাধীন ভূখণ্ড নেই, সেখানে ধর্ম নেই, আর যেখানে ধর্ম নেই, সেখানে কিছুই নেই। তাই আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত।
বিজয়ের আজকের দিনে আমাদেরকে দেশপ্রেমে এগিয়ে আসার শপথ নিতে হবে। সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে।
পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদো’ অর্থাৎ আল্লাহর দোহাই লাগে আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। শুধু তাই নয়, স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানই বাংলাদেশের উন্নতির তুলনা করে বড় আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান যখন পৃথক হলো, তখন অনেককে বলতে শুনেছি, আমাদের ওপর একটি বোঝা হিসাবে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, পৃথক হওয়ায় ভালোই হয়েছে। এসব কথা আমি নিজ কানে শুনেছি। আজ সেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। এর কারণ হলো, সেখানের নীতিনির্ধারকরা দূরদর্শী। ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর দেয়া তার এ বক্তব্যের ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল।
সৃষ্টির প্রতিটি জীব স্বাধীনতা পছন্দ করে। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না, যারা পরাধীন থাকতে চায়। তাই স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের জন্য সবাই কতই না চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে। আর এ স্বাধীনতার জন্যই মহানবি (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন। সবাইকে উপভোগ করতে দিয়েছিলেন বিজয়ের প্রকৃত আনন্দ।
প্রিয় নবি (সাঃ) মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিজয়ের চেতনাকে জাগ্রত করে, তাদের মানুষ হিসাবে নিজের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি যেমন অসংখ্য দাসকে নিজ খরচে মুক্ত করেছেন, তেমনি সমগ্র বিশ্বকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ। আসুন আমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা, দোয়া এবং শহিদদের আত্মার মাগফিরাত ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে বিজয় দিবস উদযাপন করার চেষ্টা করি।
সুদীর্ঘ নয় মাস সংগ্রাম করে আমাদের এই বিজয় অর্জিত হলেও এ বিজয় নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার এক বিরাট অনুগ্রহ। কেননা শুধুমাত্র অস্ত্র, রণকৌশল, কিংবা আত্মত্যাগের জোরে কখনও বিজয় অর্জন করা যায় না। আমাদের সম্মুখে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যে অনেক দেশ, জাতি দাসত্ব ও পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হয়ে আছে এবং তারা স্বাধীনতার জন্য বছরের পর বছর যুদ্ধ করে যাচ্ছে, কিন্তু বিজয় সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। তাই আমাদের প্রতি আল্লাহর তায়ালার এই দয়া ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত।
বিজয় উৎসবে উদ্বেলিত হয়ে শুধু মাইক বাজিয়ে আর আনন্দ প্রকাশ করার জন্য এ মুক্তির সংগ্রাম হয়নি। অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত দেশ, জীবন ও সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যেই ছিল আমাদের সংগ্রাম। আর এ লক্ষ্যেই ছিল আমাদের বিজয় অর্জন। তাই বিজয়ের দিনে আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া জ্ঞাপনের পাশাপাশি এর সুরক্ষা, উন্নয়ন, দেশের প্রত্যেকটা মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য আমাদের কাজ করার শপথ নিতে হবে।
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন।