প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

বাংলার আকাশ, বাংলার বাতাস, বাংলার ফল, বাংলার জল এবং বাংলার মানুষ অনাদিকাল থেকেই ছিল নির্মল, সহনশীল এবং আন্তরিক ভাবে অতিথিপরায়ণ। আমাদের অন্তরে বাংলা বাহিরে বাংলা, নিশ্বাসে বাংলা প্রশ্বাসে বাংলা, প্রাণে বাংলা, মনে বাংলা, বাংলাই মোদের সম্বল। বাংলাই মোদের হৃদস্পন্দন।
খ্রিস্ট পূর্বাব্দের প্রস্তর যুগে হয়তো বাংলা জোর যার মুল্লুক তার দখলে শান্তভাবেই থাকতো। একই ধারাবাহিকতার গতিতে সমাজ-সামাজিকতা পরিবাহিত হতো। ৩২১ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দ পর্যন্ত মৌর্য রাজবংশ দ্বারা বাংলা এবং বিহার ভূ-খণ্ড শাসিত হতো। সেই লৌহ যুগের প্রতিষ্ঠাতা ছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। কালান্তরে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলার শাসক ছিলেন মাধব সেন এবং তদীয় পুত্র কেশব সেন। ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার রাজধানী গৌড়েশ্বরে ছিলেন রাজা লক্ষণ সেন।
পশ্চিমবঙ্গের মালদেহ শহর থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় ও পান্ডুয়া।
তখনকার বঙ্গদেশ ছিল অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সমষ্টি। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি আস্তে আস্তে বঙ্গদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গুলো আক্রমণ করে বিজয় করতে থাকেন। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরম শিরের অধিবাসী। তার সৈন্য সংখ্যা প্রথমে ছিল মাত্র দুই হাজার। তাঁর বীরত্বে আকৃষ্ট হয়ে সৈন্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
অপরদিকে রাজা লক্ষণ সেন ছিলেন ভীরু-কাপুরুষ, অত্যন্ত আরামপ্রিয় অযোগ্য শাসক। ফলে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ গৌড়-পান্ডু পতনের পর লক্ষণ সেন আরাকানের দিকে পালিয়ে যান। ফলস্বরূপ বঙ্গদেশ বিজয় করে মুসলিম শাসন কায়েম করা নির্বিঘœ হয়ে গেল।
তুর্কী ক্রীতদাস সবুক্তিগীন কোনো এক দুর্লোভ সুযোগে গজনীতে গজনবী রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করে তদীয়পুত্র সুলতান মাহমুদকে প্রধান করে দেন। বর্তমান আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গজনী গঠিত। ১০০০-১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সতের বার ভারত আক্রমণ করেন। এ সময় তিনি সোমনাথ মন্দির সহ আরো অনেক মূল্যবান মন্দির লুণ্ঠন করে গজনীকে ধনসম্পদে বিপুল সম্পদশালী করে দেন।
এসব রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়ন, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার দুর্বৃত্তায়ন এবং দেশীয় সংস্কৃতির দুর্বৃত্তায়ন বাংলার এতটুকু ক্ষতি করতে পারে নি, যতটুকু ক্ষতি সাধিত হয়েছে স্বাধীন দেশে ভিত্তিহীন অজুহাতে আমলাতান্ত্রিক সরকারি আদেশ অমান্য করায়।
স্বাধীন দেশে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে যাহারা ‘মা ইলিশ’ নিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছে অথবা একের পর এক আইন অমান্য করছে তাদের জন্য শাস্তির বিধান গতানুগতিক না রেখে দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত। স্বাধীন বাংলার পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থায় যেমনটি বলে কয়ে আইন অমান্য করা হচ্ছে বাস্তবটা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। বাস্তবে অচলাবস্থার ভান করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের পূর্বে ঢাকায় সরকারি খালের সংখ্যা ছিল ৫৮টি। স্বাধীনতার পরের জরিপে পাওয়া গিয়েছে ৫৬টি খাল। এতদ্ব্যতীত সকল সি.এন্ড বি. রাস্তার পাশেই চওড়া খাল ছিল। কৃষি প্রধান বাংলায় এই খালের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। প্রায় প্রত্যেক শহরেই মানব সৃষ্ট জলাবদ্ধতা শহুরে জীবনকে যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের বজ্র আঁটুনী ফসকা গিরোর কারণে সি.এন্ড বি. খাল সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে। ফলে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ ভূ-খণ্ড বর্ষা ঋতু থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এক সময় খাল দিয়ে পানি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঢুকে আবার সময় মত এক পথেই বেরিয়ে যায়। আর এতেই তো আসে বর্ষায় কৃষির সুফল। প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে রাখে বর্ষা ঋতু। প্রমথ চৌধুরীর বর্ষা নিয়ে মনের ভিতর যে অব্যক্ত আবেগ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তা বর্ণনাতীত। রবীঠাকুরের কবিতায় বর্ষার যে অপরূপ সৌন্দর্য চিত্রিত হয়েছে তার বিন্দুমাত্র মূল্য কি ঐ খালখেকোদের কাছে আছে? আমরা শৈশবে শুনেছিলাম আফ্রিকার জঙ্গলে মানুষখেকো গাছ আছে, আর স্বাধীন বাংলাদেশে দেখছি খালখেকো এবং নদীর অবৈধ বালিখেকো দুর্বৃত্তের কমতি নেই।
উইকিপিডিয়ার মতে, ঢাকার ৪২টি খালের মৃত্যু হয়েছে (প্রথম আলো ৪ জুন ২০২২), যার মধ্যে ২৬টির কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই। বাকিগুলো দখলে-দূষণে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। দিনাজপুরের একসময়ের খর¯্রােতা পূর্ণ ভবা নদী এখন শুধুই ড্রেন মাত্র/এসব ভূমিদস্যুতার প্রতীক মাত্র। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব অপকর্মের অঙ্কুরোদ্গমেই প্রতিহত করতে পারতো।
মেঘনার মোহনা থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাকাতিয়া নদীটি আজ মৃত বল্লেও অত্যুক্তি হবে না। বর্ষায় এ নদীর দুই কুল বেয়ে ফসলী জমিতে পলি আসতো, অত্যন্ত সুস্বাদু শিলৈন মাছ, বাচা মাছ, বজরী এবং ছোট আকারের চিংড়ির মাছেরও প্রজনন হতো। আরো চমৎকার দৃশ্য দেখা যেত যে, ডলফিনের প্রজাতি ‘হু’ মাছের খেলা। এ দৃশ্যগুলো দেশের প্রায় সকল শাখা নদীগুলোতে দেখা যেত।
এসব প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি, পানি, বায়ু প্রভৃতি- আর মানবিক প্রপঞ্চ হলো সংস্কৃতি, সভ্যতা, সমাজ প্রভৃতি পরস্পর পরস্পরের উপর ওতপ্রোতভাবে নির্ভরশীল। মরা এবং নিশ্চিহ্ন খালগুলোর আবিষ্কার করে সংস্কারে হাত দিলেই জলাবদ্ধতা নিবারিত হবে। এজন্যে দেশপ্রেমিক বড় মানুষের প্রয়োজন, বড় লোকের প্রয়োজন নেই। দেশের বড় বড় খাল যারা দখল করেছে তারা কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ণ প্রকল্পের আকাক্সক্ষী নয় বরং তারাই বিনিময়ে আশ্রয় দাতা। পাকিস্তানের মাত্র ২৩ পরিবারের অত্যাচার এবং শোষণের নির্মম কাহিনী শুনে এবং দেখেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
আজ কিন্তু সর্বস্তরেই সজ্জিত মুক্তিযোদ্ধারা বিচরণ করতেছে। এদের ভিড়ে আসল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিক প্রপঞ্চ হোক আমাদের চলার পাথেয়।
* বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।