প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
আচ্ছা আপু, তুমি কি আব্বাকেও পড়াইছ? ছাত্রের প্রশ্নে লজ্জা পেয়ে যায় শিক্ষিকা। কী বলবেন বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। এমন সময় ত্রাণকর্তার মতো আবির্ভূত হলেন স্বয়ং ছাত্রের বাবা। হিমালয়ের মতো মানুষটাকে দেখলেই তার প্রণত হওয়ার ইচ্ছে জাগে। তাই ছেলের শিক্ষিকা হলেও জীবন্ত হিমালয়ের সামনে তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু তাকে উঠতে দিলে তো! হিমালয় নিজেই যেন নুয়ে গিয়ে মাথায় আশিসের অমৃতধারা দিয়ে তাকে সিক্ত করে দিলেন। এ যেন ছাত্রের পিতা নয়, বিধাতার আলোকিত দূত। তাঁর মঙ্গল করস্নেহে শিক্ষিকা গীতালির বুঝি নতুন করে আলোকন প্রাপ্তি হলো। শিহরণ জাগানো ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মাস্টর তোর ছাত্রের খবর কী? কানের পর্দায় এ কথা ঢোকার পর থেকেই ছাত্রের বাবা যেন নিজের বাবা হয়ে যায়। তবু একটু সমীহ রেখে শিক্ষিকা তাঁকে কাকা ডেকেই নিজেকে সামলে নেন। বাবার সামনে নিজের টিচারকে কাচুমাচু হতে দেখে মজাই লাগে রাসেলের। বয়স ছয় হলে কী হবে, খুব দুরন্ত ডানপিটে। সারাক্ষণ হয় পায়রা নয় ঘুড়ি এ নিয়েই তার ব্যস্ততা। চোখ দুটো উপচে মেধার যে ধার জ্বলে ওঠে তার এক আনাও খরচ করে না পড়ায়। খালি ফাঁকিবাজি। তার এই ফাঁকিবাজির শক্তি বড় বোনের আদরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। বোনের ছেলে অর্থাৎ ভাগ্নেটা যেন তার খেলার পুতুল। একে তো নাচুনে বুড়ি, তার ওপর নাদুস নুদুস ভাগ্নেটা যেন ঢোলের বাড়ি। তার ছোট আপার সাথে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। অঙ্কে ফেল করেছে বলে ছোট আপার কি উপহাসই না তার সহ্য করতে হয়েছে! তো কী আর করা! গৃহশিক্ষিকাকেই বলতে হলো ভয় লাগিয়ে, দেখো পরের বার ফেল করলে আমি কিন্তু...। রাসেল কথাটা বুঝে নিয়েই দ্রুত বলে উঠলো, এখন খেয়ো না, আমাকে একবার সুযোগ দাও। এবার টিচার বুঝলেন, ডানপিটে হলেও রাসেল তার টিচারকে পছন্দ করে ফেলেছে। টিচার তো রাসেলের কথা শুনেই মনে মনে খুশি। যে ছেলেকে প্রথম দিন পড়াতে এসে নিজেই ভড়কে গিয়েছিলেন, আজ তার মনে হচ্ছে তিনি সমরজয়ী সেনাপতি।
টিচারকে রাসেল আপুই ডাকতো। তিনি আসলে তার বড় বুবুর ছোট বয়সে। রাসেলের টিচার আপু খুব খেয়াল করে একটা দারুণ টেকনিক বের করলেন। পড়ায় তাকে টেনে নিতে এক একদিন এক এক মহা পুরুষের জীবনকাহিনী বলতেন। সেদিন তিনি কী ভেবে মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধের কথা বললেন। রাসেল এক একটা প্রশ্ন করে গল্পের মাঝে মাঝে আর টিচার আপু তার জবাব দেন। আচ্ছা আপু, গৌতম বুদ্ধ যে তীর বের করে হাঁসটাকে বাঁচালেন, তিনি কি আমার মতো পায়রা পালতেন? না রে! গীতালি টিচার জবাব দেন। তিনি কোনো প্রাণী পালতেন না। সব প্রাণীকে ছেড়ে দিতেন। কারণ তিনি মনে করতেন, সবার স্বাধীন জীবন আছে। আচ্ছা আপু, রাসেল আবারো প্রশ্ন করে, গৌতম বুদ্ধ রাজা হলো না কেন? রাসেল প্রশ্ন করে। আরে! রাজা হবে কেন? তাঁর তো মানুষের দুঃখে মন কাঁদে। তাই তিনি মানুষের দুঃখ দূর করার উপায় খুঁজতে বের হলেন। আচ্ছা, তিনি কীভাবে মানুষের দুঃখ দূর করার উপায় বের করলেন? রাসেল খুব কৌতূহলী জানতে। টিচার আপু বললেন, হুম, খুব ভালো প্রশ্ন। বুঝলাম, তুমি মনোযোগী। এই মনোযোগই তাঁকে সত্য আবিষ্কারে সাহায্য করলো। সে কেমন? রাসেল অবাক। ছোট শিশুর সরল দু’চোখে বিস্ময় দেখে টিচারের বুকে অপার মমতা তৈরি হয়। তিনি বললেন, সিদ্ধার্থ গৌতম অনেকের কাছে মানুষের দুঃখ দূর করার উপায় জানতে চেয়েছেন। কিন্তু কারো কাছে উপযুক্ত উত্তর না পেয়ে নিজের চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করার চিন্তা করলেন। রাসেলের একটু কষ্ট হলো এ কথা বুঝে নিতে। রাসেল বললো, একটু সহজ করে বলো। টিচার একটু পানি খেয়ে নিয়ে বললেন, আচ্ছা। এই ধরো, তুমি যখন একটা গণিত সমাধান করতে পারো না তখন কী করো? ওটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকো না? থাকো তো? হ্যাঁ হ্যাঁ। রাসেল বললো। ঠিক তাই। সিদ্ধার্থ গৌতমও এই প্রক্রিয়ায় তাঁর চিন্তাকে একাগ্র করলেন। কীভাবে? বলো বলো? রাসেলকে উদগ্রীব দেখে টিচার বলে ফেললেন দ্রুত, ধ্যানের মাধ্যমে। ধ্যানই হলো বিক্ষিপ্ত মনকে, অস্থির চিন্তাকে একাগ্র করতে পারে। চিন্তার শক্তি যেমন প্রগাঢ় তেমনি ধ্যানের শক্তিও প্রবল। রাত বেশি হয়ে যাওয়াতে সেদিন আর গৌতম বুদ্ধের জীবনকথা শেষ হয় না বলা। পরদিনের জন্যে মুলতবি রেখে চলে আসেন টিচার আপু। কিন্তু রাসেলের চোখে ঘুম নেই। রাসেল শুধু ধ্যানের কথা ভাবে আর রাজার পুত্রের কথা ভাবে। যিনি মানুষের দুঃখ দূর করার জন্যে রাজার সিংহাসন ও রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছেন গৈরিক বস্ত্র পরিধান করে।
পরেরদিন নতুন এক সূর্য ওঠে, তাণ্ডও আবার হেলে পড়ে পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যে সাতটায় টিচার গীতালি আপু আসেন রাসেলের বাসায়। তার কণ্ঠস্বর শুনেই বেরিয়ে এলেন রাসেলের বাবা। খুশি আর উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, মাস্টর! তুই তো আমার সর্বনাশ করছস্! তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন রেণু কাকিমা অর্থাৎ রাসেলের মা। আর তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলো রাসেল। গীতালি টিচার চোখ মাথায় তুলে নিয়ে চেয়ে রইলেন সেই হিমালয়প্রতিম মানুষটার দিকে। তিনি কন্যাসম টিচারের মাথায় স্নেহের হাত দিয়ে রাসেলের মাকে বললেন- রেণু, তোমারে আমি কইছিলাম না, যে ঠিক টিচার আমি পায়া গেছি।’ হাসতে হাসতে তিনি গীতালি টিচারকে বললেন, মাস্টর, তোর ছাত্র গৌতম বুদ্ধরে নিয়া সারা রাইত স্টাডি করছে। আমারে প্রশ্ন কইরা ঘুমাইতে দেয় নাই। সে কী কইছে জানস? তাঁর এই স্নেহার্দ্র কথায় গীতালি টিচার অবাক হয়ে বসে থাকে। অনুমান করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়, রাসেল তার বাবাকে কী বলেছিল কাল রাতে। এদিকে রাসেলের বাবার চোখেমুখে দুষ্টুমির আভা দেখে হেসে ওঠেন রেণু কাকিমাও। একটু পরেই কাকা সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বলে ওঠেন পরম প্রশান্তি নিয়ে, রাসেল আমারে জিগায়, 'আমি ক্যান্ গৌতম বুদ্ধ হইলাম না!’ কাকার বলার মধ্যে যে সমীহ ছিল তাতে সহজেই বুঝা যায়, গৌতমবুদ্ধ কাকার প্রিয় মহাজ্ঞানীদের একজন ছিলেন।
সেদিনের পরে আর কখনোই রাসেলকে গৌতমবুদ্ধের পুরো জীবনী শুনিয়ে শেষ করতে পারেননি গীতালি টিচার। পারবেন কীভাবে? রাসেল যে নিজে নিজেই সব জানবে বলে পৃথিবী ত্যাগ করে জ্ঞানের সন্ধানে বের হয়ে পড়েছে বাবা-মা’র হাত ধরে!