প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২১, ১২:১৮
কাজী শাহাদাত
প্রথমত এ কথা বলতেই হবে, নিজের সাথে লড়াই করেই চাঁদপুর কণ্ঠে টিকে আছি ২৭ বছর। তারপর আরো কতো লড়াইয়ের কাহিনী যে আছে!
|আরো খবর
লড়াইয়ের সব কাহিনী খোলসা করে বলা যাবে না। তারপরও সেল্ফ-সেন্সর পদ্ধতিতে যতোটুকু বলা যায়, লিখা যায় ততোটুকুই লিখবো। কেননা এজন্যে আত্মতাগিদ অনুভব করছি প্রতিনিয়ত।
বৈশি^ক মহামারী করোনায় দেশের সবচে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কিছু সেক্টরের মধ্যে গণমাধ্যম অন্যতম। কর্পোরেট হাউজের ন্যায় বড় প্রতিষ্ঠান না হলেও চাঁদপুর কণ্ঠ আঞ্চলিকভাবে শীর্ষস্থানীয় দৈনিক হিসেবে করোনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির শিকারের বাইরে নেই। সেজন্যে আর্থিক দৈন্যতা বা সঙ্কটের সাথে লড়াই করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সোয়া এক বছর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই কষ্টকর দিনগুলো অতিক্রম করছি। হতাশা-নিরাশার দোলাচালে দুলতে হচ্ছে প্রতিটি প্রহর। এরই মধ্যে এসে গেলো স্মরণীয় ১৭ জুন, ১৯৯৪ সালের যেদিন চাঁদপুর কণ্ঠের জন্ম হয়। সে হিসেবে আজ চাঁদপুর কণ্ঠের বয়স হয়ে গেলো কাঁটায় কাঁটায় ২৭ বছর।
এই ২৭ বছর কেটেছে আমার লড়াইয়ে লড়াইয়ে। তবুও আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে আছি। প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক আলহাজ¦ অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার ছাড়া কার্যত কেউই আমার সাথে এতোটা সময় ধরে নেই। কাগজে-কলমে কেউ কেউ থাকলেও বাস্তবে নেই। কেউ ভালো লাগে না বলে চলে গেছে, কেউ পোষায় না বলে চলে গেছে, কেউ আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেছে, কেউ অসুবিধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে চলে গেছে, কেউ অন্যত্র ভালো সুযোগ পেয়ে চলে গেছে, কেউ অনেক বড় হবার সুযোগ খুঁজতে চলে গেছে, কেউ সিঁড়ি পেয়ে উল্লম্ফন দিয়েছে, কেউ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কিংবা আমাদেরকে শিকারে পরিণত করতে হঠাৎ-বিদায় নিয়েছে, কেউ পেশা পরিবর্তনের প্রয়োজনে চলে গেছে, কেউ দেশত্যাগের প্রয়োজনে চলে গেছে, কেউ প্রতিপক্ষ হবার উদ্দেশ্য সাধনে চলে গেছে। কিন্তু আমি চলে যাইনি। কেনো যাইনি-এটা নিয়েই আমার সাথে আমার জাগ্রত বিবেকের যতো লড়াই।
চাঁদপুর কণ্ঠে কাজ করাকালেই প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদানের অফার আসে। যাইনি। হতে পারে যোগ্যতার অভাব কিংবা হীনমন্যতার জন্যে যাইনি। চাঁদপুরের অন্য দৈনিকে গাড়ি-বাড়ির সুযোগসহ সন্তোষজনক বেতনে সম্মানজনক পদে তথা নির্বাহী প্রধান হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব এসেছে। যাইনি। কেনো যাইনি ? নিশ্চয়ই সংগত কারণে যাইনি। এজন্যে বিবেকের সাথে, শুভাকাক্সক্ষীদের সাথে, নিকটাত্মীয়দের সাথে লড়াই কিন্তু কম হয়নি। ভর্ৎসনা সহ্য করে, বকাঝকা হজম করেও চাঁদপুর কণ্ঠেই শুঁকেছি এমন ঘ্রাণ, যে ঘ্রাণ আমাকে দিয়েছে উজ্জীবনী শক্তি।
চাঁদপুর কণ্ঠে কাজ করতে গিয়েই একজন সাবেক মন্ত্রীর সর্বোচ্চ হুমকি পেয়েছি। যিনি মোবাইল ফোনে বলেছেন, তুই তো আমার পেছনে লেগেছিস্। মন চায়, তোর অফিস/বাসা থেকে তোকে তুলে নিয়ে জবাই করে চামড়াটা খুলে ফেলি। আর এক ছোট মন্ত্রীর এপিএস বলেছেন, তুই অনেক বেড়ে গেছিস্, তোকে মারতে খরচ করবো না একটির বেশি গুলি। এক ক্ষমতাধর ব্যক্তি চাঁদপুর প্রেসক্লাবে আমি সভাপতি থাকাকালীনই সাংবাদিক সম্মেলন করে চাঁদপুর কণ্ঠের বিরুদ্ধে বলেছেন যা-তা কথা। দিয়েছেন মামলার হুমকি। এক সাবেক এমপি ক্ষমতার উচ্চ শিখরে বসে আমাকে ‘আওয়ামী বাস্টার্ড’ বলে দিয়েছেন গালি, আর মালিককে দিয়েছেন হুমকি। সবশেষে কেড়ে নিতে চেয়েছেন মুখের গ্রাস। কিন্তু আশ্চর্য ! একদিনের জন্যেও আল্লাহর অশেষ রহমতে বাস্তুচ্যুত হইনি, অভুক্ত থাকিনি।
‘গাছের শত্রু গাছ, মাছের শত্রু মাছ’ এমন সূত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-তে নিজ পেশার এক বা একাধিক লোক বেনামে আমার বিরুদ্ধে প্রায় ৬০টি অনিয়মের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। যার অনুলিপি জেলা ও পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নিকট প্রেরণ করে। উদ্দেশ্য ছিলো নিতান্তই হেনস্তা করা, মনোবল পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া। অভিযোগকারীকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও টিআইবি আমার আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য লিখিতভাবে গ্রহণ করে এবং আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগগুলো তদন্তে তিন কর্মকর্তা পাঠিয়ে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা ব্যয় করে। শেষ পর্যন্ত একটি অভিযোগকেও আমলযোগ্য বিবেচনা করতে না পেরে ইতিবাচক তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে ক্ষান্ত হয়।
চাঁদপুর কণ্ঠে কাজ করার কারণেই একটি সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক এক ব্যক্তি ভুল বুঝিয়ে একদিন সকালে অনেক লোকজন জড়ো করে আমার বাসার নিকটে। সেখানে আমাকে ও আমার সহকর্মী বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহকে ‘রাজাকার’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে যাচ্ছেতাই বক্তব্য দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এবং এক বক্তা বারো ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার হুমকি দেন। পরবর্তীতে আরেকটি সংবাদে সত্য জেনে চুপসে যায়, দমে যায়। তবে বিভিন্নভাবে ঘায়েল করার চক্রান্তে আছে লিপ্ত।
চাঁদপুরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উত্থান, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের কারণে ওই গোষ্ঠীটি প্রাক্তন ছাত্রদের লেলিয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমার ও আমার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে। কিন্তু নির্ভয়ে লাগাতার লেখালেখির কারণে তাদের দুর্গপতন হয়েছে, সেখানে উড়ছে এখন স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির বিজয়-ধ্বজা।
এভাবে কতোটা লড়াইয়ের কথা বলবো। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসিতে চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারে অনৈক্য ও গ্রুপিং সৃষ্টি করে এটিতে অপশক্তির প্রাধান্য বিস্তারের অপচেষ্টা কিংবা অভ্যুত্থান প্রয়াসও হয়েছে বহুবার। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট অশেষ শোকরিয়া, এমন অপপ্রয়াসে ‘স¤্রাট’রূপী ইকবাল-বিন-বাশার রাজত্ব হারান নি, আর আমিও হারাইনি আমার পদ। তবে একেকটা অপপ্রয়াসে তথা ঝড়ে ‘চাঁদপুর কণ্ঠে’র মতো মহীরুহের ডালপালা ভেঙ্গেছে, পাতা ঝরেছে, কিন্তু ঝরেনি কা-রূপী সম্পাদকীয় নীতি এবং ‘স্লো বাট স্টিডি’ পদ্ধতিতে সামনে এগিয়ে চলার পরিকল্পনা। এতে নেই ও ছিলো না জৌলুস, তবে ছিলো ও আছে অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার আন্তরিক প্রয়াস।
চাঁদপুর কণ্ঠই চাঁদপুরে অনেক দৈনিক ও সাপ্তাহিকসহ বিভিন্ন পত্রিকার ভিড়ে টিকে থাকা একমাত্র ২৭ বছর বয়সী পত্রিকা, যার নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশনায় নেই কোনো ছেদ, নেই কোনো অসংগত বিরতি বা ছুটি।
নব্বইর দশকের শুরুর দিনগুলোতে দৈনিক জনকণ্ঠ যখন ছিলো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, বিশেষ করে সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্যতায় ছিলো আলোচিত ও সমাদৃত, ঠিক তখনই চাঁদপুরের উদীয়মান প্রখ্যাত আইনজীবী ইকবাল-বিন-বাশার চাঁদপুর থেকে আধুনিক ধাঁচের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের চিন্তা শুরু করেন। সে চিন্তার আলোকে প্রস্তাবিত অনেক নাম থেকে বাছাই করে তিনি একটি নাম পছন্দ করেন, যে নামটিই হচ্ছে চাঁদপুর কণ্ঠ। সৌভাগ্যক্রমে এই নামটি প্রস্তাব করেছিলাম আমি। ১৯৯৪ সালের ১৭জুন বৃষ্টি¯œাত সকালে এ নামেই যাত্রা শুরু হয় পত্রিকাটির।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ; সাবেক সভাপতি : চাঁদপুর প্রেসক্লাব, চাঁদপুর রোটারী ক্লাব ও চাঁদপুর সনাক, টিআইবি; সভাপতি : চাঁদপুর সুইমিং ক্লাব, চাঁদপুর সাঁতার পরিষদ ও কমিউনিটি পুলিশিং, চাঁদপুর অঞ্চল-৫।